E-Paper

বাঁধ নয়, পলিমুক্তি

মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ‘ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান’-এর কাজ তিন বছরের মধ্যে শেষ করার কথা দিয়েছেন। বন্যা নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে বাংলা জুড়ে একাধিক ‘মাস্টার প্ল্যান’-এর কথা আমরা শুনে আসছি। যেমন মুর্শিদাবাদের কান্দি মাস্টার প্ল্যান, গুমানি মাস্টার প্ল্যান ইত্যাদি।

সুপ্রতিম কর্মকার

শেষ আপডেট: ২৮ জুলাই ২০২৫ ০৬:৩৩

জুন মাসে কয়েক দিন টানা বৃষ্টি হতে শিলাবতী, কংসাবতী, সুবর্ণরেখা নদীর জল বাড়ল। গড়বেতা, ঘাটালের বিরাটঅংশ প্লাবিত হল। বাঁধ-ভাঙার হাত থেকে বাঁচাতে জল ছাড়া হল। পশ্চিম মেদিনীপুর, ঝাড়গ্রাম, বাঁকুড়া, পুরুলিয়ার এক অংশও জলমগ্ন হল বাঁধ থেকে ছাড়া জলে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ‘ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান’-এর কাজ তিন বছরের মধ্যে শেষ করার কথা দিয়েছেন। বন্যা নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে বাংলা জুড়ে একাধিক ‘মাস্টার প্ল্যান’-এর কথা আমরা শুনে আসছি। যেমন মুর্শিদাবাদের কান্দি মাস্টার প্ল্যান, গুমানি মাস্টার প্ল্যান ইত্যাদি। সেগুলি রূপায়ণ কোথাও আংশিক হয়েছে, আবার কোথাও একেবারেই হয়নি। বাংলা জুড়ে বন্যাকে নিয়ন্ত্রণ করাও সম্ভব হয়নি।

বাংলাতে বন্যা নিয়ন্ত্রণের ধারা শুরু হয়েছিল চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের হাত ধরে। জমিদারেরা বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য স্থায়ী ভাবে নদীর পাড় বাঁধ দিতে আরম্ভ করল। তাতে বন্যা নিয়ন্ত্রণ হল ঠিকই, তবে অল্প সময়ের জন্য। উল্টে ক্ষতি হল নদীর। বন্যায় বয়ে আনা পলি প্লাবনভূমিতে ছড়িয়ে পড়তে পারল না। জমতে শুরু করল নদী খাতে। ক্রমশ অগভীর হতে আরম্ভ করল নদীগুলো। দামোদরের পাড়ে পাড়-বাঁধ দিয়েও নিম্ন দামোদরে বন্যা নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি। বরং দামোদরের নদী খাত গভীরতা হারিয়েছে।

প্রতি বছরে বন্যা বাংলার নদীর চরিত্রের মধ্যেই পড়ে। দামোদরের বন্যা এমনই এক স্বাভাবিক পদ্ধতি ছিল। ছোট ছোট বন্যা তখন বড় বন্যাকে নিয়ন্ত্রণ করত। দামোদরকে ‘দুঃখের নদী’ বলে চিহ্নিত করেছিলেন ভৌগোলিক হ্যামিলটন বুকানন। ব্রিটিশ ভারতের বিভিন্ন নদী বিষয়ক রিপোর্ট, যেমন ১৯৪৩ সালে বন্যা অনুসন্ধান কমিটির রিপোর্টেও দামোদরকে ‘দুঃখের নদী’ হিসাবেই চিহ্নিত করা হয়েছে। গ্রাম বাংলার মানুষেরা বরং গান বেঁধেছেন, “হেই দামোদর পায়ে পড়ি/ বান এনে দে তাড়াতাড়ি।” তাঁরা প্লাবন এলাকায় ‘মাঝের চর’, ‘পানশালি’, ‘জলবিবি’-র মতো ধান বুনতেন। বন্যা থেকে বাঁচার জন্য ‘বান হাঁক ডাঙা’ বা উঁচু জায়গা তৈরি করে রাখতেন।

মালদহের ভূতনি দিয়াড়ার মানুষেরা নদীর কাছে প্রার্থনা করতেন বন্যা আসার জন্য। নরম, নতুন পলি-বিছানো জমিতে বিনা সারে প্রচুর ফলন হত। এক কেজি কলাই বুনলে চল্লিশ মন কলাই উঠত। এই পদ্ধতিকেই সেচ বিজ্ঞানী উইলিয়াম উইলকক্স সাহেব চিহ্নিত করেছিলেন ‘প্লাবন সেচ’ বলে। কিন্তু রিং বাঁধ দিয়ে ভূতনির বন্যা নিয়ন্ত্রণ করার পর থেকেই নষ্ট হয়ে গেল এই পদ্ধতি। আধুনিক সেচ ব্যবস্থা বন্যাকে চাষের প্রতিপক্ষ করে তুলেছে।

নদীর ছন্দের সঙ্গে জীবন যাপনের অভ্যাসের সম্পূর্ণ পতন হল যখন বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য আমেরিকার টেনেসি ভ্যালির অনুকরণে দামোদর পরিকল্পনা তৈরি হল। একাধিক বাঁধ তৈরি করেও দামোদরের নিম্ন উপত্যকায় বন্যাকে নিয়ন্ত্রণ করা গেল না। তার অন্যতম কারণ, জমি-জটের জন্য দামোদরের পরিকল্পনাটি এখনও অসম্পূর্ণ। এখন আরও নতুন বাঁধ তৈরির প্রস্তাব উঠছে। যেমন, বেলপাহাড়িতে বরাকর নদীর উপর বাঁধ তৈরির একটি প্রস্তাব রয়েছে।

এই দাবি নিয়ে প্রশ্ন উঠতে বাধ্য। একটা বাঁধ সর্বোচ্চ ৪৫ বছর ঠিকঠাক পরিষেবা দিতে পারে, বলছে ‘ওয়ার্ল্ড কমিশন অন ড্যামস’-এর রিপোর্ট (২০০০)। বাস্তবে দেখা গিয়েছে, বড় বাঁধের আয়ু আরও কম। কাজেই এক দিকে পুরনো মৃত বাঁধের দল, যাদের জলধারণ ক্ষমতা তলানিতে পৌঁছেছে, অন্য দিকে প্রচুর অর্থব্যয়ে তৈরি হচ্ছে নতুন বাঁধ, যা অল্প সময়ের মধ্যেই কার্যক্ষমতা হারাবে। ফলে বন্যা পরিস্থিতি হয়ে উঠবে আরও জটিল।

সারা পৃথিবী জুড়ে ‘নো মোর ড্যামস’ বা একটিও বাঁধ নয়, এই ধারণা ক্রমশ শক্তিশালী হচ্ছে। প্রাটিক ম্যাককিউলি, হিমাংশু ঠাক্কর, আমিতা ব্যাভিসকর, প্রফুল্ল সামন্ত রায়, মেধা পাটকর প্রমুখ বাঁধ-বিরোধী আন্দোলনের উল্লেখযোগ্য মুখ। সিকিমে ‘অ্যাফেক্টেড সিটিজ়েনস অব তিস্তা’ আন্দোলনের কর্মীরা ডিজোংগুতে তিস্তার উপর জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রস্তাবিত বাঁধ নির্মাণ আটকেছেন। উত্তর-পূর্ব ভারতে বরাক নদীর উপর প্রস্তাবিত টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ বন্ধ করেছেন আন্দোলনকারীরা। কাজেই বিপুল পরিমাণ অর্থ ও উর্বর জমি নষ্ট করে বাঁধ নির্মাণ কতটা যুক্তিযুক্ত, এই প্রশ্ন উঠছে। কপিল ভট্টাচার্যের মতো নদী বিশেষজ্ঞরা প্রস্তাব করছেন যে, দামোদরের বিপুল জলের চাপকে প্রশমিত করতে মুণ্ডেশ্বরী দিয়ে জলকে প্রবাহিত করতে হবে। এ ছাড়াও দামোদরের পুরনো পথগুলো, যেমন কানা দামোদর, মজা দামোদর সংস্কারের প্রয়োজন। এই পথগুলোকে যদি বাঁচিয়ে তোলা যায়, তা হলে বাঁধ তৈরি না করেও দামোদরের জলের চাপকে প্রশমিত করা যাবে।

দামোদরের সঙ্গে জুড়ে থাকা ছোট নদীগুলো, যেমন বেহুলা, কুন্তী, জুলকী নদীর পথ ধরে বন্যার জলকে নিকাশির পথ করে দিলে নিম্ন উপত্যকায় বন্যার প্রকোপ কমবে। বন্যা নিয়ন্ত্রণে সবচেয়ে জটিল ও কঠিন বিষয় হল অববাহিকা জুড়ে পলি নিয়ন্ত্রণ। এক সময় দামোদরের সেচের খালগুলোকে কিছু বছর অন্তর পলিমুক্ত করা হত। তাতে বন্যার জল অনেকটাই ছড়িয়ে যেত। স্থানীয় পরিবেশকর্মীদের দাবি, ২০০৮-২০০৯ সালের পর থেকে পলি পরিষ্কারের কাজ একেবারেই বন্ধ হয়ে গিয়েছে। কারণ, পলি পরিষ্কারের জন্য কেন্দ্রীয় বরাদ্দ তলানিতে। দামোদর, শিলাবতী, দ্বারকেশ্বর সর্বত্র পলি নিয়ন্ত্রণ অবহেলিত। এক সময় ডিভিসি অববাহিকা জুড়ে পলি নিয়ন্ত্রণের কাজ করত। এখন সেই কাজ আর দেখা যায় না।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

DVC Ghatal Master Plan

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy