E-Paper

আলোয় ফেরানোর অঙ্গীকার

সদিচ্ছা, দায়িত্ববোধ, ভালবাসা থাকলে উপায়ও থাকে। বিশেষ নিয়ম তৈরি করা যায়— নিজেদের স্কুলেই পরীক্ষা দেওয়ার, শিক্ষা দফতর না হয় পরিদর্শক পাঠাবে।

মৃন্ময় প্রামাণিক

শেষ আপডেট: ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ০৭:০৫

আলিপুরদুয়ার জেলার ভুটান সীমান্তে টোটো জনজাতিদের গ্রাম টোটোপাড়া। মাত্র ১৬০০-র কিছু বেশি জনসংখ্যা ওঁদের। এই গ্রামের স্কুলে প্রতি বছর পড়ুয়ার সংখ্যা কমছে। টোটো, সাদরি, নেপালি, বিহারি, বাঙালি মিলে ২০২২-এ যেখানে তিনশোর কাছাকাছি ছাত্রছাত্রী ছিল, ২০২৫-এ সেই সংখ্যাটা ১২০ মতো। কোথায় গেল সবাই? ভিন রাজ্যে পরিযায়ী শ্রমিক হয়ে চলে যায় এরা। এ বছর মাধ্যমিকে ৩২ জন পরীক্ষার্থীর সকলেই অকৃতকার্য। প্রধান শিক্ষক-সহ শিক্ষকসংখ্যা মাত্র চার! টোটোদের বাংলা শেখার কোনও সুযোগ নেই, কিন্তু সাহিত্য, বিজ্ঞান ইত্যাদির মতো জটিল বিষয় তাঁদের পড়তে, বুঝতে ও লিখতে হয় বাংলা ভাষাতেই। শিক্ষার পুরো কাঠামোটিই তাদের কাছে ভয়ের, অসহায়তার।

অনগ্রসর কল্যাণ দফতরে চাকরিরত সনজিৎ টোটো বুঝিয়ে বললেন এই ভাষা সমস্যার কথা। “ধরুন, ‘ভেক্টর রাশি’, এই কথাটাই ওরা বুঝতে পারছে না, তা হলে বিষয়টা বুঝবে কী করে!” স্কুলের এক শিক্ষক বললেন, “আমরা ছাত্রছাত্রীদের ভাষা বুঝি না, ওরা আমাদের ভাষা বোঝে না। কোনও রকমে উত্তরপত্র মূল্যায়ন করতে হয়, আমরা বোঝার চেষ্টা করি ওরা বিষয় বা তার ধারণাটুকু ধরতে পেরেছে কি না।” বিজ্ঞান, ইতিহাস, ভূগোল পড়াতে এসে বাংলা ভাষা শেখানোর সুযোগ থাকে না; হাতে ধরে বাংলা শেখাতে গেলে শিক্ষকের প্রয়োজন— স্কুলে শিক্ষক নেই।

মাধ্যমিক পরীক্ষাকেন্দ্র মাদারিহাট। সেখানে পৌঁছতে ওদের ‘রাস্তাহীন রাস্তা’ পেরোতে হয় প্রায় ছয় কিলোমিটার। পাহাড়ের গায়ে যাদের বাড়ি, পাহাড়ি পথ বেয়ে নেমে সকালে শহরে যাওয়ার একটাই বাস, ধরতে না পারলে পরীক্ষাও অধরা। বাসভাড়া যেতে চল্লিশ, আসতে চল্লিশ টাকা— কোথায় পাবে সবাই? এত দুশ্চিন্তা নিয়ে, এত দূরের পথ পেরিয়ে পরীক্ষা দিতে যেতে হচ্ছে, এ কি অত্যন্ত অবিচার নয়? ফেরার বাসও একটাই, দুপুরে।

এত কষ্টে পরীক্ষা দেওয়ার পর সেই খাতা বাঙালি ঘরের সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারে ধনী, আর পাঁচ জন বাঙালি পরীক্ষার্থীর সঙ্গেই মূল্যায়ন করা হয়। পরীক্ষার ফল ভাল হওয়ার কথাও নয়। অথচ, এই ছাত্রেরা পড়তে চায়, শিখতে চায়, স্বপ্ন দেখে হাজারো প্রতিবন্ধকতা সয়েও। পঞ্জাবি দলিত লেখক বলবীর মাধোপুরি তাঁর আত্মজীবনীর নাম রেখেছিলেন ছাঙ্গিয়া রুখ, যার অর্থ নিয়মিত মাথা কেটে-ছেঁটে ছোট করে রাখা। সংখ্যাগরিষ্ঠের স্বার্থপর রাষ্ট্রব্যবস্থা জনজাতিদের এ ভাবেই ছেঁটে রাখে।

