—প্রতীকী ছবি।
ভোট এসেছে। মেয়েদের সেই ভোটে বড় রকম ভূমিকা নেওয়ার সময়ও এসেছে তো? রাষ্ট্রপুঞ্জের ঘোষণা মতো ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বে সুস্থায়ী উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছতে গেলে, রাজনৈতিক ও নাগরিক জীবনে মেয়েদের সমান অংশগ্রহণ ও নেতৃত্ব দান অপরিহার্য। কিন্তু তাদেরই সমীক্ষা বলছে, বিশ্বে প্রায় সব স্তরেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার জায়গায় মেয়েদের প্রতিনিধিত্ব অত্যন্ত কম। সেই কারণে রাজনৈতিক জীবনেও লিঙ্গসাম্য এখনও সুদূরপরাহত। এবং সারা পৃথিবীতে ক্যাবিনেট মন্ত্রিসভায় মহিলাদের স্থান মাত্র ২২.৮%। ভারতের বর্তমান লোকসভা ও রাজ্যসভায় মহিলাদের প্রতিনিধিত্ব যথাক্রমে ১৫% ও ১৩%। তবে কিনা, দেশের সাংসদ ও বিধায়ক পদে মেয়েদের উপস্থিতি কম হলেও গত কয়েক বছরে দেখা যাচ্ছে, ভোট-রাজনীতিতে তাঁদের গুরুত্ব যেন হঠাৎই বেড়ে গেছে।
আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে মেয়েদের জন্য নানাবিধ আর্থিক ও সামাজিক সুবিধা দানের প্রতিশ্রুতিতে শাসক ও বিরোধী সব দলেই শুরু হয়ে গেছে প্রবল প্রতিযোগিতা। নিত্যনতুন অনুদান ও প্রকল্প ঘোষণায় মনে হচ্ছে, এ বার নারীর স্বশক্তিকরণ শীর্ষ ছুঁয়ে ফেলল প্রায়। বিগত কয়েক বছর ধরে ভোট দানে মহিলাদের লাইন ক্রমশই দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে— দেখে মনে হয় ভারতের মতো দরিদ্র দেশের মেয়েরা নিঃশব্দে বুঝি কোনও বিপ্লবই ঘটিয়ে ফেলছেন। কিন্তু এমন তো নয় যে, ঘরে বাইরে তাঁদের উপর অত্যাচারের মাত্রা কমেছে। কমেছে ধর্ষণ, বাল্যবিবাহ, শিশু ও নারী পাচারের মতো ঘটনাবলি। এমনও নয় যে, মেয়েরা সম মজুরি ও সমানাধিকার আদায় করে নিতে পেরেছেন।
এবং মুখ্য নির্বাচন কমিশনারের মতে, গত ৫ বছরে ২৩টি প্রধান রাজ্যে বিধানসভার নির্বাচনে অন্তত ১৮ রাজ্যে পুরুষদের তুলনায় মেয়েরা ভোট দিয়েছেন বেশি। ২০১৯ থেকে এ পর্যন্ত দেশে মহিলা ভোটার বেড়েছে ৯.৩%, যেখানে পুরুষ ভোটার ৬.৯% বেড়েছে। আর এসবিআই’এর রিপোর্ট বলছে, ২০২৯ থেকে দেশে মহিলা ভোটারের সংখ্যা পুরুষ ভোটারদের ছাড়িয়ে যাবে। ফলে, ক্ষমতা দখলের রাজনীতিতে মেয়েরা যে ক্রমশ একটা নিয়ন্ত্রক শক্তি হয়ে উঠছেন, তাতে আর সন্দেহের অবকাশ থাকছে না।
এবং ইতিমধ্যে কিছু রাজ্যে বেশি সংখ্যায় মহিলাদের ভোটদানই যে রাজনৈতিক পালাবদলে একটা বড় ভূমিকা নিয়েছে, সেটা দেশের নেতা, মন্ত্রীরা টের পেয়ে গেছেন। বুঝেছেন মহিলারাও। তাই নিজেদের শক্তিকে যেন আজ তাঁরা চিনতে পারছেন। আর সেই শক্তির কাঁধে ভর দিয়েই আত্মবিশ্বাসী, উৎসাহী নারীরা এখন অনেক বেশি করে ভোটের লাইনে দাঁড়াচ্ছেন। এবং সেই ‘নারী শক্তি’কে উপেক্ষা করার শক্তি দেশের শাসক ও বিরোধী কোনও দলেরই আর থাকছে না।
তাই ওই ‘অর্ধেক আকাশ’কে কী ভাবে নিজেদের অনুকূলে আনা যায়, তারই নিত্যনতুন কৌশল রচনায় সব দলই এখন তৎপর। ইতিমধ্যেই পশ্চিমবঙ্গের ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’, ‘কন্যাশ্রী’, ‘রূপশ্রী’ ইত্যাদি, কর্নাটকের ‘গৃহলক্ষ্মী’র মতো মহিলাকেন্দ্রিক প্রকল্প বা ডোল যে শাসক দলকে ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনার বড় হাতিয়ার হয়ে উঠেছে, তা এখন প্রমাণিত সত্য। মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, ছত্তীসগঢ়, তেলঙ্গানার সাম্প্রতিক রাজ্য নির্বাচনের ফলাফলেও এর প্রভাব পড়েছে। গত বিধানসভা নির্বাচনে শাসক দলকে, হইহই করে জিতিয়ে দিয়েছে মধ্যপ্রদেশের ‘লাডলি লক্ষ্মী যোজনা’, ‘লাডলি বহনা যোজনা’র মতো প্রকল্পগুলি। দেখা গেছে, যেখানেই মেয়েরা বেশি ভোট দিয়েছেন সেখানেই তাঁদের অনুকূলে সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
ঠিক এই কারণেই দেশের প্রায় সব রাজনৈতিক দলেরই এখন পাখির চোখ ওই মহিলা ভোটাররা। ক্ষমতায় এলে তাঁদের জন্য রাজ্যে রাজ্যে ডোলের পরিমাণ কে কত বাড়িয়ে দেবে, তাঁদের জন্য সরকারি চাকরিতে কারা ৫০% সংরক্ষণ-সহ নানা সুবিধার দুয়ার খুলে দেবে, দিকে দিকে সেই বার্তাই রটছে। তবে এটা মন্দের ভাল। কারণ কোনও না কোনও ভাবে মেয়েদের আর্থিক উন্নতি ঘটলে, পরিবারে, সমাজে তাঁর যে কিছুটা গুরুত্ব বাড়ে, কিছু সিদ্ধান্ত নিজেই নিতে পারেন— পশ্চিমবঙ্গের নানা গ্রামে স্বনির্ভর গোষ্ঠীর বহু মেয়ের মধ্যে তা প্রত্যক্ষ করেছি।
বস্তুতই ‘নারীর উপর বা মেয়েদের উপর বিনিয়োগ করলে উন্নয়ন গতি পায়’— এ বারের আন্তর্জাতিক নারী দিবসের এই থিমটির যেন প্রতিফলন দেখেছিলাম বর্ধমানের ভাল্কি গ্রামে। সেখানে অপার শক্তিতে মেয়েরা নিজেদের পরিবারে, পাড়া প্রতিবেশী তথা সমাজে, এমনকি গ্রামের ক্ষয়িষ্ণু প্রাকৃতিক পরিবেশেও কী ভাবে বদল ঘটাচ্ছেন, ভাল্কি যেন তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। মেয়েদের সেই শক্তি যে আজ রাজনীতিতেও গুরুত্ব পাচ্ছে, দেখে ভাল লাগছে ।
দেশের সংবিধানে নারী পুরুষ নির্বিশেষে সমানাধিকার থাকলেও তা আদায়ের পথটি কন্টকাকীর্ণ । তবে সেই কাঁটা-বিছানো পথে বিক্ষত পায়েই চলতে চলতে আজ মেয়েদের মধ্যে যেন এক অদৃশ্য জেদ তৈরি হয়েছে। সেই অনমনীয় জেদই নিজেদের ন্যায্য অধিকার আদায়ের দাবিতে যেমন রাজ্যের রাজপথে অমানুষিক পরিস্থিতিতেও বছরের পর বছর ধরে তাঁদের অবস্থানে শক্তি জুগিয়ে যাচ্ছে, তেমনই তাঁদের উপর নিয়ত ঘটতে থাকা অন্যায়, অত্যাচারের প্রতিবাদে, প্রতিরোধে মেয়েরা আজ ঝাঁটা, বঁটি হাতেই অত্যাচারী দল ও শাসকের বিরুদ্ধে পথে বেরিয়ে আসার সাহস দেখাচ্ছেন।
মেয়েদের সেই সাহস ও শক্তিকে তো কুর্নিশ জানাতেই হবে। শুধু পুজোমণ্ডপ ও মন্দিরেই নয়, তার বাইরেও আজ ‘নারীশক্তি’র জয়গান গাইতে হচ্ছে, এমনকি চরম পুরুষকারের ধ্বজাধারীদেরও। ঢোঁক গিলে হলেও তাঁরা তা গাইছেন। কারণ কে বলতে পারে, সেই শক্তির অপমান, অসম্মান আগামী সময়ে রাজনৈতিক পালাবদলের প্রধান অস্ত্র হয়ে উঠবে না?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy