Advertisement
০৩ মে ২০২৪
জাতীয় রাজনীতির মঞ্চে বাঙালি নেতাদের সংখ্যা তলানিতে
CPI

‘হে বঙ্গ, ভাণ্ডারে তব...’

২০১৯-এর লোকসভায় রাজ্য থেকে ১৮টি আসন জেতার পরে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় বাংলা থেকে ছিলেন দু’জন ‘আধা’ মন্ত্রী!

ওজনদার: লোকসভার তৎকালীন স্পিকার সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে জ্যোতি বসু, ২০০৪।

ওজনদার: লোকসভার তৎকালীন স্পিকার সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে জ্যোতি বসু, ২০০৪।

দেবাশিস ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ২৭ অক্টোবর ২০২২ ০৫:৫১
Share: Save:

ভারতের সাবেক কমিউনিস্ট পার্টি সিপিআই-এর সদস্য-সংখ্যা এ রাজ্যে দাঁড়িয়েছে মাত্র ছাব্বিশ হাজার। ফলে এখান থেকে দলের জাতীয় পরিষদে প্রতিনিধির সংখ্যাও এ বার কমল। অনেকের কাছে খবরটি হয়তো অকিঞ্চিৎকর। কারণ, সিপিআই-এর অস্তিত্ব, অন্তত বাংলায়, বহু দিন ধরেই সঙ্কটাপন্ন। তবু ওই তথ্যের নির্যাসটুকু কোথায় যেন ধাক্কা দেয়!

এ কথা বলার পিছনে কোনও গভীর পর্যালোচনার উদ্দেশ্য নেই। তবে ভেবে খারাপ লাগে, এক দিন এই সিপিআই-এর বাঙালি নেতারা শুধু রাজ্যেই নয়, জাতীয় রাজনীতিতেও রীতিমতো প্রাসঙ্গিক ছিলেন। অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির সময় থেকেই তা চলে এসেছে। পাশাপাশি এটাও ঘটনা যে, সর্বভারতীয় বলে স্বীকৃত ও প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলিতে প্রভাবশালী বাঙালি নেতার সংখ্যা আজ সামগ্রিক ভাবে দ্রুত কমে গিয়েছে এবং যাচ্ছে। সিপিআই, সিপিএম, কংগ্রেস, সব দলেই। কারণ ভোটবাক্সে তারা এখন কার্যত প্রান্তিক!

বিজেপিকে সহজবোধ্য কারণে ওই তালিকার বাইরে রাখাই ভাল! ওই দলে অদূর ভবিষ্যতেও বাঙালির কোনও উচ্চাসন পাওয়ার সম্ভাবনা আছে বলে মনে হয় না। ২০১৯-এর লোকসভায় রাজ্য থেকে ১৮টি আসন জেতার পরে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় বাংলা থেকে ছিলেন দু’জন ‘আধা’ মন্ত্রী! একুশের বিধানসভায় হারার পরে কেন্দ্রে বাংলার মন্ত্রীর সংখ্যাবৃদ্ধি ঘটলেও ‘মূল্য’বৃদ্ধি হয়নি।

প্রকৃতপক্ষে এখন জাতীয় স্তরে গণ্য হওয়ার মতো একমাত্র বঙ্গনেতার নাম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার আগে থেকেই অবশ্য নিজের সেই অবস্থান তিনি তৈরি করে নিয়েছিলেন। তৃণমূলের মতো একটি আঞ্চলিক দলের উত্থান ও অগ্রগতির সঙ্গে হয়তো এর কিছুটা যোগ খুঁজে পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু আরও যে সব রাজ্যে বিভিন্ন আঞ্চলিক দল শক্তিশালী হয়ে উঠেছে, জাতীয় স্তরে সেখানকার অন্য দলগুলির নেতাদের গুরুত্ব ও মর্যাদা বাংলার মতো এতটা করুণ নয়। সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে আজ ওজনদার বাঙালি নেতার অভাব তাই বেশি করে চোখে লাগে।

দেশের রাজনৈতিক মঞ্চে জ্যোতি বসুর যে ‘গুরুভার’ ছিল, সিপিএম-এর আর কেউ সেখানে পৌঁছতে পারেননি। তিনি তালেগোলে প্রধানমন্ত্রী হয়ে গেলে ভাল হত না খারাপ, বলা কঠিন। কিন্তু চিরজীবন বিধানসভায় থাকা এই বঙ্গনেতার সামনেই যে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সম্ভাবনা গাছপাকা আমের মতো ঝুলেছে, সেই সত্য কখনও মুছবে না।

বিগত তিন-চার দশকের মধ্যে জাতীয় স্তরে আরও যে সব বাঙালি নেতা নিজেদের রাজনৈতিক অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলেন, তাঁদের তালিকাটি ছোট নয়। এঁদের মধ্যে প্রণব মুখোপাধ্যায়, বরকত গনি খান, প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি প্রমুখ কংগ্রেস নেতা-মন্ত্রী যেমন ছিলেন, তেমনই ছিলেন আরএসপি-র সাধারণ সম্পাদক ও সাংসদ ত্রিদিব চৌধুরী, ফরওয়ার্ড ব্লকের সাধারণ সম্পাদক ও সাংসদ চিত্ত বসুর মতো অপেক্ষাকৃত ছোট দলের কয়েক জন। সিপিআই সাংসদ ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত তাঁদের দলের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন ছ’বছর। এঁদের নিজ নিজ রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, পদক্ষেপের ভাল-মন্দ, কূটকৌশল, সততা, ধূর্ততা, স্বার্থপরতা ইত্যাদি থাকতেই পারে। সে বিশ্লেষণ এখানে অপ্রয়োজনীয়। আসলে বলার বিষয়, দীর্ঘ সময় জুড়ে বিভিন্ন দলের সর্বভারতীয় মঞ্চে ওই বাঙালি নেতারা স্ব-প্রভায় বিরাজ করেছেন। আজ সেটাই প্রায় নিবন্ত।

স্বাধীনতার আগে, ১৯৪৬ সালে, কনস্টিটিউয়েন্ট অ্যাসেম্বলিতে একমাত্র কমিউনিস্ট প্রতিনিধি ছিলেন সিপিআই-এর সোমনাথ লাহিড়ী। সেখানে সংবিধানের খসড়া নিয়ে আলোচনায় ওই বাগ্মী কমিউনিস্ট নেতার সক্রিয় ভূমিকা ছিল। পরবর্তী কালে ভূপেশ গুপ্ত, হীরেন মুখোপাধ্যায়, ইন্দ্রজিৎ গুপ্তের মতো সিপিআই সাংসদরা কেউ লোকসভা, কেউ রাজ্যসভা কাঁপিয়েছেন। এগারো বার লোকসভায় জেতা ইন্দ্রজিৎ তো শেষবেলায় দেবগৌড়া ও গুজরালের মন্ত্রিসভায় বছর দুয়েক কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও হয়েছিলেন। তাঁর আগে-পরে আর কোনও বাম নেতা এখনও পর্যন্ত কেন্দ্রে মন্ত্রী হননি। লোকসভার স্পিকার হয়েছিলেন সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়। সিপিআই সাংসদ হিসাবে গীতা মুখোপাধ্যায়, গুরুদাস দাশগুপ্তদের ভূমিকাও দিল্লিতে নজর কেড়েছে বার বার।

বিভিন্ন দলের এই সব উদাহরণ সামনে রেখে একটি প্রশ্ন উঠতে পারে, সংসদীয় ভূমিকাই কি তা হলে দলীয় সংগঠন ও জাতীয় রাজনীতিতে গুরুত্ব নির্ধারণের মাপকাঠি? এ কথা ঠিক, সংসদে যাঁরা সক্রিয় থাকেন, তাঁদের মুখে স্বাভাবিক ভাবেই বেশি আলো পড়ে। সেই পরিচিতির সুবাদে এবং ভোট-রাজনীতির স্বার্থে হয়তো নিজের দলেও তাঁরা এগিয়ে যাওয়ার বাড়তি সুযোগ পেয়ে যান।

কিন্তু এটি একেবারে স্বতঃসিদ্ধ ধরে নিলেও ভুল হতে পারে। সিপিএম-এর প্রমোদ দাশগুপ্ত বা ফরওয়ার্ড ব্লকের অশোক ঘোষের কথাই ধরা যাক। তাঁরা কেউ জীবনে কোনও দিন পুরসভার ভোটেও লড়েননি। তবু নিজ নিজ দলের শীর্ষ স্তরে তাঁদের ভূমিকা ও প্রভাব ছিল প্রশ্নাতীত। জাতীয় রাজনীতির বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সময়ে তাঁদের যথেষ্ট সক্রিয়তাও দেখা গিয়েছে। ক্ষয়ে যাওয়া ফরওয়ার্ড ব্লকে এখনও সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে এক বঙ্গসন্তান, দেবব্রত বিশ্বাস। দলের সাধারণ সম্পাদক না হলেও সিপিএম পলিটবুরোয় বিমান বসু, অনিল বিশ্বাসদের উপস্থিতি এক সময় ‘অনুভব’ করা যেত। কোনও দিন ভোটে না-লড়া দুই বঙ্গ-কমরেড অনিল ও বিমান দলের শীর্ষ স্তরে তখন যতটা ‘মূল্য’ পেতেন, সূর্যকান্ত মিশ্র বা মহম্মদ সেলিম কি তেমনটি পান? তাঁদের উপস্থিতি কি পূর্বসূরিদের মতো ছাপ ফেলতে পারে? বলতেই হবে, পারে না।

কংগ্রেসের অবস্থা আরও বিচিত্র। দেশের অন্যতম বৃহৎ জাতীয় দলটি রাজ্য বিধানসভায় আজ সিপিএম-এর মতোই শূন্য। লোকসভায় বঙ্গ কংগ্রেস টিমটিম করছে। তবুও বাংলায় দলের দুই সাংসদের এক জন অধীর চৌধুরী এখন লোকসভার বিরোধী দলনেতা। সংসদীয় গণতন্ত্রের কেতাবি পাঠ মানলে তাঁর পদটি কার্যত ‘বিকল্প প্রধানমন্ত্রী’র। কথাটি বলতে যতটা শ্লাঘার, বাস্তবেও কি তা-ই? কেন তাঁকে কংগ্রেস হাই কমান্ড হঠাৎ ওই পদে বেছে নিলেন, অধীরই বা নিজেকে পদ অনুযায়ী কতখানি উন্নীত করতে পেরেছেন, সে মূল্যায়নে না গিয়ে শুধু ভাবতে চাই, তাঁর পদ যতটা ভারী, কংগ্রেসের হাই কমান্ড কি তাঁকে ততটা পরিসর দিয়েছে? অধীর কি সত্যিই জাতীয় স্তরে, এমনকি নিজের দলের ভিতরেও, তেমন ‘মান্যতা’ পান? বিরোধী রাজনীতির বৃহত্তর ক্ষেত্রেই বা তিনি পদাধিকারের নিরিখে কতটা ‘স্বীকৃত’? তাঁকে কি কোনও গুরুদায়িত্ব দেওয়া হয়? এই প্রশ্নগুলির সঙ্গেও জড়িয়ে জাতীয় রাজনীতিতে বাঙালির অবস্থানের বিষয়।

এটা জানা কথা, কোনও দলের ভাগ্য নির্ধারিত হয় জনসমর্থনের ভিত্তিতে। আর নেতাদের মর্যাদা নির্ভর করে দলের অবস্থার উপর। রাজ্যে কংগ্রেস, সিপিএম, সিপিআই-এর মতো জাতীয় দলগুলিকে স্বাভাবিক ভাবেই জমি হারানোর মাসুল দিতে হচ্ছে।

কংগ্রেস ক্ষমতাকেন্দ্রিক। রাজ্যে তাদের বরাত পুড়েছে বটে। তবে রাষ্ট্রপতি হওয়ার আগে পর্যন্ত একা প্রণববাবু কেন্দ্রে মন্ত্রী এবং দলে ‘ক্রাইসিস ম্যানেজার’ হিসেবে জাতীয় রাজনীতিতে বাঙালির অস্তিত্বটুকু টের পাইয়েছেন।

বিস্ময় জাগে বামেদের দশা দেখে। ক্ষমতা হারানোর দশ বছরের মধ্যে রাজ্যে সিপিআই উঠে যেতে বসেছে! সিপিএম লোকসভা-বিধানসভায় অস্তিত্বহীন! দলের বঙ্গনেতারা জাতীয় রাজনীতিতে কার্যত পিছনের সারিতে! এক কালে ‘নিরন্তর’ আন্দোলনের কথা বলা কমরেডরা এ জন্য ‘দায়ী’ করবেন কাকে? মমতা, না নরেন্দ্র মোদী?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

CPI Politics West Bengal
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE