যা কাণ্ডজ্ঞান দিয়ে বোঝা যায়, তাকে দুর্বোধ্য করে তোলাই শাসনের রাজনীতি। তাই, উদ্বাস্তুদের নাগরিকত্বের মতো একটি সহজ, মানবিক ও সংবেদনশীল বিষয় নিয়ে প্যাঁচ কষে, রস নিংড়ে তৈরি হল ২০১৯-এর নাগরিকত্ব আইন। শাসকের বুদ্ধির সঙ্গে সাধারণের কাণ্ডজ্ঞানের সংঘাত অনিবার্য হয়ে উঠল। নাগরিকত্ব আইন নিয়ে ভারতবর্ষ আগে কখনও এমন দেখেনি।
দুর্ভাগ্যজনক বাস্তব হল, এর কেন্দ্রস্থলে এসে দাঁড়িয়েছে বাঙালি উদ্বাস্তু প্রসঙ্গ। অস্বীকার করার উপায় নেই যে, দেশবিভাগই এর উৎস। মৌচাকে ঢিল ছুড়ে দাঁড়িয়ে থাকতে বলা, আর ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগ করে স্ব-স্ব স্থানে থাকতে বলায় প্রভেদ কিছু নেই। সে পরামর্শ না শুনে পঞ্জাব নিজেকে রক্তাক্ত করেছিল। পরামর্শ শুনে বাংলা আজও উদ্বাস্তু সমস্যায় জেরবার। তবে ভারতবর্ষ শুধু পাকিস্তান ও বাংলাদেশের উদ্বাস্তু নিয়ে বিব্রত হয়নি, আরও দুই প্রতিবেশী বর্মা (মায়ানমার) ও শ্রীলঙ্কার লক্ষ লক্ষ উদ্বাস্তুর দায়ও বহন করেছে। শেষোক্ত দু’টি দেশ ১৯৪৮-এ স্বাধীন হয়ে ভারতীয় বংশোদ্ভূতদের বিতাড়নে সচেষ্ট হয়। বলা বাহুল্য, মায়ানমার ও শ্রীলঙ্কা কিন্তু মুসলিম-অধ্যুষিত দেশ নয়। ভারত সরকার এই দুই দেশের উদ্বাস্তুদের স্বাভাবিক নাগরিক হিসেবে গ্রহণ করেছে। সন্দেহ নেই, প্রতিবেশী দেশগুলির দুর্বল গণতন্ত্র ও প্রগতিশীল নেতৃত্বের অনুপস্থিতি উদ্বাস্তু সমস্যাকে আজও জিইয়ে রেখেছে।
খণ্ডিত ভারতের অপর অংশ থেকে আসা মানুষদের জন্য দুয়ার উন্মুক্ত রাখা অপরিহার্যই ছিল। ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইনে তার সহজ সংস্থানও ছিল। ১৯৮৬ সালের সংশোধনীতে সে অধিকার কিছুটা সঙ্কুচিত হয়। শেখ মুজিবের নৃশংস হত্যার পর পুনরায় বাংলাদেশ থেকে উদ্বাস্তু এলেও সরকার নির্লিপ্তই ছিল। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়কার শরণার্থীদের নাগরিকত্ব না দেওয়ার নির্দেশ, যদিও তা কোনও আইন নয়, এ সময়েও মেনে চলার চেষ্টা হয়। শিক্ষিত সচেতন উদ্বাস্তুরা আইনি পথে নাগরিকপত্র ও জীবিকা খুঁজে নিতে পারলেও, বঞ্চনার শিকার হয় সাধারণ পরিবারগুলি।
দুর্ভোগ চরমে ওঠে ২০০০ সাল থেকে। কেন্দ্রে তখন এনডিএ সরকার। উত্তরাখণ্ডের দীনেশপুর-রুদ্রপুর অঞ্চলে পুনর্বাসনপ্রাপ্ত বাঙালি পরিবারের ছাত্র-ছাত্রীদের ডোমিসাইল সার্টিফিকেট ব্যতিরেকে স্কুল-কলেজে ভর্তি নিতে অস্বীকার করা হয়। ওড়িশার কেন্দ্রপাড়ার মহাকাল ব্লকে ১৫৫১ জনকে দেশত্যাগের নোটিস ধরিয়ে দেওয়া হয়। আন্দামানে কৃষকের ফসলের খেত ও বাগান ধ্বংস করা হয়। মহারাষ্ট্র, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তীসগঢ়ের পুনর্বাসনপ্রাপ্ত কিছু গ্রাম আক্রান্ত হয়। এরই মধ্যে অশনি সঙ্কেত নিয়ে উপস্থিত হয় ২০০৩-এর নাগরিকত্ব আইন। পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূলের পাশাপাশি বিজেপিও এ সময় প্রশ্ন তোলে, বাংলাদেশিদের নাম কেন ভোটার তালিকায়? অতঃপর নদিয়া, বর্ধমানের নানা গ্রামে পুলিশি অভিযান শুরু হয়।
ভারতের নাগরিকত্ব আইন ২০০৩, সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমী এক পদক্ষেপ। এর আগে কাউকে নাগরিকত্ব হারাবার ভয় পেতে হয়নি। এ বার হল, কারণ, এই আইনেই প্রথম ‘ইললিগাল মাইগ্রান্ট’ শব্দটি প্রযুক্ত হয়। বলা হয়, বৈধ অনুমতিপত্র বা ভিসা ইত্যাদি নিয়ে যাঁরা ভারতে প্রবেশ করেননি, তাঁরা সকলেই অনুপ্রবেশকারী। তাঁরা নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করার যোগ্য হবেন না। এমনকি, তাঁদের সন্তান এ দেশে জন্মালেও নাগরিকত্ব পাবেন না। আইনানুসারে ১৯৪৮ সালের ১৯ জুলাইয়ের পরে আসা সকলেই এর আওতাভুক্ত।
এই ভাবে আইন বিষয়ে সাধারণের অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে, চল্লিশ-পঞ্চাশ বছর ধরে ভোট দিয়ে সরকার গঠন করা নাগরিকদেরও অনিশ্চয়তার মুখে ঠেলে দেওয়া হল। ভুলে যাওয়া হল দেশভাগের সময়কালে দেওয়া প্রতিশ্রুতি।
ভাবতে অবাক লাগে যে, এই আইনটি এমন দু’জন মানুষের হাত ধরে এসেছে, যাঁদের এক জন পশ্চিম পাকিস্তানের উদ্বাস্তু; অন্য জন বাংলার উদ্বাস্তুদের সহযোদ্ধা। উদ্বাস্তুদের বাস্তব পরিস্থিতি জেনেও এমন নির্মম একটি সিদ্ধান্ত কী ভাবে নিতে পারলেন আডবাণী এবং বাজপেয়ী? প্রথমে রাজ্যসভায় আইনটি উত্থাপিত হলে, তৎকালীন বিরোধী দলনেতা মনমোহন সিংহ এবং প্রাক্তন সেনাপ্রধান শঙ্কর রায়চৌধুরী পূর্ববাংলার হিন্দু উদ্বাস্তুদের নাগরিকত্ব প্রদানের দাবি তোলেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দাবির সঙ্গে সহমত হয়ে আইনে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন করে নেবেন এমন প্রতিশ্রুতি দিলে সর্বসম্মতিতে বিলটি পাশ হয়। আডবাণী যে শেষ পর্যন্ত কেন তাঁর প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পারেননি, আজও তা এক রহস্য।
এই আইনে পশ্চিম পাকিস্তানি উদ্বাস্তুদের যেটুকু ক্ষতির সম্ভাবনা ছিল, তার খানিকটা তাঁরা পুষিয়ে দেন ২০০৪ সালে একটি স্বতন্ত্র রুল জারি করে। ওই রুলের ভিত্তিতে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে যে সব হিন্দু পরিবার রাজস্থান ও গুজরাতের নির্দিষ্ট ছ’টি জেলায় আশ্রয় নিয়েছেন এবং পাঁচ বছর সেখানে বসবাস করছেন, তাঁদের নাগরিকত্ব দেওয়ার কথা বলা হয়। আশ্চর্যজনক ভাবে বাংলার উদ্বাস্তুদের জন্য এমন ভাবনা থাকে না। উল্টে, তাঁদের ঘুম কেড়ে নেয় নয়া আইনে এনআরসি এবং এনপিআর করার পরিকল্পনা। এক দিকে নাগরিকত্ব হরণ, অন্য দিকে বেনাগরিক চিহ্নিতকরণ। এই দ্বিবিধ কৌশলের বিরুদ্ধে তাঁরা পথে নামেন। রাজনীতিকরা নিষ্ক্রিয় থাকলেও পাশে এসে দাঁড়ান মতুয়া নেতৃবৃন্দ।
২০০৩-এর উদ্বাস্তু-বিরোধী আইনকে সামান্য সংস্কার করা হল ২০১৯ আইনে। বলা হল, আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ থেকে আসা হিন্দু বৌদ্ধ শিখ জৈন পার্সি খ্রিস্টান মানুষ যাঁরা ৩১ ডিসেম্বর ২০১৪-র আগে ভারতে এসেছেন, এবং কেন্দ্রীয় সরকার যাঁদের ১৯২০’র পাসপোর্ট আইন ও ১৯৪৬-এর বিদেশি আইনে ছাড় দিয়েছে, তাঁরা অবৈধ অনুপ্রবেশকারী বলে গণ্য হবেন না। কাদের ছাড় দেওয়া হয়েছে? সংসদীয় কমিটির পর্যবেক্ষণ, ধর্মীয় কারণে দেশছাড়া ও দীর্ঘমেয়াদি ভিসায় থাকা তেমন ব্যক্তির সংখ্যা ৩১৩১৩। তা হলে বাকিদের কী হবে? ধর্মীয় কারণই যখন শর্ত, তখন ২০১৪-ই বা শেষ সীমা কেন?
উদ্বাস্তুরা এত আইনের মারপ্যাঁচ চাননি। তাঁরা অসমের জন্য প্রযোজ্য ৬এ(২) ধারানুসারে ১৯৬৬ সালের ভোটার তালিকায় নাম থাকা সকলকে যেমন ভারতের নাগরিক গণ্য করা হয়েছে, তেমন সরল আইন প্রত্যাশা করেছিলেন। কারণ, তাঁরাও অখণ্ড ভারতের অধিবাসী; দেশ ভাগাভাগিতে রাষ্ট্রহারা হয়ে যেতে পারেন না। তাঁদের প্রশ্ন, এই আইন যদি উদ্বাস্তুদের মুশকিল আসান হয়, তা হলে অসমে ১৪ লক্ষ হিন্দু বাঙালি এনআরসি তালিকার বাইরে কেন, আর কেনই বা তাঁদের ঠাঁই ডিটেনশন ক্যাম্পে? ভোটের আগে প্রতিশ্রুতি দিয়েও প্রধানমন্ত্রী কেন ডিটেনশন ক্যাম্প তুলে দিতে পারলেন না? কারও কাছেই এর কোনও সদুত্তর নেই।
২০১৯ সালেও মোদী সরকার পশ্চিম পাকিস্তানি উদ্বাস্তু খুঁজে খুঁজে জম্মুতে পুনর্বাসন দিয়েছে (আবাপ ১০.১০.২০১৯)। এই সহানুভূতি দেশের পূর্বপ্রান্তেও বর্ষিত হবে না কেন? পূর্ববঙ্গের উদ্বাস্তু বাংলাভাগের অসমাপ্ত অধ্যায়। ভাগ যখন আমরা মেনেছি, ভাগফলকেও মেনে নিয়ে মর্যাদার সঙ্গে তাঁদের স্থান করে দিতে হবে।
বন্ধ করতে হবে মানুষকে সন্ত্রস্ত করার রাজনীতি। ‘দুই কোটি অনুপ্রবেশকারী’, ‘উইপোকা’দের খুঁজে খুঁজে দেশ থেকে বিতাড়নের হুঙ্কার ছাড়েন যখন অমিত বলশালী নেতারা; কিংবা আধার কার্ড-ভোটার কার্ড কোনও কিছুই নাগরিকত্বের প্রমাণ নয় বলেন, তখন শুধু মতুয়া বা মুসলিম নয়, লাখখানেক তামিল উদ্বাস্তু, বনাঞ্চলের আদিবাসী এবং ভূমিহীন নিরক্ষর, সকল মানুষই শঙ্কিত হন।
অসমের দৃষ্টান্ত থেকে বলা যায়, এই আইন নিয়ে যাঁরা উল্লসিত, তাঁরাও নিষ্কৃতি পাবেন না। কারণ, ‘কাগজ’ তাঁদের কাছেও নেই। এই কৃত্রিম সঙ্কট থেকে মুক্তির উপায় খোঁজার দায় তাই সকলেরই।