মানুষের করের টাকায় আমাদের মতো সুবিধাভোগী শ্রেণির শিক্ষা, গবেষণা, নাম, যশ। যাঁদের করের টাকা গুছিয়ে সরকার আমাদের দেয়, তাঁদের কথা জানানোর দায় আমাদের থাকে। সরকার কি শুধু ভোট পেয়েই দায় ঝেড়ে ফেলবে? একটি জনজাতির নতুন প্রজন্ম তার ভাষা-সংস্কৃতি সুপ্রাচীন জ্ঞানতত্ত্বের ঐতিহ্য হারিয়ে স্রেফ শ্রমজীবী বনে যাচ্ছে, সরকারের কি কোনও দায়িত্ব নেই? এদের শিক্ষার সুযোগ, উত্তরাধিকার বহন করার সুযোগ কি সরকার দেবে না? স্কুলে ফেরাবে না, স্কুল বাঁচাবে না?

সদিচ্ছা, দায়িত্ববোধ, ভালবাসা থাকলে উপায়ও থাকে। বিশেষ নিয়ম তৈরি করা যায়— নিজেদের স্কুলেই পরীক্ষা দেওয়ার, শিক্ষা দফতর নাহয় পরিদর্শক পাঠাবে। সবচেয়ে ভাল হত টোটো ভাষাতেই শিক্ষার ব্যবস্থা করতে পারলে, কিন্তু সে তো আয়াসসাধ্য, সময়সাপেক্ষ কাজ। তা হলে উপায়? উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্রন্থাগারবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর পাশ করেছেন ধনঞ্জয় টোটো; ভরত টোটো যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে স্নাতকোত্তর, দিব্যা টোটো এডুকেশনে। এঁরা কি কর্মসংস্থানের যোগ্য, অন্তত বিবেচ্যও নন?

‘রূপমকে একটা চাকরি দিন’— এই আবেদন যখন করা হয়েছিল, তখন রাজ্যে ‘আহ্লাদে আটখানা’ সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। এখন বেড়ে হয়েছে ৩৭টি, আরও হব-হব। এখন কেবলই চাকরি যায়, কেউ রূপমদের চাকরি দিতে বলে না। টোটোপাড়ার স্কুল ‘ধনপতি টোটো স্মৃতি বিদ্যালয়’-এ, ওঁদের নিজেদের গ্রামের বিদ্যালয়েই বিশেষ নিয়ম তৈরি করে ওঁদের চাকরি দিলে সুদূরপ্রসারী ফল ফলতে পারে। ভাষা সমস্যা অনেকটা মিটবে, কারণ টোটো শিশুদের ভাষা ওঁরা জানেন। দুর্গম দুস্তর পথ পেরিয়ে ওঁরা উচ্চশিক্ষা করেছেন, তারও তো মর্যাদা আছে। অনেকটা দেরি হয়ে গেছে, প্রত্যন্ত এক গ্রামে নিরাশার অন্ধকারে ওঁদের হারিয়ে যেতে দেওয়া চলে না।

উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিই বা ওঁদের কাছে কেন যাবে না? বাংলার তরুণ গবেষকদের দিয়ে কেন হবে না টোটো সাংস্কৃতিক পাঠের অনুবাদ ও সংরক্ষণের কাজ, প্রকল্প, ক্ষেত্রসমীক্ষা? একেবারে যে হয়নি তা নয়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুবাদ ও সাহিত্যিক ভূগোল কেন্দ্র এবং ভারতীয় সমাজবিজ্ঞান অনুসন্ধান পরিষদের উদ্যোগে গত অগস্টে ধনপতি টোটো স্মৃতি বিদ্যালয়ে হয়েছে টোটো শিশুদের সৃষ্টিশীল রচনা ও ছবি আঁকার কর্মশালা। বছর তিন আগে ‘ক্যালকাটা কম্পারেটিস্টস ১৯১৯’ গবেষণা-গোষ্ঠীর উদ্যোগে, ‘তৃতীয় পরিসর’ প্রকাশনা থেকে বেরিয়েছে বই টোটোপাড়ার ছোটরা— টোটো ছাত্রছাত্রীদের নিজেদের লেখালিখির সঙ্কলন। তার প্রকাশ অনুষ্ঠান হয়েছিল ওই স্কুলেই। শুধু কি ওদেরই দায় আলোয় আসার— আমাদের, আলোকিতদের দায় নেই?

তুলনামূলক ভারতীয় ভাষা ও সাহিত্য, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Education India-Bhutan Border

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy