দুর্গাপুজোর সময়ে থিম ও সাবেকের লড়াইয়ের মাঝে একটি তুলনামূলক হালকা চালের বিষয়ও বার বার সামনে উঠে আসে; দুর্গা ও অসুর মূর্তির আদলে বাস্তব কোন ব্যক্তির মুখ। আগেরবছরগুলিতে যেমন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আদলে তৈরি দুর্গা প্রতিমা ও মহাত্মা গান্ধীর আদলে তৈরি অসুরের মূর্তি যেমন বিতর্ক তৈরি করেছিল, এ বার সেই স্থান নিয়েছে অসুরের স্থানে মুহাম্মদ ইউনূস ও ডোনাল্ড ট্রাম্পের মুখ। যদিও বিষয়টি নতুন কিছু না। আগেও কখনও সাদ্দাম হুসেন, ওসামা বিন লাদেন, আজমল কাসভের মুখের আদলে অসুরের মূর্তি নির্মিত হতে দেখা গিয়েছিল খোদ কুমোরটুলির অন্দরে। অতীতে চন্দনদস্যু বীরাপ্পানের মুখের আদলে অসুর মূর্তি তৈরির কথাও মনে থাকবে অনেকের হয়তো। বাঙালির দুর্গাপুজোর ইতিহাসে রানি ভিক্টোরিয়া থেকে ১৯৭১ সালের ইন্দিরা গান্ধীর মুখের আদলে দুর্গা প্রতিমা গড়ার পথ পার হওয়ার সঙ্গে অত্যাচারী নীলকর সাহেবেরমুখের আদল থেকে হাল আমলের ইউনূস বা ট্রাম্পের অসুর-মূর্তি আসলে বাঙালির রূপকল্প ব্যবহারে রাজনৈতিক মত প্রকাশের এক মাধ্যম। বলা যেতে পারে, কখনও প্রতিবাদ আবার কখনও চাটুকারিতার প্রকাশভঙ্গি হিসাবে উঠে আসা এই মূর্তির রূপকল্পের রাজনীতি বাঙালির বহু পুরনো সংস্কৃতি। কিন্তু সংখ্যাগুরুর এই সংস্কৃতির আধুনিক প্রকাশভঙ্গি কি প্রান্তিক ভাবাবেগের ক্ষেত্রে সমস্যার নয়?
আমরা প্রত্যেক বছর দুর্গোৎসবের সময় ফিরে আসতে দেখি হুদুড় দুর্গার বিষয়টি। এই বিতর্কের জন্যই বাঙালি সমাজে অসুর সম্প্রদায়ের নাম আর আগের মতো অপরিচিত নয়। ভারতে ২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী ঝাড়খণ্ড রাজ্যে সব থেকে বেশি এই সম্প্রদায়ের লোকজনের বাস (২২,৪৫৯ জন), তার পর বিহার ৪,১২৯ জন এবং তৃতীয় স্থানে আছে পশ্চিমবঙ্গ ৩,৮৬৪ জন। পশ্চিমবঙ্গের উত্তরবঙ্গে দার্জিলিং, জলপাইগুড়ি এবং কোচবিহার জেলাতে ৯৭ শতাংশের বেশি লোকজনের বাস। এই সম্প্রদায় তিনটি বিভাগে বিভক্ত, যথা বীর (কোল) অসুর, বিরজিয়া অসুর এবং অগারিয়া অসুর। উত্তরবঙ্গের চা বাগান সংলগ্ন গ্রামে, মূল সমাজ থেকে অনেক দূরে বসবাস। অন্যান্য জাতির সঙ্গে তাঁদের যোগাযোগ খুব কম, নিজ সম্প্রদায় এবং অন্য কিছু সম্প্রদায়ের সঙ্গে কথোপকথন হয়। মাঝেমধ্যে ঝাড়খণ্ড থেকে নিজ সম্প্রদায়ের লোকজন এসে তাঁদের খোঁজখবর নিয়ে যান। চা বাগানে কাজ করে যেটুকু আয় হয় সেই দিয়ে জীবন চলে, জমিজমা বলতে কিছু নেই। চা বাগান বন্ধ মানেই বেকার। অনেকে খ্রিস্টানধর্মে ধর্মান্তরিত হয়েছেন। জনজাতি গোষ্ঠীর হওয়া সত্ত্বেও অনেকের পরিচয়পত্র এখনও নেই।
২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী সাক্ষরতার হার প্রায় ৪৫ শতাংশ, পুরুষদের প্রায় ৫৫ শতাংশ, মহিলাদের প্রায় ৩৫ শতাংশ। তাঁরা এই পুজোর অংশ ছিলেন না দীর্ঘ দিন। প্রতি বছর দুর্গাপুজোতে তাঁরা মৌনী থাকেন। পুজো শুরু হলেই ঘরের ভিতর বন্দি হয়ে যান, পুজোর আওয়াজ তাঁদের কানে যাতে না পৌঁছয়। বেশ কিছু বছর সেই মৌনব্রত ছেড়ে অনেকে পুজোতে অংশগ্রহণও করেছেন। বর্তমানে তাঁদের বাড়িতে অসুরের মূর্তিও দেখা যায় না। যে অসুরীয় ভাষাতে কথা বলতেন এক সময়, তাও বিলীন হওয়ার দিকে। কিছু পুরনো উৎসব তাঁরা পালন করেন। তাঁদের নিয়ে দীর্ঘকাল যাবৎ সমাজে অনেক কুকথা শুনতে পাওয়া যায়, অসুরদের মতো শরীর, অসুরদের মতো খাবার খায়, অসুরদের মতো শক্তি, অসুরদের মতো দেখতে ইত্যাদি। এঁদের পরবর্তী প্রজন্মের দুর্গাপুজোয় অংশগ্রহণের বিষয়টি যে সংখ্যাগরিষ্ঠের সামাজিক চাপের ফল তা আলাদা করে বলে দেওয়ার দরকার নেই। ভারতীয় সংবিধানে ধর্মীয় উৎসবগুলিকে স্পষ্ট ভাবে তালিকাভুক্ত করে না, কিন্তু ধর্ম পালনের স্বাধীনতাকে রক্ষা করে (অনুচ্ছেদ ২৫-২৮), যা মানুষকে তাঁদের উৎসব উদ্যাপন করতে সমর্থন করে। তাই উৎসব নিয়ে মানুষের মাতামাতি থাকতেই পারে। যে হেতু সংবিধান যেমন এক দিকে নিজস্ব ধর্ম পালনে স্বীকৃতি দিয়েছে, অন্য দিকে এ কথাও বলেছে যে, রাষ্ট্র কোনও একটি ধর্মের প্রতি বৈষম্য বা অগ্রাধিকার দেখাতে পারে না।
সমস্ত দিক থেকেই তাঁরা অবহেলিত, শেষে তাঁদের মূর্তির আদলে বসানো হল তথাকথিত অশুভ ব্যক্তিদের। অনেকে প্যান্ডেলে গিয়ে দেখবেন তাঁদের দেবতার এই দৃশ্য, মনের ভিতর কতটা বেদনার সৃষ্টি হবে সেই নিয়ে কেউ ভাবে না। আনন্দের উৎসবে সংবেদনশীলতার পাঠ ভুলে গেলে উৎসবের মূল উদ্দেশ্যটিই ব্যর্থ হয়।
তাঁরা দুর্গাপুজোর প্রত্যুত্তরে হুদুড় দুর্গা পুজো করে থাকেন; অনেকটি তাঁদের প্রতিবাদের ভাষারূপে। তাঁরা প্রতিবাদও করেছেন দুর্গাপুজো নিয়ে। সমাজকর্মী সুষমা অসুর ২০১৬ সালে ঝাড়খণ্ডের আরও ১০ জনকে সঙ্গে নিয়ে কলকাতার রাস্তায় নেমেছিলেন, উদ্দেশ্য ছিল তাঁদের পরিচয় সম্পর্কে সচেতনতা ছড়িয়ে দেওয়া। তিনি বলেছিলেন, “আমি প্যান্ডেলের ভিতরে যাব না, এটা আমাদের শোক করার সময়। পূর্বে আমরা জমিদারদের পুজোর প্রস্তুতিতে সাহায্য করতাম কিন্তু পুজো শুরু হওয়ার আগেই চলে যেতাম।” তাঁদের প্রতিবাদের ফল কিছুই হয়নি। তাঁদের কথা কারও কানেও যায় না। কেনই বা যাবে? না আছে তাঁদের ভোটের শক্তি, না আছে আর্থসামাজিক প্রতিপত্তি। সব দিক থেকেই পঙ্গু। এই লড়াই করতে না পেরে তাঁরা দুর্গাপুজোতে শামিল হয়েছেন। এ ছাড়া অনেকে নিজেদের হিন্দুও মনে করেন। যাঁরা খ্রিস্টান ধর্মে গিয়েছেন, তাঁদের জন্য চার্চ তৈরি করা হয়েছে, তাঁদের বিষয়টা আলাদা। তাঁদের না গিয়ে উপায়ও নেই।
এই নিয়ে প্রকাশ অসুর একদা বলেছিলেন, “আমাদের বাড়িতে অসুরের মূর্তিও নেই, আমি তো দুর্গাপুজো কমিটির সদস্য, ক্লাবের পুজোতে সক্রিয় ভাবে অংশগ্রহণও করি।” এই অংশগ্রহণকে যদি আমরা অসুর সম্প্রদায়ের দিক থেকে সদর্থক পদক্ষেপ হিসেবেও দেখি, তবুও আমাদের কিছু দায়িত্ব থেকে যায়। রাজনৈতিক বা বিতর্কিত ব্যক্তিদের মুখের আদলে দেবী অথবা অন্যান্য প্রতিমা নির্মাণ থেকে বিরত থাকি না কেন? আগের বছর মহাত্মা গান্ধীর আদলে তৈরি অসুর মূর্তি নিয়ে বিস্তর জলঘোলা হয়েছে, ঠিক যেমন মুখ্যমন্ত্রীর আদলে গড়া দেবী প্রতিমা অনেকের ভাবাবেগে আঘাত করেছে। এই সমস্ত দিকের সঙ্গে অসুরদের কথাটি ভাবলে, একটি বিষয় স্পষ্ট হয় যে, থিমের টানে বা ট্রেন্ড-এর টানে করা এ সকল সৃষ্টিশীলতা সমাজের ভিন্ন মত ও বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে সহাবস্থানের ক্ষেত্রে সমস্যাই তৈরি করবে, সে ক্ষেত্রে এ সকল সৃষ্টিশীলতা আক্ষরিক অর্থেই সৃষ্টিছাড়া বই কিছু না।
আবার দীর্ঘ দিন অসুরের বুকে ত্রিশূল প্রবেশ করা মূর্তি দিয়ে দিব্য চলছিল, এখন শুরু হল তাঁদের অন্যান্য রূপ দেওয়া। এই চারিত্রিক পটপরিবর্তন তাঁদের অশুভ, দৈত্য থেকে দেশের শত্রু বানাতেও বাকি রাখল না। বিষয়গুলি মানবিকতার দিক থেকে দেখলে আশা করা যায় ভুল হত না। নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ি বলেছেন, দেবতারা যেমন কেউ অন্তরিক্ষ লোকের বাসিন্দা নন এবং তাঁরা মানুষই, তেমনই অসুর-রাক্ষসরাও কেউ অন্য জগতের আলাদা কোন বিশিষ্ট জীব নন, তাঁরাও মানুষই।সুতরাং তাঁদের আবেগ, অনুভূতি, ভাবাবেগে আঘাত করার আগে সকলের ভাবা উচিত। এই ভাবনাচিন্তা রেখে ভবিষ্যতে তাঁদের দেশের শত্রু না বানালেই আশা করি সমাজ এবং সংবিধান রক্ষার পক্ষে শুভকর হবে।
বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়, মেদিনীপুর
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)