Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

মহিলাদের দেখে রাষ্ট্র ঘাবড়েছে

ভারতের প্রধান বিচারপতি জানতে চেয়েছেন, কেন সিংঘু-টিকরি সীমান্তে মহিলাদের লড়াইয়ের ময়দানে রাখা হয়েছে?

উর্বা চৌধুরী
শেষ আপডেট: ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ০৪:৫৭
Share: Save:

লিঙ্গবৈষম্যের জলবায়ুতে মহিলাদের ট্র্যাক্টরে চেপে বসার ছবির ভার রাষ্ট্রের পক্ষে বইতে পারা কঠিন। মহিলাদের হাতে স্টিয়ারিং-এর ছবির ধার সইতে পারা তো প্রায় অসম্ভব! এই দামাল বাস্তব ছবিগুলির ভার ও ধারই সম্ভবত রাষ্ট্রের নির্বুদ্ধি সত্তাটিকে টেনে বার করে আনে। যে মাটিতে মহিলাদের জন্মাতে পারাটুকুও নিশ্চিত করতে হয় আইন করে, সেই ভারতবর্ষের মাটিতে প্রখর শীতে, খোলা আকাশের নীচে অগুনতি মহিলা দাপিয়ে বেড়াবেন ‘কৃষক’ পরিচয়ের সম্ভ্রমে, আর রাষ্ট্র সেই ছবি দেখে ঘাবড়াবে না, এ হতে পারে না। আবার এ-ও ঠিক যে, অন্তঃসারশূন্য দাম্ভিক রাষ্ট্র নিজের ঘাবড়ে যাওয়া চেহারাটিকে সব সময় স্পর্ধা দিয়ে ঢাকতে পারে না, ঢাকতে হয় অতিনাটকীয় বিনয় দিয়েও।


ভারতের প্রধান বিচারপতি জানতে চেয়েছেন, কেন সিংঘু-টিকরি সীমান্তে মহিলাদের লড়াইয়ের ময়দানে রাখা হয়েছে? এ সমাজের ‘পিতৃকুল’ যেন উৎকণ্ঠায় কেঁপে উঠছে মহিলাদের ‘নড়বড়ে’ শরীরের যুঝতে পারার শক্তি নিয়ে! কেন? এ দেশের মহিলাদের বালতি ভরে জল টানতে, কোমর ঝুঁকিয়ে আস্ত উঠোন নিকোতে, কাঁখে-মাথায় কলসি বা ইট বইতে, পিঠে বাচ্চা বেঁধে পাথর কাটতে, শীতের রাতে গাদা বাসনকোসন মাজতে, খনি খাদানে খেটে চলতে, রোদে তেতে খেতে কাজ করতে, হাঁটু মুড়ে বসে দৈনিক পাঁচ বাড়ির ঘর মুছতে, ডজন ডজন পেটের জন্য রান্না নামাতে, কোদাল দিয়ে মাটি কাটতে, আট-দশটা বাচ্চা বিয়োতে, একের পর এক গর্ভপাতে বাধ্য হতে, দু’বেলা মার খেয়েও বেঁচে থাকতে, বিক্রি হয়ে গিয়েও টিকে থাকতে, গণধর্ষণের ধকল সামলে আদালতে সোজা হয়ে দাঁড়াতে, গৃহহিংসার বিরুদ্ধে একজোট হয়ে তেড়ে যেতে, অ্যাসিডে-আগুনে পোড়া শরীর নিয়েও হেসে লুটোতে— এই রাষ্ট্র দেখেনি? দৈনিকের এই যে ঘটনাগুলিকে খালি চোখে দেখা যায়— তা বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানসম্মত সিদ্ধান্তে পৌঁছোনোর মতো লায়েক হয়নি রাষ্ট্র? এত কিছু দেখেও রাষ্ট্রের চৈতন্য হয়নি যে, মহিলাদের শরীরের গড়ন নিয়ে কেবলই কাব্য করা চলে না, ওটিকে সমঝেও চলতে হয়?


আর এক আজন্ম-কৈশোরে চোবানো প্রশ্ন হল: মহিলাদের কেন ‘রাখা হয়েছে’? শ্রমজীবী মহিলার ঘামের দাম কত, সেই আঁক কষে দিতে কোনও পুরুষ পণ্ডিত লাগে না। গোটা হিসাবটিই কষা থাকে তাঁর নিজের মগজে। কোন ফসল বছরে ক’বার ফলবে, তা বেচবে কে, কাকেই বা তা বেচা হবে, তার ন্যূনতম সহায়ক দাম কেন কষে বুঝে পেতে হবে, চাল-ডাল-পেঁয়াজের মতো পণ্যকে অত্যাবশ্যক পণ্য তালিকা থেকে কেন বাদ রাখা চলবে না, কালোবাজারি মানে কী, ফড়েদের দৌরাত্ম্য কাকে বলে, মান্ডি কেন জরুরি, কর্পোরেটদের ফাটকাবাজি ঠিক কতটা ভয়ানক হতে পারে— মহিলা কৃষকদের পক্ষে সে সব বুঝে ফেলা কঠিন নয়। সর্বোপরি, এ দেশের বেশির ভাগ মহিলাই হলেন ‘জাত-শ্রমিক’। শ্রমের মজুরির কিছুটা বা পুরোটা ফাঁকি দিলেও, তাঁরা শ্রমিকই। ধনতান্ত্রিক বন্দোবস্তে ঘরে-বাইরে পুঁজির, উৎপাদনের, শ্রমশক্তির, মুনাফা লুটের, এবং শ্রমচুরির যত রকমফের হয়, তা চামড়ায় সয়ে বাঁচেন তাঁরা। হকের সঙ্গে জুয়াচুরি হলে, তাঁদের যে স্টিয়ারিং হাতে নিতেই হবে, এমনকি সাধারণতন্ত্রের অ-কৃষক নাগরিক হিসেবেও যে অন্যায়ের বিরুদ্ধে তাঁদের স্পষ্ট লব্জে প্রতিবাদ করতেই হবে— সে কথা তাঁরা খুব জানেন। তাই লড়াইয়ের ময়দানে ‘রাখার জন্য’ বাপবেটার রায়ের প্রয়োজন তাঁদের পড়ে না।


আশ্চর্য বোধ এই সমাজকাঠামোর! এখানে মহিলাদের সমতার অধিকার মায় যে কোনও বুনিয়াদি অধিকার সুনিশ্চিত করাকে মনে করা হয় ‘সুযোগ দেওয়া’। অথচ, সত্যটি বেজায় ভিন্ন— পিতৃতন্ত্র যে হেতু কেবলই শোষক নয়, যে হেতু সে আহাম্মকও বটে— তাই তার রিপুতাড়িত নিরেট মাথার বদ-অভ্যাস হল অন্যের পাত থেকে ছিনিয়ে খাওয়া। আর সেই বদ-অভ্যাসে বল্গা দিয়ে সমাজে হাতের পাঁচ শান্তিটুকু বজায় রাখতে, উৎপীড়িতের সমতার অধিকার সুনিশ্চিত করার কসম খেতে হয় আইনসভাকে, আদালতকে। যত এই কসমের তামাশা দেখি, তত কৌতূহল হয় পৌরুষের ভাবগতিক নিয়ে— তার সদা-বিবস্ত্র পেশি নয়, কৌতূহল হয় তার মেধা নিয়ে— আর কত কাল কাটবে এ ভাবে, মেধাহীনতার গৌরবে?


ঝোঁক সুবিধার নয়— শাহিন বাগের আন্দোলনকারী মহিলাদের তেজ, বা হরিয়ানার বিশ হাজার আশাকর্মীর পনেরো দিনের বিক্ষোভ অবস্থানের পর স্বাস্থ্যমন্ত্রীর বাড়ি ঘেরাওয়ের মতো প্রখর দৃশ্যগুলি দেখার পর হাঁটু কাঁপছে বিজেপি চালিত এনডিএ সরকারের। ভ্রূণের লিঙ্গ নির্ধারণের আইন শিথিল করার চেষ্টা, কাশ্মীরের মেয়েদের তুলে এনে বিয়ে করার বা বাল্যবিবাহ চালু করে দেওয়ার বুলি ওড়ানো ফ্যাসিবাদী শক্তির নীল নকশাগুলির তালছন্দ কাটছে। মরিয়া হয়ে যে কোনও শোষণকেই আইন বানিয়ে ফেলার পদক্ষেপ করছে সে। আশঙ্কা হয় এই ভেবে যে, পিতৃতন্ত্রের এই বিনয়ের পরিণতিতে ‘মহিলাদের কেন রাখা হয়েছে’ প্রশ্নটি অকস্মাৎ ‘মহিলাদের রাখা যাবে না’-তে পরিণত হবে কি না! তবে টিকে থাকার লড়াই একপাক্ষিক নয়— শোষিত মানুষ ছায়ার সঙ্গে লড়ে চলে না, শোষককেও তার সঙ্গে লড়ে মরতে হয় বাধ্যত।


শ্রমজীবীর সামাজিক গোষ্ঠীগত বৈচিত্রই তার শক্তি, যে শক্তি ভারতকে আপাদমস্তক একরঙা গেরুয়া কাপড়ে ঢেকে যেতে দেয় না। সিংঘু-টিকরি সীমান্ত গত দু’মাস ধরে আমাদের দেখাচ্ছে, কী ভাবে কার্যত লিঙ্গায়ন ঘুচে যায় ‘কৃষক’ শব্দটির, কী ভাবে লিঙ্গায়ন ঘুচে গেলে ‘রাষ্ট্র’-কে বেকুব দেখায় অপ্রতিরোধ্য ‘দেশ’-এর মানুষের সামনে।

প্রতীচী ইনস্টিটিউট

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE