Advertisement
৩০ এপ্রিল ২০২৪
চূড়ান্ত নৈরাজ্যের মধ্যে মুখরক্ষার চেষ্টায় উত্তরাখণ্ড সরকার
Uniform Civil Code

খড়কুটো আঁকড়ে বাঁচা

ভোটের রাজনীতি কে না করে? কিন্তু উত্তরাখণ্ডের মুশকিল, ‘লাভ জেহাদ’। বাঙালি শুধু কেদার-বদ্রীতে তীর্থ এবং ট্রেকিং করতে গিয়েই কর্তব্য সমাপন করেছে, উত্তরাখণ্ডের কান্নার খবর রাখেনি।

An image of Chief Minister of Uttarakhand

অতিসক্রিয়: দেহরাদূনে বিধানসভা ভবনে সংবিধান হাতে উত্তরাখণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী পুষ্কর সিংহ ধামী, ফেব্রুয়ারি ২০২৪। ছবি: পিটিআই।

গৌতম চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ০৮:৩৬
Share: Save:

ঐতিহ্যঋদ্ধ দেবভূমি এখন অভিন্ন দেওয়ানি ভূমি। হরিদ্বার-হৃষীকেশ-মায়াবতীখ্যাত উত্তরাখণ্ডের বিধানসভাই এ দেশে ‘অভিন্ন দেওয়ানি বিধি’ বিল আনার প্রথম রাজ্য। অতঃপর মোদী, শাহের ভজনায় অসম, রাজস্থান বা অন্য বিজেপিশাসিত রাজ্যগুলি একই পথের পথিক হয় কি না, অন্য গল্প। কিন্তু উত্তরাখণ্ড অন্য রকম। ২০১১ সালের জনগণনায় সেখানকার ৮২.৯৭ শতাংশ নাগরিক হিন্দু। এই হিন্দুদের মধ্যে আবার ২০ শতাংশ ব্রাহ্মণ। হিমাচলপ্রদেশের মতো পাহাড়ি রাজ্যে ব্রাহ্মণ জনসংখ্যা মাত্র ১৪ শতাংশ। কান টানলে মাথা আসার মতো হিমাচলকেও টানলাম, কারণ এই দুই রাজ্যে ব্রাহ্মণের সংখ্যা বেশি, উপরন্তু প্রায় প্রতিটি ঘর থেকে কেউ না কেউ সেনাবাহিনীতে। দুইয়ের মধ্যে পুষ্কর সিংহ ধামীর উত্তরাখণ্ড সরকার গত কয়েক বছর ধরেই অপদার্থতা ও অর্কমণ্যতার হরেক নজির রাখছিল। লোকসভা ভোটের আগে শেষ মুহূর্তে তাই অতিসক্রিয় ভঙ্গিতে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি আনার চমক দেওয়া ছাড়া তার আর গত্যন্তর ছিল না।

হিন্দু জনসংখ্যার ২০ শতাংশ ব্রাহ্মণ। আর গাড়োয়াল, কুমায়ুন মিলিয়ে উত্তরাখণ্ড রাজ্যের ১৮.৭ শতাংশ তফসিলি জনজাতি। জানুসারি, ভোটিয়া, থারুদের ধরলে আরও ২.৮৯ শতাংশ যোগ হবে। উত্তরাখণ্ড বিধানসভার প্রস্তাবিত বিধিতে কেন জনজাতিদের আনা হয়নি, এ বার নিশ্চয়ই পরিষ্কার। ভোটের রাজনীতি!

ভোটের রাজনীতি কে না করে? কিন্তু উত্তরাখণ্ডের মুশকিল, ‘লাভ জেহাদ’। বাঙালি শুধু কেদার-বদ্রীতে তীর্থ এবং ট্রেকিং করতে গিয়েই কর্তব্য সমাপন করেছে, উত্তরাখণ্ডের কান্নার খবর রাখেনি। গত দেড় বছর ধরে উত্তরাখণ্ডের হরিদ্বার থেকে গোচর প্রায় প্রতিটি প্রান্তে দিনের পর দিন উঠেছে ‘লাভ জেহাদ’-এর অভিযোগ। সবচেয়ে বড় ঘটনা ঘটেছিল গত ২৮ মে। যমুনোত্রীর বাসরাস্তায় পুরোলা নামের ছোট্ট জনপদ। সেখানে ওবেইদ নামে এক মুসলমান ও জিতেন্দ্র সাইনি নামে এক হিন্দু, দুই তরুণ মিলে স্থানীয় এক শিক্ষকের চোদ্দো বছরের মেয়ের সঙ্গে যাচ্ছিল। ‘লাভ জেহাদ’-এর রটনা রটে গেল, পর দিন থেকে পুরোলার মুসলিম ব্যবসায়ীদের উপর আক্রমণ, তাঁদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হল। ‘দেবভূমি রক্ষা অভিযান’ নামে এক উটকো সংগঠনের ব্যানার পড়ল, ১৫ জুনের মধ্যে পুরোলার মুসলিম দোকানিদের এলাকা ছাড়তে হবে। ৪২ জন মুসলিম দোকানদার প্রাণভয়ে দেহরাদূন ও অন্যত্র চলে গেলেন। পরে ঝুলি থেকে বেড়াল বেরোল। স্থানীয় এক সাংবাদিক ‘বিবিসি খবর’ নামে একটি ওয়েবসাইট চালান। বলা বাহুল্য, বিবিসি-র এই নামে কোনও ওয়েবসাইট নেই। কিন্তু অতিসক্রিয় সেই সাংবাদিক স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে থানায় লাভ জেহাদের অভিযোগ করলেন, তাঁর চ্যানেলের মাধ্যমে খবরটি ছড়ালেন। অন্য ব্লগ এবং চ্যানেলও সত্য না জেনে ধুনো ছড়াল। পুনম পাণ্ডের ক্যানসারের ঢের আগেই উত্তরাখণ্ডে দিনের পর দিন খবরের নামে ভুয়ো রটনা রটেছে, আমরা খেয়াল রাখিনি।

শুধু কি পুরোলা? বদ্রীর রাস্তায় গোচর থেকে আরম্ভ করে সর্বত্র লাভ জেহাদের ধুয়ো। শুধু সাংবাদিক নয়, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার কেউ বাকি নেই। কখনও কেউ ভিডিয়ো বার্তা ছড়াচ্ছেন উত্তরাখণ্ড এ বার কাশ্মীর হবে, কেউ আবার বলছেন, নাজিবাবাদের লোকের থেকে আনাজ কিনবেন না। সোশ্যাল মিডিয়াই যে ভুয়ো খবরের জন্মদাতা ও প্রচারকর্তা, আমরা জানি। কিন্তু পুষ্কর সিংহ ধামী কী করলেন? রটনাকারীদের উদ্দেশে ব্যবস্থা নয়, উল্টে বললেন, “লাভ জেহাদের এই দোষীদের কাউকে ছাড়া হবে না।”

লাভ জেহাদের ধুনো এত প্রবল যে, বিজেপির সংখ্যালঘু সেল-এর চেয়ারম্যানও পুরোলায় তাঁর দোকান বন্ধ করে পালিয়ে আসতে বাধ্য হন। গত মে মাসে পৌড়ী গাড়োয়ালের বিজেপি নেতা যশপাল বেনামের মেয়ের বিয়ে ছিল। ভাবী জামাই মুসলমান, আইআইটি রুড়কী-তে কন্যার সহপাঠী ছিল। বিয়ের কার্ড ছাপাও হয়ে গেল, কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ায় এমন হইচই শুরু হল যে, যশপাল মেয়ের বিয়ে স্থগিত রাখতে বাধ্য হলেন।

লাভ জেহাদেও শেষ হল না। অরণ্যবিস্তৃত উত্তরাখণ্ডে গত বছর শুরু হয়েছে ‘ল্যান্ড জেহাদ’ও। মানে, জঙ্গলের ভিতরে থাকা মাজার ও মন্দির সরিয়ে পরিবেশ রক্ষার খাতিরে অরণ্য পুনরুদ্ধার। জানা গেল, মন্দির বিশেষ ভাঙা পড়েনি। কিন্তু ৩২৩টি মাজার ইতিমধ্যে ভেঙে দেওয়া হয়েছে। এই জেহাদসর্বস্ব রাজ্যেরই তো তড়িঘড়ি অভিন্ন দেওয়ানি বিধি এনে নিজের অপদার্থতা আড়াল করার কথা! গত হরিদ্বার কুম্ভের সময়েও ধর্ম সংসদ দেশকে মুসলিমছাড়া করার বিধান দিল, সকলে নীরব থাকলেন। মায় প্রবল করোনাতেও সব নিষেধাজ্ঞা উড়িয়ে কুম্ভমেলা হল, তীরথ সিংহ রাওয়ত আর ত্রিবেন্দ্র সিংহ রাওয়তের মধ্যে কে মুখ্যমন্ত্রী হবেন, তা নিয়ে মোদী-শাহের দিল্লি দরবারে অনেক জল ঘোলা হল। তার পর থেকে বারংবার হরিদ্বারের কোনও না কোনও গেরুয়াধারী ভিডিয়ো বার্তায় দেশকে মুসলিমছাড়া করার বিধান দিয়েছেন। প্রশাসন গা করেনি।

অথচ, মল্লীতালে নৈনি মাতার বিখ্যাত মন্দিরের রাস্তায় সুন্দর এক মসজিদ, মসজিদ আছে লালকুঁয়াতেও। পাহাড়প্রেমী বাঙালি খবর রাখেনি, হরিদ্বার থেকে রুড়কীর রাস্তায় মিনিট দশেক গেলেই গঙ্গার ধারে ইব্রাহিম লোদীর আমলে তৈরি ঐতিহাসিক পিরান কালিয়া মাজার। হরিদ্বার মানে শুধু গঙ্গারতি, দাদা-বৌদির হোটেল আর মথুরাবালার পেড়া নয়।

এখন, উত্তরাখণ্ডের ২০ শতাংশ ব্রাহ্মণও সমসত্ত্ব নন। তাঁদের মধ্যে হরেক ভাগ। আছেন বনেদি সারোলা ব্রাহ্মণরা, আছে বহুগুণা, বার্থওয়াল, চান্দোলা, দাব্রল, গাঙ্গোয়াল, জোশী, পন্থ অনেক পদবি। গাড়োয়াল, কুমায়ুনের অশন-সংস্কৃতিও ভিন্ন। কুমায়ুনে বালেমেঠাই নামে একটি মিষ্টি পাবেন, গাড়োয়ালে নয়। প্রকৃতিও ভিন্ন। গাড়োয়ালের বৈশিষ্ট্য তার সবুজ তৃণভূমি বা বুগিয়ালে, কুমায়ুনে আবার লম্বা গাছ। পর্যটন ছাড়া দু’প্রান্তেই উল্লেখযোগ্য কোনও শিল্প নেই। গম, জোয়ার, বাজরা এবং লাল রামদানা চাষই একমাত্র ভরসা।

তবু গাড়োয়াল-কুমায়ুন নির্বিশেষে তরুণরা বছর কয়েক আগে একত্রে এক বারই ধামী সরকারকে ‘সবক’ শেখাতে পেরেছিল। তখন সেনাবাহিনীতে চার বছরের অস্থায়ী কাজের জন্য মোদী সরকারের অগ্নিবীর প্রকল্প এসেছে, কুমায়ুন থেকে গাড়োয়াল সর্বত্র জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে তরুণরা এমন বিক্ষোভ দেখাল যে, ধামী সরকার সকলের বিরুদ্ধে সরকারি সম্পত্তি ধ্বংসের মামলা তুলে নিতে বাধ্য হল। প্রকল্পটি মোদীজি তোলেননি, সে অন্য কথা। কিন্তু ‘ওয়ান র‌্যাঙ্ক ওয়ান পেনশন’ (ওরোপ)-এর দাবিতে এ মাসেও উত্তরাখণ্ডে অনশনরত এক অবসরপ্রাপ্ত সেনার মৃত্যু ঘটেছে।

বলা বাহুল্য, উত্তরাখণ্ডই ভারতের সেই রাজ্য, যেখানে সেনাবাহিনীর দু’টি বিখ্যাত হেডকোয়ার্টার্স। ল্যান্সডাউনে গাড়োয়াল রেজিমেন্ট, রানিখেতে কুমায়ুন রেজিমেন্ট। গঙ্গোত্রী গ্লেসিয়ার বা কেদারকাঁটায় ট্রেকিংয়ে গেলে সামরিক বাহিনী যে ভাবে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সাহায্যের হাত বাড়ায়, বাঙালি জানে। অগ্নিবীর, ওরোপ নিয়ে কাজের কাজ হল না। উল্টে লাভ জেহাদ প্রধান সমস্যা ভেবে অভিন্ন দেওয়ানি বিধিতে আঠারো বছরের সাবালিকাদেরও ‘শিশু’ গণ্য করা হল। প্রেমজ লিভ-ইনে মা-বাবার অনুমতি লাগবে, থানাকে জানাতে হবে। আসল গল্পটা তাই লাভ জেহাদ আটকাতে অতিসক্রিয়তা; অপদার্থ এক রাজ্য সরকারের ‘অভিন্ন দেওয়ানি বিধি’ নামক শেষ খড়কুটো আঁকড়ে ধরা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE