E-Paper

ইতিহাসের নামে অপপ্রচার

নাগাল্যান্ডে খ্রিস্টান মিশনারিদের কাজ সম্পর্কে এই ছিল ভেরিয়ারের নিরপেক্ষ ধারণা। এর পরেও যদি নাগাল্যান্ডে খ্রিস্টানদের সংখ্যা বাড়ে তা হলে তা বিদেশি মিশনারিদের জন্য নয়, দেশি মিশনারিদের কারণে।

পঙ্কজ কুমার চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১১ অক্টোবর ২০২৩ ০৫:৫০
Verrier Elwin

ভেরিয়ার এলউইন। —ফাইল চিত্র।

ভেরিয়ার এলউইন সম্পর্কে অসমের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্তবিশ্ব শর্মা-সহ অনেকেই ভুল তথ্য প্রচার করে চলেছেন। ভেরিয়ারের বিরুদ্ধে উত্তর-পূর্ব ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে জওহরলাল নেহরুর সহযোগিতায় খ্রিস্ট ধর্মে ধর্মান্তরণের অভিযোগ আনছেন।

বিষয়টি সংবেদনশীল এবং গুরুতর। তাই, ভেরিয়ারের কর্মকাণ্ডের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দেওয়া ভাল। রামচন্দ্র গুহ তাঁর বইতে জানিয়েছেন নৃতত্ত্ববিদ, সমাজকর্মী, লেখক ভেরিয়ার এলউইন খ্রিস্টান যাজক হলেও যে জনজাতির মধ্যে কাজ করেছেন তাদের ধর্মান্তরণে অস্বীকৃত হয়েছিলেন। ভেরিয়ার খ্রিস্ট এবং হিন্দু ধর্মের মধ্যে সমতুল্য দিকগুলি বিশ্লেষণ করেছেন। জীবনের শেষ প্রান্তে তিনি বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হন। এলউইন দেখিয়েছেন, ভারতের জাতীয়তাবাদীরা জনজাতির সমস্যা নিয়ে ভাবেননি। বরং চেষ্টা করেছেন কী ভাবে এঁদের হিন্দুত্বের বৃত্তে আনা যায়।

কর্মসূত্রে ১৯২৭-এ ভেরিয়ারের ভারতে পদার্পণ। গান্ধীজির ‘সব ধর্মই এক’ উক্তিতে, নেহরুর আদর্শে প্রভাবিত, জনজাতির মানুষদের উন্নতিতে কাজের সিদ্ধান্ত নেন। বাধা দেয় তাঁর পরিবার, ধর্ম, ব্রিটিশ সরকার। নিজের ধর্ম ত্যাগ করেন আনুষ্ঠানিক ভাবে। দু’দশক বস্তার অঞ্চলে জনজাতি মানুষদের সঙ্গে থাকেন। জনজাতির মহিলা কোসিকে বিয়েও করেন। মুরিয়া, মারিয়া, আগারিয়া, বাইগা প্রভৃতি জনজাতিদের ধর্মাচার, লোকসংস্কৃতি ইত্যাদি সঙ্কলিত করে বই লেখেন।

তিনি ওড়িশাতেও জনজাতির উন্নয়নে কাজ করেন। ১৯৫৪-য় প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু সীমান্তের জনজাতিগত সমস্যার নিরসনের জন্য ভেরিয়ারকে উত্তর-পূর্ব সীমান্ত এজেন্সি বা নেফা-র নৃতাত্ত্বিক পরামর্শদাতা নিয়োগ করেন। এই অঞ্চলের সঙ্গে তিব্বতের সীমারেখা ছিল অস্বচ্ছ, হিমালয় এবং ভয়ঙ্কর ব্রহ্মপুত্র ও বনাঞ্চলের কারণে তিব্বত, ভারত কারও প্রশাসন প্রায় ছিলই না। অঞ্চলটির উপর ভারতের অধিকার প্রতিষ্ঠায় নেহরু প্রয়াসী ছিলেন, নতুবা অরুণাচলের উপর চিনের দাবির বিরোধিতা অসম্ভব হত। এলাকার প্রশাসনিক উন্নতিকল্পে ভেরিয়ার নেহরুর কাছে ‘ইন্ডিয়ান ফ্রন্টিয়ার অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস’ (আইএফএএস) প্রবর্তনের সুপারিশ করেন। প্রথম আইএফএএস অফিসারদের অন্যতম বব খাথিং তাওয়াং-এর উপর ভারতের সার্বভৌম কর্তৃত্ব নিশ্চিত করেন। ভেরিয়ার এখানে তাঁর অভিজ্ঞতা এবং জনজাতিগুলির সংস্কৃতি বিষয়ে লেখেন আ ফিলজ়ফি ফর নেফা। বইটি অরুণাচলের প্রশাসনিক কাজে নীতিনির্দেশিকা হওয়ার যোগ্য।

এই তথ্যগুলি জানলে কি তাঁর বিরুদ্ধে উত্তর-পূর্ব ভারতের জনজাতিদের ধর্মান্তরণের অভিযোগ টেকে? ভেরিয়ার গভীর উপলব্ধির সঙ্গে এবং নিরপেক্ষতার সঙ্গে জনজাতি ইতিহাস লিখেছিলেন, তাদের সঙ্ঘবদ্ধ করেছিলেন। নাগাল্যান্ড সফর করে তাঁর যে বই, তাতে আছে— ভারত সরকার নাগাল্যান্ডে কঠোর নিরপেক্ষ নীতি নিয়েছিল যে— ধর্মের আচার ও প্রচারের বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা হবে না। সরকারি প্রতিষ্ঠান, বিদ্যালয় ধর্মপ্রচারের কাজে ব্যবহৃত হবে না। বহুধর্মাবলম্বী দেশে এই আইনগুলি অপরিহার্য, যেখানে কোনও একক ধর্মের প্রতি সরকারি সমর্থন অশান্তির সৃষ্টি করবে।

নাগারা এখন মনে করে যে তারা বিদেশি মিশনারিদের সাহায্য ছাড়াই নিজেরা চার্চের কাজ পরিচালনা করতে পারে।... কিছু আমেরিকান মিশনারি নাগাল্যান্ড ঘুরে বলেছেন তাঁরা দেখেননি যে খ্রিস্টান মিশনারি বেশি স্বাধীনতা পাচ্ছেন এবং উন্নতি করছেন। ১৯৪৭-এ নাগা হিলস ডিস্ট্রিক্ট-এ আধ ডজন বিদেশি মিশনারি ছিলেন। তাঁদের মাত্র এক জনকে দেখেন।

নাগাল্যান্ডে খ্রিস্টান মিশনারিদের কাজ সম্পর্কে এই ছিল ভেরিয়ারের নিরপেক্ষ ধারণা। এর পরেও যদি নাগাল্যান্ডে খ্রিস্টানদের সংখ্যা বাড়ে তা হলে তা বিদেশি মিশনারিদের জন্য নয়, দেশি মিশনারিদের কারণে। ভেরিয়ার উত্তর-পূর্ব ভারতে বেশিরভাগ সময় কাটান বর্তমান অরুণাচল প্রদেশে। ১৯৬১-র পরে নাগাল্যান্ড সফর করেন। নেহরুর মতো ১৯৬৪-তেই তাঁরও মৃত্যু। তাই অসম, মিজ়োরাম এবং মণিপুরে তাঁর উপস্থিতির সম্ভাবনাই নেই।

মণিপুরে হিংসা এবং সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার মোকাবিলায় ব্যর্থতার পর এক মৃত ব্যক্তির উপর দোষ চাপানোর অভিপ্রায়েই কি তা হলে ভেরিয়ারের বিরুদ্ধে এত অপ্রমাণযোগ্য অভিযোগ? যুক্তির খাতিরে যদি ধরাও যায় ভেরিয়ার মণিপুরে গিয়েছিলেন, তা হলে তাঁর মৃত্যুর পরেও কেন সেখানে দ্রুত হারে খ্রিস্টান সংখ্যা বেড়েছে? নিশ্চয়ই ব্যাপক হারে ধর্মান্তরণ হয়েছে। তবে অধ্যাপক অমিতাভ কুন্ডুর ধারণা এর অন্যতম কারণ নাগাল্যান্ড, মিজ়োরাম এবং অবৈধ ভাবে মায়ানমার থেকে ক্রমাগত অনুপ্রবেশ।

২০১১-য় মণিপুরে হিন্দুরা ছিল জনসংখ্যার ৪১.৩৯%। এর মধ্যে সানামাহি প্রাকৃতিক ধর্মাবলম্বীরা ৮.১৯%। সানামাহিরা নিজেদের হিন্দুদের থেকে পৃথক মনে করে। পরের জনশুমারি থেকে সানামাহিদের আলাদা ভাবেই হিসাব হবে। তা হলে বর্তমানে হিন্দু জনসংখ্যা খ্রিস্টান জনসংখ্যার (৪১.২৯%) চেয়ে অনেক কম। সানামাহিদের আন্দোলনটি অনেক আগে থেকেই চলছে। তবে তা জোরালো হয় ১৯৪১ থেকে।

অতএব, হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যা নিয়ে শঙ্কিত হলে তার অন্যান্য কারণও খুঁজতে হবে। মানুষের দৃষ্টি ভুল দিকে ঘুরিয়ে দিলে মণিপুর সমস্যা মিটবে না।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Society

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy