E-Paper

নড়বড়ে সেতুই একমাত্র ভরসা?

এই বৃষ্টিতে পশ্চিমবঙ্গের পাহাড়ে, সমতলে বিপর্যয় নেমে এসেছে, অনস্বীকার্য। কিন্তু তেমন বিপর্যয় এ দেশে নতুন নয়, বিশেষত বদলে যাওয়া বৃষ্টিপাতের চরিত্রের নিরিখে।

পৌলমী দাস চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৯ অক্টোবর ২০২৫ ০৭:৩৪
তোর্সার শাখা হোলং নদীর জলে ভেঙ্গে গেল মাদারিহাট থানা সংলগ্ন হোলং নদীর জলদাপাড়া জাতীয় উদ্যানের একমাত্র কাঠের ব্রিজটি।

তোর্সার শাখা হোলং নদীর জলে ভেঙ্গে গেল মাদারিহাট থানা সংলগ্ন হোলং নদীর জলদাপাড়া জাতীয় উদ্যানের একমাত্র কাঠের ব্রিজটি। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হল মাদারিহাট। আটকে পড়লো শতাধিক পর্যটক।সকাল অবধি ঝুলে থাকার পর অবশেষে সেতুর একাংশ ভেঙ্গে গেল।

কাঠের সেতুর উপর দিয়ে গাড়ি এগোলেই সামনে ভেসে ওঠে রাস্তা আগলে দাঁড়িয়ে থাকা জলদাপাড়া টুরিস্ট লজ-এর কাঠামোটা। বছর তিনেক আগে টুরিস্ট লজে থাকাকালীন সেই সেতুর উপর দিয়ে হেঁটেছি, ছবি তুলেছি। সূর্যাস্তের আলো এক অদ্ভুত মায়াবী চাদর ছড়িয়ে দেয় জঙ্গলে। শীত-শেষে ব্রিজের নীচের অংশে তখন কেবলই মরা নদীর খাত, শেষ সূর্যের কমলা রং ছড়িয়ে যায় সেই অবধি। সম্প্রতি এক রাতের প্রবল বর্ষণে সেই খাতেই নদী ফুঁসে উঠে ভেঙে দিয়েছে সেতুটিকে। টুরিস্ট লজে পৌঁছনোর একমাত্র রাস্তাটিকে। আটকে পড়া পর্যটকদের উদ্ধার করা হয়েছে প্রথমে হাতির পিঠে চাপিয়ে, শেষে পে-লোডারে বসিয়ে। দুরন্ত নদী পেরিয়ে কী অসম্ভব ভয় সঙ্গী করে তাঁরা নিরাপদ দূরত্বে পৌঁছেছেন, অনুমানে অসুবিধা হয় না।

অথচ, তিন বছর আগেও কাঠের সেতুর বিবর্ণ দশাটি চোখ এড়ায়নি। বহু ব্যবহারে জীর্ণ, এবড়ো-খেবড়ো কাঠের পাটাতন আর অযত্নের শেওলা মাড়িয়েই টুরিস্ট লজে ঢুকেছে পর্যটকদের গাড়ি, ছোট বাসও। কেন এক বারও ভাবা হয়নি এই সেতু যদি কখনও ভেঙে যায়, তবে আটকে পড়া পর্যটক, হোটেল কর্মীদের উদ্ধার করার কাজটি কী ভয়ঙ্কর কঠিন হয়ে দাঁড়াবে? জলদাপাড়া টুরিস্ট লজ জঙ্গল-প্রেমীদের ভারী পছন্দের। যত্নচর্চিত বাগানে ঘেরা, সরকারি আতিথ্যে মোড়া পরিবেশে দিনকয়েক থেকে জঙ্গলকে অনুভব করতে চান বহু পর্যটক। তা এত দিন হয়ে এসেছে শুধুমাত্র ওই নড়বড়ে কাঠের সেতুর ভরসায়? ডুয়ার্সে ভারী বৃষ্টি, বন্যা কোনওটাই নতুন নয়। তেমনটি হলে টুরিস্ট লজ কিছু কালের জন্য বন্ধ করে দেওয়াটাই কি একমাত্র সমাধান?

এই বৃষ্টিতে পশ্চিমবঙ্গের পাহাড়ে, সমতলে বিপর্যয় নেমে এসেছে, অনস্বীকার্য। কিন্তু তেমন বিপর্যয় এ দেশে নতুন নয়, বিশেষত বদলে যাওয়া বৃষ্টিপাতের চরিত্রের নিরিখে। অল্প সময়ে অত্যধিক বৃষ্টি— এমনটাই তো গত কয়েক বছরের নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই মরসুমেই বন্যায়, বৃষ্টিতে তোলপাড় হয়েছে উত্তরাখণ্ড, হিমাচল প্রদেশ, জম্মু-কাশ্মীর, একাধিক বার। পড়শি রাজ্য সিকিমে স্তব্ধ, বিপন্ন হয়েছে পর্যটন। সেই তুলনায় এ রাজ্যে পাহাড়, ডুয়ার্সে বিপর্যয় নেমেছে অনেক পরে। এত দিনেও তা হলে কেন কোনও শিক্ষাই নেওয়া গেল না? যে পরিমাণ বৃষ্টিতে কলকাতার মতো সমতল এলাকা, রাজধানী শহর তছনছ হতে পারে, সেই বৃষ্টি পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নামলে কোন ভয়ানক পরিস্থিতি তৈরি করবে, তা অনুমান করা কি খুব কষ্টকর? অতি ভারী বৃষ্টির পূর্বাভাস পাওয়ার পরই বিপজ্জনক জায়গা থেকে মানুষকে সরিয়ে আনা তো আদৌ কঠিন কাজ ছিল না। ভরা পর্যটন মরসুমে স্থানীয় প্রশাসন তবে কী করছিল?

আমরা যারা পাহাড় ভালবাসি, প্রতি বছর এক প্রবল চুম্বক-টানে ছুটে যাই সে-দিকে, তারা এখন সম্পূর্ণতই ভাগ্যের হাতে নিজেদের সঁপে দিয়ে ব্যাগ গোছাতে বসি। পাহাড়ের বৃষ্টি কানে মধুর ধ্বনি তোলে না, বরং আতঙ্কে নির্বাক করে দেয়। মনে হয়, ঘুম থেকে উঠে ভোরের সূর্য দেখতে পাব তো? তিরতিরে পাহাড়ি নদী সহসা দানব-রূপ ধরে সব মুছে দেবে না তো? অথচ, রাজ্য সরকারগুলি এক অদ্ভুত উদাসীনতায় পুরোটাই অগ্রাহ্য করে যায়। পাহাড়ে পর্যটনের দৃষ্টিনন্দন বিজ্ঞাপনে পর্যটক টানে, সেই রাজস্বে কোষাগার ভরে, অথচ পর্যটকদের জীবনের ন্যূনতম নিরাপত্তার আশ্বাস দেয় না। উত্তর সিকিম যেমন। সিকিমের পর্যটন মানচিত্রে উত্তর সিকিম নিয়ে আদিখ্যেতার শেষ নেই। অথচ, বিপুল সংখ্যক পর্যটককে জায়গা দেওয়ার পরিকাঠামোটাই সেখানে নেই। লাচুং-এ নদীর ঘাড়ের উপর গড়ে উঠেছে গুচ্ছ গুচ্ছ হোমস্টে, বিপজ্জনক ভাবে। সম্প্রতি বার বার ভয়ঙ্কর বিপর্যয় নেমে এসেছে সিকিমের এই অংশটিতে। তার পরেও কি সিকিম সরকার সেখানে পর্যটনকে নিয়ন্ত্রণ করেছে? যখন রাস্তা ভাঙে, পারমিট দেওয়া কিছু কাল বন্ধ থাকে, এ মরসুমেও যেমন থেকেছে। তার পর ফিরে আসে সেই পুরনো চিত্র, আবার একটা বিপর্যয়ের অপেক্ষা।

এ রাজ্যের চটকপুর দার্জিলিঙের কাছেই সেঞ্চল অভয়ারণ্যের মধ্যে গড়ে ওঠা এক খণ্ড স্বর্গ। অভয়ারণ্যের প্রবেশমূল্য যথেষ্ট বেশি। কিন্তু রাস্তা ভয়ানক। আসলে রাস্তা বলতে কিছুই নেই, জঙ্গল চিরে পাথরবিছোনো এক আঁকা-বাঁকা পাহাড়ি পথ, যাতে গাড়িতে চলার চেয়ে পায়ে হাঁটা অধিক স্বস্তিদায়ক। সে পথ সারানোর সদিচ্ছাটুকু কারও নেই। অথচ, যথেষ্ট সংখ্যক হোমস্টে এখানে, পর্যটকদের আনাগোনা লেগেই থাকে। সাম্প্রতিক বৃষ্টিতে প্রবল ক্ষতিগ্রস্ত সোনাদা। কে জানে কেমন আছে চটকপুর?

জলবায়ু পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে বার বার সুস্থায়ী উন্নয়নের কথা শোনা গিয়েছে। শোনা গিয়েছে পরিবেশবান্ধব পরিকাঠামো গড়ে তোলার কথাও। কিন্তু এই দেশ এখনও তা ভাবে না। সে ‘উন্নয়ন’-এ মন দিয়েছে। ভূ-প্রকৃতিগত ভাবে সংবেদনশীল পাহাড়ের উপর হেলিকপ্টার নামার জায়গা করে, টানেল তৈরি করে, পাহাড়ি নদীতে একের পর এক বাঁধ দিয়ে, গাছ উপড়ে, চওড়া রাস্তা বানিয়ে অবিরাম চলছে সেই উন্নয়নের স্রোত। পরিবেশ-ভাবনা সেই স্রোতের সামনে দাঁড়াতে পারেনি, পারবেও না ভবিষ্যতে। কিন্তু অবিলম্বে মানুষের জীবন বাজি রাখার প্রবণতা বন্ধ হোক। প্রত্যন্ত স্থানে, যেখানে সহজে উদ্ধারকাজ চালানো সম্ভব নয়, সেখানে পর্যটকদের যাওয়া আটকানো হোক। অথবা, বিকল্প একাধিক পথের ব্যবস্থা রাখা হোক। খারাপ আবহাওয়ার পূর্বাভাস থাকলে দ্রুত স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে বিপজ্জনক এলাকা থেকে স্থানীয় মানুষ, পর্যটকদের সরিয়ে আনা হোক। প্রতিটি পর্যটন স্থলের যাতায়াতের রাস্তাটিকে পাকাপোক্ত করা হোক, যাতে কোনও নড়বড়ে সেতু, জোড়াতালি দেওয়া রাস্তা একমাত্র ভরসাস্থল না হয়ে ওঠে। যত ক্ষণ না তার ব্যবস্থা হয়, তত ক্ষণ সেখানে মানুষের যাতায়াতও বন্ধ হোক।

সারা বছরের পরিশ্রমে ক্লান্ত, বিষণ্ণ মন জুড়োতে আমরা পাহাড়ে যাই দু’দণ্ড শান্তির খোঁজে। সেই শান্তিটুকুর ব্যবস্থা অন্তত করুক প্রশাসন। আপাতত।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

North Sikkim tourism

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy