E-Paper

চুপ থেকে মেনে নিতেন না

জালিয়ানওয়ালা বাগ হত্যাকাণ্ডের কিছু পরে, ১৯২০ সালে রবীন্দ্রনাথ ইংল্যান্ড যাত্রা করেন। জাহাজ-যাত্রায় এক ঘটনা ঘটে।

রিমি মুৎসুদ্দি

শেষ আপডেট: ১১ মে ২০২৩ ০৪:৩৯
An image of Rabindranath Tagore

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সে সময়ে কোনও রাজনৈতিক পরিচয় ছিল না। ফাইল ছবি।

জালিয়ানওয়ালা বাগ হত্যাকাণ্ডে শাসকের বর্বরতা সমস্ত দেশকে স্তব্ধ করে দিয়েছিল। ভারতীয় রাজনৈতিক নেতারা শাসকের ভয়ে ভীতই ছিলেন। প্রত্যক্ষ প্রতিবাদে কোনও প্রথম সারির নেতাকেই দেখা যায়নি। রাজনৈতিক কোনও দল বা কর্মকাণ্ডের সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ না থাকা সত্ত্বেও এই নৃশংস হত্যালীলার বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদটি উচ্চারিত হয়েছিল এক কবির কলম থেকেই। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সে সময়ে কোনও রাজনৈতিক পরিচয় তো ছিলই না, বরং এলিটিজ়মের একটা মিথ্যে নিন্দা তত দিনে তাঁর সাহিত্যকীর্তিকে ঘুরে ফিরতে শুরু করেছিল।

জালিয়ানওয়ালা বাগ হত্যাকাণ্ডের কিছু পরে, ১৯২০ সালে রবীন্দ্রনাথ ইংল্যান্ড যাত্রা করেন। জাহাজ-যাত্রায় এক ঘটনা ঘটে। বম্বেতে তখন ঘাটের খালাসিরা ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে। প্রস্তাবিত ধর্মঘটের আগেই জাহাজটি যেন বন্দরে পৌঁছে যায় সেই লক্ষ্যে অতিরিক্ত মজুরির লোভ দেখিয়ে স্টোকারদের এত বেশি পরিশ্রম করানো হয়েছিল যে, অতিরিক্ত শ্রম ও দারুণ উত্তাপ সহ্য করতে না পেরে এক জন স্টোকার ইঞ্জিন-ঘরের সামনেই মারা যান। কবিমন সহজে মেনে নিতে পারে না ঘটনাটি। বিলাতযাত্রীর পত্র-তে লেখেন, “...খনি-কারদের বলি না দিলে খনি থেকে কয়লা ওঠে না, স্টোকারদের বলি না দিলে জাহাজ সমুদ্র পার হয়ে খেয়াঘাটে পৌঁছয় না...।”

জাহাজে প্রথম শ্রেণির যাত্রীদের স্বাচ্ছন্দ্য ও ‘নিম্নশ্রেণি’র যাত্রীদের ভিড়ে ঠাসা দমবন্ধ অবস্থা তাঁকে বিচলিত করেছিল। এই সমস্ত ঘটনা ও দৃশ্য রবীন্দ্রনাথকে ধনতান্ত্রিক সভ্যতার ‘প্রকৃতি ও পরিণতি’ বিষয়ে গভীর ভাবে ভাবায়। এই ভাবনার প্রতিফলন তাঁর বিভিন্ন চিঠিতে পাই। তিনি লেখেন, “সমষ্টি এবং ব্যষ্টির যোগেই বিশ্বজগৎ। সমষ্টির খাতিরে ব্যষ্টিকে যদি অত্যন্ত বেশি সঙ্কুচিত হতে হয়, তাতে সমষ্টির যথার্থ উৎকর্ষ হয় না। এতে শক্তির স্বভাব প্রকাশ পায়। ...প্রভূত নরবলির উপরে মানুষের রাষ্ট্র ও সমাজধর্ম প্রতিষ্ঠিত।... আমাদের দেশে সমাজধর্মের দোহাই দিয়ে আমরা এতকাল নরবলি দাবী করে এসেচি;— শূদ্রকে বলে এসেচি অগৌরবে তুমি সম্মত হও কেন না সমষ্টিদেবতার সেই আদেশ অতএব এই তোমার ধর্ম; নারীকে বলে এসেচি কারাবেষ্টনে তুমি সম্মত হও তাহলেই সমষ্টিদেবতার কাছে তুমি বর লাভ করবে। তোমার ধর্ম রক্ষা হবে। কিন্তু সমষ্টিদেবতা সর্বকালের দেবতার প্রতিযোগী হয়ে আমাদের বাঁচাতে পারবে না। মানুষকে খর্ব্ব করার অন্যায় এবং দুঃখ রাষ্ট্রের এবং সমাজের স্তরে স্তরে জমে উঠচে, এমনি করে প্রলয়ের ভূমিকম্পকে গর্ভে ধারণ করচে।”

বিলেতযাত্রার সঙ্গী পুত্র রথীন্দ্রনাথের ডায়েরি বলে, রোটেনস্টাইন যখন তাঁর পরিবার সমেত রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করতে আসেন, তাঁদের মধ্যে কথোপকথনের বিষয় ছিল, “রাজশক্তির শোষক চরিত্রের কথা জেনেও সমাজের বিদগ্ধ ব্যক্তিরা কি সরকারের সঙ্গে সহযোগিতা করবেন?” রবীন্দ্রনাথ তাঁকে ইন্ডিয়ান সোসাইটি অব আর্টের উদাহরণ দিয়ে বলেন, সরকারি সাহায্য মানেই শিল্পীকে বাধানিষেধের মধ্যে বেঁধে ফেলে একপ্রকার পঙ্গু করে দেওয়া। এর ফলে শিল্পের ক্ষতিই হয়।

রবীন্দ্রনাথের অনেক ভাবনার মতো এই অবস্থানটি নিয়েও আমরা খুব বেশি ভাবিনি। ফলে এই ‘পঙ্গুত্ব’-র লক্ষণ আমাদের এখনকার শিল্প সাহিত্য সিনেমা থিয়েটার সর্বত্র অধিকার করে ফেলেছে। শাসকের জয়গাথা অথবা সমসাময়িক সঙ্কট ভুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টায় নির্মিত এক অসচেতন শিল্পপ্রয়াসের প্রদর্শনী আজ আমাদের চার দিকে।

শাসকের নির্দেশে যখন ইতিহাস ভুলিয়ে দেওয়া, বা বলা ভাল, ভুল ইতিহাস প্রচার করার রীতি শুরু হচ্ছে, আশ্চর্য লাগে দেখে যে কত কম প্রতিবাদ উঠে আসছে সমাজ থেকে, রাজনীতি থেকে। যে বুদ্ধিজীবী শিল্পী-সাহিত্যিকরা কোনও না কোনও রাজনীতির সঙ্গেই যুক্ত, তাঁরাও কী আশ্চর্য ভাবে চুপ। অথচ বিদ্যালয়-স্তরে এমন কাণ্ড ঘটলে তার থেকে বড় সামাজিক অন্যায় আর কী হতে পারে। সাধারণ নাগরিকের ক্ষমতা সীমিত। তাই তাঁরা নির্ভর করেন শিল্পী-সাহিত্যিকদের উপর, যাঁদের কথা অনেকে শুনতে পায়। সাধারণ মানুষের মনে তাই প্রশ্ন, কেন ওঁদের এই চুপ করে থাকা? সরকারি আনুকূল্যের আশায়? সরকারি রোষের ভয়ে?

রবীন্দ্রনাথ পরিচিত হয়েছিলেন লর্ড মন্টেগুর সঙ্গে, যিনি সেই সময়ে পার্লামেন্টে জালিয়ানওয়ালা বাগ হত্যাকাণ্ডের হোতা জেনারেল ও’ডায়ারের কর্মকাণ্ডের সওয়াল বিচার করছিলেন। রবীন্দ্রনাথ মন্টেগুকে বলেন, “ভারতের শাসনব্যবস্থা যেন এক যন্ত্রের দ্বারা সম্পন্ন হচ্ছে যার মধ্যে হৃদয়ের স্পর্শ নেই।” কাথিয়াবাড়ের রাজাদের ঘোর আপত্তি সত্ত্বেও সেখানকার গরু-মোষদের সুদূর ব্রাজ়িলে চালান করে ইংরেজরা প্রভূত অর্থ লাভ করছে, কিন্তু দুধের অভাবে সেখানকার হাজার হাজার শিশু অকালে মারা যাচ্ছে— এও তিনি মন্টেগুকে বলেন।

যেখানে যতটা সুযোগ পেয়েছেন, নিজের দেশের মানুষের দুঃখের কথা বলেছেন রবীন্দ্রনাথ, অভিযোগ করেছেন, প্রতিবাদ করেছেন। শিখিয়েছেন, শিল্পী-সাহিত্যিকের মনকে হতে হবে ব্যাপ্ত— কেবল নিজেরটুকু নিয়ে থাকা নয়, নিজের স্বার্থভাবনায় নিমজ্জিত নয়।

আমরা সেই শিক্ষা গ্রহণ করেছি কি না, তা অবশ্য প্রমাণ করছে বর্তমান।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Rabindranath Tagore Jallianwala Bagh Massacre Protest

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy