লাল। এই শব্দটার কিছুতেই একটা জুতসই বাংলা খুঁজে পাইনি বলে আশ্চর্য একটা উর্দু কবিতা আর বাংলায় তর্জমা করে উঠতে পারিনি। কিন্তু এ বছর ২২ এপ্রিল কাশ্মীরের পহেলগামে বর্বরোচিত সন্ত্রাসবাদী বিভীষিকার প্রত্যুত্তরে অপারেশন সিঁদুর তার প্রাথমিক অভীষ্ট অর্জন করেছে, ভারতীয় সেনাবাহিনীর এই ঘোষণার পর ভারত ও পাকিস্তান দুই দেশই ঘনিয়ে ওঠা যুদ্ধ-পরিস্থিতিতে লাগাম টানার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় এ দেশের সংবাদমাধ্যম ও সমাজমাধ্যমের উল্লেখযোগ্য অংশে যে ‘শান্তি নয় যুদ্ধ চাই’ ঝড় উঠল, তখন কেবলই মনে হচ্ছিল, কবিতাটা যদি বাংলায় ছড়িয়ে দিতে পারতাম!
যুদ্ধ কেন প্রয়োজন হয়? যুদ্ধ করে কি সত্যিই সন্ত্রাসবাদের দীর্ঘমেয়াদি সমাধান সম্ভব? যুদ্ধের সঙ্গে আন্তর্জাতিক অস্ত্র-বাজারে অকল্পনীয় বিপুল অঙ্কের অর্থের বাণিজ্য থেকে মুনাফা-তোলা কায়েমি স্বার্থের কি কোনও যোগাযোগ নেই? এমন অজস্র প্রশ্ন দুনিয়া জুড়ে চর্চিত। আজও সেগুলির উত্তর মেলেনি, কখনও মিলবে না। যুদ্ধ মানবসভ্যতার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। এ এক বিচিত্র কূটাভাস যে, সভ্যতার উন্নতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে যুদ্ধের মারণাস্ত্র ভয়াবহ থেকে ভয়াবহতর হয়ে উঠেছে। তাই তো সত্যজিৎ রায় তাঁর শেষ ছবি আগন্তুক-এর মুখ্য চরিত্র মনোমোহন মিত্রের মুখে তীব্র পরিহাসে শাণিত এই সংলাপ বসিয়ে দেন, “সভ্য হচ্ছে সেই মানুষ যে আঙুলের একটি চাপে, একটি বোতাম টিপে, একটি ব্রহ্মাস্ত্র নিক্ষেপ করে সমস্ত অধিবাসী-সহ একটা গোটা শহরকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারে। আর সভ্য কারা জানেন, যাঁরা এই অস্ত্র প্রয়োগের সিদ্ধান্ত নিতে পারেন, উইদাউট টার্নিং আ হেয়ার।”
উত্তর না মিলুক, এই সব প্রশ্ন বার বার ওঠা দরকার। কিন্তু এগুলির বাইরেও বিচলিত করে দেশ জুড়ে ওঠা ওই যুদ্ধ-জিগির। এর সঙ্গে যুদ্ধের ‘স্ট্র্যাটেজিক’ লক্ষ্যের কোনও যোগাযোগ নেই। এ এক প্রতিহিংসাপরায়ণ হিংস্র উন্মাদনা, যা স্পষ্টতই নিজ দেশের উচ্চতম সেনা-নেতৃত্বের সিদ্ধান্তেরও তোয়াক্কা করে না। বস্তুত তাঁরাও হয়ে ওঠেন এর নিশানা। যা গভীরতর উদ্বেগের: এই উন্মাদনার আঁতুড় অতি সাধারণ, দু’বেলা গ্রাসাচ্ছাদনের চেষ্টায় গলদঘর্ম মানুষের মন। পাবলো নেরুদার পঙ্ক্তি মনে পড়ে, “‘হয়তো অতিক্রান্ত হবে এ যুদ্ধও, আমাদের বিভাজিত-করা অন্য সব যুদ্ধেরই মতো,/ আমাদের মৃত ফেলে রেখে, আমাদেরও হত্যা করে ঘাতকের সাথে/ তবু এই সময়ের লজ্জা যে তার জ্বলন্ত আঙুল রাখে আমাদের মুখের উপর/ নিরপরাধ রক্তে লুকানো এ নির্মমতা মুছে দেবে কে?” রাজনৈতিক, বাণিজ্যিক, সাম্প্রদায়িক, হরেক কিসিমের স্বার্থ এই জিগির তৈরিতে ইন্ধন জুগিয়ে দেশে-দেশান্তরে মানুষের রক্তে লুকোনো নির্মমতা উস্কে দেয়। যখন টিভিতে সম্প্রচারিত যুদ্ধ আমাদের কাছে রাতের আকাশে অপূর্ব আতশবাজি হয়ে ওঠে, গায়েব হয়ে যায় তার রক্তমাংসগ্রাসী ভয়াবহতা; যখন প্রতিহিংসার নেশায় আমরা চাই আরও যুদ্ধ, তখন সেই উর্দু কবিতাটা পড়তে ও পড়াতে ইচ্ছে করে, “উঠো, অব মাটি সে উঠো/ জাগো মেরে লাল।” আদরের সে ছেলে মাটিতে ঘুমিয়ে। সমস্ত কুচকাওয়াজ, গান স্যালুট, বিউগল-ধ্বনি শেষ হলে তার মা-বাপের এই হৃদয় বিদীর্ণ করা হাহাকার তাকে আর জাগাতে পারবে না।
‘উর্দু’ বলতেই আমরা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত ধারণায় মূলত পাকিস্তানের শাসকদের পরিকল্পিত সাংস্কৃতিক নীতিতে তৈরি আরবি-ফারসি শব্দে ভরপুর যে ভাষা বুঝি, তাকে সম্পূর্ণ পরিত্যাগ করে, যে উর্দুভাষী মানুষ মাটির খুব কাছাকাছি তাঁর মুখের উর্দুতে এ কবিতা গড়ে তোলেন কবি। আমরা পড়তে থাকি: “তুমরি সেজ সাজাওয়ন কারন/ দেখো আয়ি রয়েন অন্ধারন/ নীলে শালে দো শালে লেকর/ জিন মে ইন দুখিয়ন আঁখিয়ন নে/ ঢের কিয়ে হ্যায়ঁ ইতনে মোতি/ ইতনে মোতি জিনকি জ্যোতি/ দান সে তুমরা/ জগজগ লাগা/ নাম চমকনে/ উঠো, অব মাটি সে উঠো/ জাগো মেরে লাল।” উল্লসিত আমরা টিভিতে সান্ধ্য মিসাইল-যুদ্ধের যে দারুণ ফুলঝুরি দেখে চলেছি, হয়তো তারই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কোনও টুকরোয় দেহ এফোঁড়-ওফোঁড় হয়ে যাওয়া এই নবীনের আত্মত্যাগ নিয়ে যখন শৌর্য-বীর্যের সমস্ত কথন-অতিকথন নীরব হয়ে যাবে, তার মা-বাপ সেই রাত্রির নিস্তব্ধ নীল শালে গেঁথে চলবে অপরিমিত অশ্রুর ফোঁটা ফোঁটা মুক্তো। কবিতার প্রথম পঙ্ক্তি থেকে ক্রমে ক্রমে আমরা পাঠকেরা ‘যুদ্ধের দামামা’ বলে যে লব্জটা আছে তার থেকে আরও দূরে সরে যেতে থাকি। আমরা প্রবেশ করি এক সত্যে যা প্রেস-বিজ্ঞপ্তি থেকে, টিভিতে সম্প্রচারিত জননেতার ভাষণ থেকে, কোনও রাষ্ট্রপ্রধানের ‘টুইট’ থেকে আহরিত নয়। এই কবিতা আমাদের এক বিকল্প অবিসংবাদিত সত্যে হাজির করে ইঙ্গিতে প্রশ্ন করে: এই রাত্রির কান্না তুমি শুনেছ কি?
কবিতা এগোতে থাকে। “অব জাগো মেরে লাল/ ঘর ঘর বিখরা ভোরকা কুন্দন/ ঘোর-অন্ধেরা আপনা আঙ্গন/ জানে কব সে রাহ্ তকে হ্যায়ঁ/ বালী দুলহনিয়া, বাঁকে বীরন…” তার পর এক সময় ভোর হয়। নগরে প্রান্তরে ঘরে দুয়ারে ছড়িয়ে পড়ে সোনালি রোদ্দুর। প্রচারমাধ্যমে যুদ্ধের সব নির্মমতা, ক্ষতবিক্ষত শব ছেঁকে নিয়ে প্রস্তুত সামরিক জয়-পরাজয়ের রুদ্ধশ্বাস ধারাবিবরণী পড়তে ব্যস্ত হই আমরা। কিন্তু এ উঠোনে তো ভোর আসে না। বধূটির, অকুতোভয় ভাইটির— অবুঝ প্রতীক্ষা রাত্রিকে অনন্ত করে তোলে। আমরা এ কবিতার হাত ধরে চলতে চলতে হঠাৎ খেয়াল করি, আসলে এক নয়, দুই অবিসংবাদিত সত্যের সংঘাতে কবি তাকে গড়ে তুলছেন: সে যুবক আসলে আর কোনও দিন উঠবে না, এই সত্য; এবং তার মা-বাবা-বৌ-ভাইয়ের হৃদয়ে গুমরোতে থাকা এক অলীক আশার সত্য। সৈনিক যুদ্ধে গিয়েছে, প্রাণ দিয়েছে, রাষ্ট্র তাকে পরিপূর্ণ সম্মানে বিদায় জানিয়েছে— এই সহজ সত্য মেনে নিলেই তো ল্যাঠা চুকে যায়। আসলে সেই প্রাণ-দেওয়া যত ক্ষণ না আমার দরজায় এসে পৌঁছয়, আমরা তো পরের ব্রেকিং নিউজ়ের উত্তেজনায় ল্যাঠা চুকিয়েই দিই, যদিও গলা ফাটিয়ে তা বলতে পারি না, পাছে অন্তরের অন্তঃপুরে বর্বরতার কিনারে দাঁড়ানো সেই নির্মমতা ফাঁস হয়ে যায়! কবি এই সংঘাত তৈরি করে আমাদের দাঁড় করিয়ে দেন নিজেদের মুখোমুখি।
শেষ চরণগুলি— “সুনা তুমরা রাজ পড়া হ্যায়/ দেখো কিতনা কাজ পড়া হ্যায়/ বয়রি বিরাজে রাজসিংহাসন/ তুম মাটি মে লাল/ উঠো অব মাটি সে উঠো, জাগো মেরে লাল/ হট না করো, মাটি সে উঠো, জাগো মেরে লাল/ অব জাগো মেরে লাল।” আমরা পৌঁছে যাই এক বিকল্প রাজত্বে: ছোট ছোট সাংসারিক কাজ, ছোট প্রাণ, ছোট ব্যথা, ছোটখাটো দুঃখকথার রাজত্বের সত্যে। সেই রাজত্বের ভালবাসায় গড়া সিংহাসন চিরকালের মতো খালি করে দিয়ে, আমাদের সঙ্গে ঘাতকদেরও হত্যা করে চলে যায় যুদ্ধ। এ কবিতার অন্তিমে এসে অন্তত এক বার জোরগলায় উচ্চারণ করতে সাহস হয়— ‘যুদ্ধ নয়, শান্তি চাই’। কবিতার শেষে কবি তারিখ বসিয়ে দেন: অক্টোবর, ১৯৬৫। তখনও ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের আগুন ধিকিধিকি জ্বলছে, তাসখন্দ চুক্তি হয়নি। দুই দেশেরই জনমন যুদ্ধ-জিগিরে উন্মাদ। কবি পাকিস্তানি। কবিতার নাম, ‘সিপাহি কা মর্সিয়া’। সৈনিকের জন্য শোকগাথা।
কোন দেশের, কোন ধর্মের সৈনিক? কোন ভাষার? জানা নেই। জানা আছে কবির নাম, ফয়েজ় আহমেদ ফয়েজ়।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)