সে ছিল এক আশ্চর্য রোল কলের খাতা! খুলতেই চোখে পড়ে, ক’জন ছাত্রীর নামের পাশে ফাঁকা ঘরে জ্বলজ্বল করছে সদ্য-লেখা কিছু কথা। এক ছাত্রী গোটা গোটা হরফে লিখেছে, “পড়ালেখা ছেড়ে দিলাম, কাল থেকে আর স্কুলে আসব না।” কিন্তু কেন এই সিদ্ধান্ত? রোল নম্বর ২৩ গোটা গোটা হাতের লেখায় স্বীকারোক্তি দিয়েছে, “মা হতে চলেছি, স্কুল আসব কী করে?” পাতা ওলটাতেই রোল নম্বর ৩৪-এর নীল কালির অক্ষরমালা, “বাবা-মা বাইরে কাজ করতে গিয়ে নিখোঁজ, দু’বছরের ভাইকে লোকের বাড়ি কাজ করে বড় করছি। স্কুলে এলে ওকে দেখবে কে?” শেষ পাতায় রোল নম্বর ৪২-এর দ্বিধাহীন কলমে লেখা ছিল— “কীর্তনে মাথুর গাই, সিজিন চলছে। দিনে দু’শো দেয়। স্কুলে এলে বাবার চিকিৎসার খরচ মা একা চালাতে পারবে না।”
খাতায় চোখ বোলাতে বোলাতে স্পষ্ট হয়, নবম শ্রেণির কুড়ি জন কন্যা এ বছর ‘কন্যাশ্রী’ অনুদান থেকে বিদায় নিচ্ছে, ‘রিনিউ’ করাচ্ছে না। বালিকা বিদ্যালয়ের বড়দিদি এমন মুচলেকা প্রদানের ব্যবস্থা করেছেন। কেন মেয়েরা স্কুল থেকে ড্রপ আউট হচ্ছে, স্থানীয় এসডিও অফিস ‘শো কজ়’ চিঠি পাঠিয়েছিল। তার জবাবে এই নথি দাখিল করবেন বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন কন্যাশ্রীর ‘নোডাল টিচার’। তাঁর কণ্ঠে হতাশা ঝরে পড়ে। ক্লাসে যারা আসে না, তাদের ফোনেও যোগাযোগ করা যায় না। হয় ‘রং নম্বর’, নয় ‘নট রিচেবল’, একটা ফোন নম্বরও ঠিকঠাক দেয় না ছাত্রীরা। ফলে স্কুলে অনুপস্থিতির সঠিক কারণ চিরকাল অজানাই রয়ে যায়। এমনকি অভিভাবকদের স্কুল মিটিং-এ ডাকলেও দশ-বারো জনের বেশি হাজির হন না। শোনা যায়, গত বার সভাকক্ষে এক জন মা বলেছিলেন, “কাজের বাড়ি ছুটি দেয় না, ‘মিটিং আছে’ বললেই কাজ ছাড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দেয়, ম্যাম।”
আর এক পিতা আমতা-আমতা করে বলেছিলেন, তিন কন্যা তাঁর, তাই রাতের ঘুম চলে গিয়েছে। পাত্র কোনও এক কোম্পানিতে ভাল কাজ করে জেনে বিয়ে দেওয়ার সুযোগটা আর হাতছাড়া করতে পারেননি। “লজ্জায় আপনাদের ফোন ধরি না,” স্বীকারোক্তি তাঁর। আর এক অভিভাবকের হাহাকার, “পাড়াতেই মুখ দেখাতে পারি না, আপনাদের দেখাব কী করে?” ফেসবুকে প্রেম করে কৃষ্ণনগরের ছেলের সঙ্গে বাড়ি ছেড়েছে বালুরঘাটের মেয়ে। “মোবাইলটাই যত নষ্টের গোড়া,” রাগে ফেটে পড়েন অভিভাবক। “খাতা থেকে মেয়ের নামটা কেটে দিয়েন।”
ভরদুপুরের অভিভাবক-শিক্ষক মিটিংকে বিচারসভা বলে ভ্রম হয়। সভা-শেষে মনে হয়, যেন একটা শোকমিছিল স্কুল থেকে হেঁটে বেরিয়ে গেল। এ ভাবেই স্কুলে-স্কুলে গরহাজির কন্যাদের অগৌরবের সংবাদ পাঠ চলে। এ সব আমাদের চোখে পড়ে না, কানে ওঠে না। থাকে কেবল কিছু স্কুলছুটের সংখ্যা। পাড়ায়, স্কুলে কিন্তু চলে লুকোচুরি খেলা। কোনও ছাত্রী স্কুল আসে মাথার সিঁদুর মুছে, কেউ আসে পেনসিল বক্সে শাঁখাপলা লুকিয়ে। তবু সকল চিহ্ন কি মোছা যায়? অব্যক্ত সাক্ষ্য ফুটে ওঠে শরীরে। সংবাদপত্রে শিরোনাম হয়, ধরা পড়ে লজ্জায় আর স্কুলমুখো হয় না ওরা। এর পর দায়বোধ থেকে শিক্ষিকারা ছাত্রীদের বাড়ি গেলে মুখের উপর অভিভাবকের জবাব আসে, “কন্যাশ্রী ক’দিন? ভাল বর পেলে আজীবন ভাল থাকবে মেয়ে।” আজও কন্যার ভবিষ্যৎ, নিজেদের বদনামের আশঙ্কায় আক্রান্ত, আচ্ছন্ন অভিভাবকরা অকালবোধনের মতো আয়োজন করেন অকালবিবাহের।
কিন্তু স্বস্তি কি সত্যিই মেলে? কন্যাশ্রী প্রকল্পে নিয়ম, ১৮ বছর পূর্ণ হওয়ার পরেও পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া অবিবাহিত কন্যারা কে-টু ফর্মে আবেদন করলে এককালীন ২৫ হাজার টাকা পেতে পারে। সঙ্গে জুড়ে দিতে হয় অবিবাহিত থাকার শংসাপত্র। কিন্তু হায়! খবর আসে, গ্রাম পঞ্চায়েত প্রধান বা কাউন্সিলররা চোখ বুজে সই করে দিচ্ছেন সে শংসাপত্রে। অবশ্যই তার কিছু বিনিময় মূল্য রয়েছে— এ অঞ্চলে নাকি ২৫ হাজার টাকার আধাআধি বখরায় রাজি হয়ে যাচ্ছে ছাত্রীর পরিবার। ফলাফল? অকালমাতৃত্ব ঘনিয়ে-আসা নবম শ্রেণির ছাত্রী, পড়ালেখা ছেড়ে পার্লার অ্যাসিসট্যান্টের কাজে নিযুক্ত দশম শ্রেণির উজ্জ্বল মেয়ে, গোপন বিয়ের বার্তা রটে যায় ক্রমে। মা-শিশুর স্বাস্থ্যের সুরক্ষার দায় এসে পড়ে আশাকর্মী, অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদের উপর। কিন্তু দেশের আইন অনুসারে, নাবালিকার যৌন সংসর্গ মানেই ধর্ষণ। মা সাবালিকা না হলে সন্তানদের নামও তোলা যায় না অঙ্গনওয়াড়ির খাতায়। সমীক্ষার প্রতিবেদনে দিন দিন জল মিশছে, বহু মেয়ে আর তাদের শিশুসন্তান সরকারি খাতার বাইরে থেকে যাচ্ছে। ধরা পড়ছে কেবল নাবালিকা প্রসূতির মৃত্যু। সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে যত প্রসূতি মারা যাচ্ছেন, তাঁদের চার জনের এক জনই নাবালিকা। এই তো এ রাজ্যে কন্যাদের শ্রী!
একটি জেলা প্রশাসন সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবর্ষে সে জেলায় কন্যাশ্রী প্রাপকের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ লক্ষ ২১ হাজার। কিন্তু চলতি অর্থবর্ষে যে লক্ষ্যমাত্রা স্থির হয়েছে, তাতে বাদ ১১ হাজারেরও বেশি ছাত্রী। তার পরেও দেখা যায়, কন্যাশ্রী পুনর্নবীকরণ করার আবেদন আরও ৩৩২০টি কম জমা পড়েছে। তেরো বছর থেকে আঠারো বছর বয়সি (কে-ওয়ান) ছাত্রীদের মধ্যে ১৪,৭৪৪ জনের কোনও হদিস নেই। এই ছাত্রীরা দিনের পর দিন রোল কলের সময় ‘অনুপস্থিত’ বলে চিহ্নিত হয়েছে। তার পর হারিয়ে গিয়েছে স্কুল থেকে।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)