E-Paper

অসম যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি

জুন মাসের এই যুদ্ধ ছিল অসম যুদ্ধ। কিন্তু দু’পক্ষের লক্ষ্য যদি ভিন্ন হয়, তবে অসম যুদ্ধেও টিকে থাকা যায়। অসম যুদ্ধ বিংশ শতাব্দীতেও ছিল, ভিয়েতনাম যুদ্ধ তার এক প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

রণবীর সমাদ্দার

শেষ আপডেট: ২২ অগস্ট ২০২৫ ০৫:৪৩
যুযুধান: ইরানের নিক্ষেপিত ড্রোন ও মিসাইল প্রতিহত করছে ইজ়রায়েলের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা।

যুযুধান: ইরানের নিক্ষেপিত ড্রোন ও মিসাইল প্রতিহত করছে ইজ়রায়েলের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। ছবি: রয়টার্স।

এ বার ইরান-ইজ়রায়েল যুদ্ধের সমাপ্তির পর দেখা গেল এক অদ্ভুত ঘটনা। তিন পক্ষই বলছে, তারা বিজয়ী। ইজ়রায়েল দাবি করেছে, তারা ইরানের যুদ্ধ-ক্ষমতা ও পারমাণবিক অস্ত্র নির্মাণের ক্ষমতা ধ্বংস করেছে। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, যুদ্ধের শেষ দিকে ইরানে ভারী বোমাবর্ষণ করে তারা দেখিয়েছে, পশ্চিম এশিয়ার যুদ্ধে তারাই শেষ কথা। এবং তাদের এই বোমাবর্ষণের ফলে যুদ্ধবিরতি সম্ভব হয়েছে। ইরান এই দুই দাবিই নস্যাৎ করে ঘোষণা করেছে যে তারা ইজ়রায়েল-আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের সম্মিলিত আগ্রাসন প্রতিহত করেছে, তারা অপরাজিত থেকেছে। তারাই তাই যুদ্ধজয়ী। যুদ্ধবাজদের যুদ্ধপ্রচেষ্টা ব্যর্থ।

ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ দিয়ে যুদ্ধে সাফল্য বিফলতা নির্ণীত হচ্ছে না। হচ্ছে, যুদ্ধের লক্ষ্য পূর্ণ হল কি না। তাই ইরানের প্রভূত ক্ষতি হলেও ইরানের দাবিকে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না।

জুন মাসের এই যুদ্ধ ছিল অসম যুদ্ধ। কিন্তু দু’পক্ষের লক্ষ্য যদি ভিন্ন হয়, তবে অসম যুদ্ধেও টিকে থাকা যায়। অসম যুদ্ধ বিংশ শতাব্দীতেও ছিল, ভিয়েতনাম যুদ্ধ তার এক প্রকৃষ্ট উদাহরণ। বস্তুত যুদ্ধ যত দিন মানবেতিহাসে আছে, অসম যুদ্ধের কাহিনিও তত দিন। কিন্তু একবিংশ শতাব্দীতে অসম যুদ্ধ এক নির্দিষ্ট চেহারা গ্রহণ করছে।

অসম যুদ্ধের প্রকৃত চেহারা বোঝা শক্ত, কারণ যুদ্ধের ধোঁয়াশা যুদ্ধকে ঢেকে রাখে। দাবি, পাল্টা দাবি, প্রতিবেদন, পাল্টা প্রতিবেদন যুদ্ধেরই অংশ হয়ে দাঁড়ায়। এমনকি যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হলে যুদ্ধের উদ্দেশ্যও খানিকটা পাল্টে যেতে পারে।

দৃষ্টান্ত হিসাবে ধরা যাক, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের এই যুদ্ধে ইরানের উপর ভারী বোমাবর্ষণ। ২০২০-তে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইরানের সমরবিদ এবং সেনানায়ক কাশেম সোলেইমানিকে হত্যার আদেশ দেন। সে বারে ইরান-আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধ বাধেনি। তার কারণ আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের আত্মসংযম নয়, ইরানের আত্মসংযম। এই বার বি৫২ বোমারু বিমান দিয়ে ইরানে বোমাবর্ষণ করে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র বলেছে— ইরানকে আলোচনার পথে ফেরাতে তারা বাধ্য করেছে বোমা নিক্ষেপ করে।

আলোচনায় ফেরানো মানে কী? ইরানকে একতরফা ভাবে পারমাণবিক শক্তিচর্চা থেকে সরে আসতে বাধ্য করা, ইজ়রায়েলের কাছে নতিস্বীকারে সম্মত করা? ইরানকে এই স্বীকারোক্তিতে বাধ্য করা যে ইরান ‘সন্ত্রাস’-এর পথ অবলম্বন করেছিল, সেই ‘সন্ত্রাস’-এর পথ থেকে সরে আসবে। ইজ়রায়েলের প্যালেস্টাইনি ও আরবনিধনে বাধা দেবে না ইরান।

ইরানকে আলোচনায় না ফেরাতে পারলে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের বিফলতা। ইজ়রায়েলেরও বিফলতা। কাজেই ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে শত্রুর, এই বলে ঢক্কানিনাদ করে বাস্তবকে চাপা যাবে না যে ইরানকে দমন করা গেল না। ইরান এই যুদ্ধে অপেক্ষাকৃত কম শক্তিধর হয়েও অপরাজিত থেকে গেল। ইজ়রায়েল-বিরোধী শক্তিসমূহ টিকে রইল। লোহিত সাগরে বিদ্রোহী কার্যকলাপ অব্যাহত রইল। যুদ্ধ অসম, কিন্তু যুদ্ধের ফল শুধু সামরিক শক্তির বিচারে নির্ধারিত হল না।

যুদ্ধের পরিণাম এমনও হতে পারে যে, যে সম্ভাবনাকে আটকানোর জন্য যুদ্ধ ঘোষণা, সেই সম্ভাবনা আরও বৃদ্ধি পেল। দুর্বল শক্তি এই ধরনের অসম যুদ্ধে আত্মরক্ষার অধিকার বজায় রাখে কী করে, ইরান তার এক উদাহরণ। কিন্তু, সংবাদমাধ্যমের ঢক্কানিনাদে এই সোজা সত্য প্রায় ঢাকা পড়ে যায়। অতর্কিতে আগ্রাসন চালিয়ে, বিজ্ঞানীদের হত্যা করে ইরানের প্রশাসনিক ব্যক্তিবর্গকে হত্যা করে ইজ়রায়েল ভেবেছিল, অল্প ক’দিনেই যুদ্ধ জিতে যাবে। কিন্তু পারেনি। কারণ এ যুদ্ধও নতুন ধরনের।

তেল আভিভ থেকে তেহরানের দূরত্ব প্রায় ১৬০০ কিলোমিটার। ইজ়রায়েল ও ইরানের মধ্যে কোনও ভূসীমানা নেই। মাঝে রয়েছে অন্য কিছু দেশ। হাজার হাজার কিলোমিটার অতিক্রম করে ইজ়রায়েলি বিমান ইরানে হানা দিয়েছে। ইরানও পাল্টা ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে আত্মরক্ষা করেছে। ইরানের অত্যাধুনিক যুদ্ধবিমান নেই বললেই চলে। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের বদান্যতায় ইজ়রায়েলের কাছে একাধিক অত্যাধুনিক বিমান।

কিন্তু ইজ়রায়েলি আক্রমণের উত্তরে ইরান ইজ়রায়েলি শহরগুলিতে এবং সামরিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলিতে আঘাত হানল কী করে? ইজ়রায়েলি প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এই ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্রের যুগ্ম ব্যবহারকে সম্পূর্ণ প্রতিহত করতে পারল না, দেখাই যাচ্ছে। ইজ়রায়েল বিনা কারণে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব মেনে নেয়নি। অথচ, এই যুদ্ধে ইজ়রায়েলের ব্যয় হয়েছে ইরানের থেকে অনেক বেশি। ইজ়রায়েলের যুদ্ধ ব্যয়বহুল, কাজেই অসম যুদ্ধের ধারণার মধ্যেও অনেক কুহেলিকা আছে।

সে দিক থেকে এই অসম যুদ্ধ আরও হেঁয়ালি ভরা। ইরানের আকাশে ইজ়রায়েল একচ্ছত্র আধিপত্য চালিয়েছে। তবু তার যুদ্ধের উদ্দেশ্য পূর্ণ হল না। ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র তীব্র গতিতে মহাকাশে উঠে আবার আকাশে নেমে এসেছে ইজ়রায়েলি লক্ষ্যের দিকে। ইরানের আকাশে প্রভুত্ব জারি করে ইজ়রায়েল পূর্ণ সাফল্য পেল না।

ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র ঠেকাতে ইজ়রায়েল তার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়েছে। তার অনেকটা সফল, কিন্তু তার আংশিক ব্যর্থতাও প্রকট। একটি হিসাব অনুযায়ী প্রতি রাতে ইজ়রায়েলের ক্ষেপণাস্ত্র রোধ খাতে ব্যয় হয়েছে ২৮৫ মিলিয়ন ডলার। পাঠকরা বুঝতে পারবেন, এই যুদ্ধ চলাকালীন ইজ়রায়েলের সে-ক্ষেত্রে কত ব্যয় হয়েছে শুধু ক্ষেপণাস্ত্র ঠেকাতে।

ইতিমধ্যে ইজ়রায়েলের পশ্চিমি সমর্থন জোটের উপর চাপ বেড়েছে। স্পেন অসম্মত নেটো জোটের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রতিরক্ষাখাতে ব্যয় বাড়াতে। জার্মানি সেনাবাহিনীতে স্বেচ্ছায় যোগদান বাড়াতে চায়। নইলে তারা বাধ্যতামূলক সেনাবাহিনীতে অংশগ্রহণের নিয়ম চালু করবে। কিন্তু ইউরোপের দেশগুলি এই সব করবে শত্রুদের হাত থেকে ইউরোপকে বাঁচাতে, না ট্রাম্পের থেকে বাঁচতে তারা আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র থেকে সোনা ফিরিয়ে আনবে? বিশেষত, জার্মানি এবং ইটালির দ্বিধা চরমে।

এই অবস্থায় ইউরোপ ইরান-ইজ়রায়েল সংঘর্ষের পুনরাবৃত্তি ঠেকাতে কূটনীতির উপর জোর দিয়েছে। কিন্তু ইউরোপের কথা কে শোনে? আর ইরানকে সম্মত করানোর জন্য তারা কী-ই বা দিতে পারে? অন্য দিকে, ইরানের প্রাক্তন শাহের জীবিত পুত্র আমেরিকা থেকে ইরানে ফিরে এসে শাহতন্ত্রের পুনঃপ্রবর্তন চান। এই দিনের জনঅভ্যুত্থান, জাতীয় স্বাধীনতা, ও গণতন্ত্রের সংগ্রামের বিরোধী আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, ইজ়রায়েল ও ইউরোপীয় জোটের এই হল উদ্দেশ্য। উন্নয়নশীল দেশগুলির স্বাধীনতা ও জাতীয়তাবোধের সমাপ্তি ঘটুক।

প্রতিরোধের নকশাগুলি ধ্বংস করে, যেমন গাজ়ায়, সেখানে ধনতান্ত্রিক অর্থনীতির প্রয়োজন অনুযায়ী সামগ্রিক পুনর্নির্মাণ হোক। গাজ়া ভূখণ্ড থেকে ব্যাপক হারে গণবিতারণ এবং ইরানকে দ্বিখণ্ডিত করা যেমন ইরাককে করা হয়েছে। এই হল অসম যুদ্ধে এক পক্ষের উদ্দেশ্য। নয়া উদারনীতিবাদের যুদ্ধে শুল্কযুদ্ধ, অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ, কূটনৈতিক যুদ্ধ, ও অভিবাসীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ একতারে বাঁধা। এই যুদ্ধের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ প্রায়ই অসম হবে। কিন্তু শক্তির অসাম্য থাকলেও গাজ়াবাসীরা এবং ইরান, দুইয়েই দেখিয়েছে কম শক্তিধর পক্ষ কী ভাবে টিকে থাকতে পারে।

রাজনৈতিক লক্ষ্য এর জন্য প্রয়োজন। কিন্তু শুধু এটুকু বলা যথেষ্ট নয়। নয়া উদারনীতিবাদী যুগে এক সার্বিক যুদ্ধের বাতাবরণে রাজনীতিকে খাপ খাওয়াতে হবে এই বাতাবরণের সঙ্গে। সেই বিচারে যুদ্ধময় পরিস্থিতিতে স্থির উদ্দেশ্য নিয়ে হস্তক্ষেপের নাম হল রাজনীতি।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

america Diplomacy

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy