কোভিড-পূর্ব সময়ের এক রোদ ঝলমলে শীতের দুপুরের কথা। স্কুলের দু’-ক্লাস উঁচুতে পড়া সিনিয়র দাদা পরবর্তী কালে এসে গ্রামীণ হাসপাতালের সুপারের দায়িত্বে আসীন, তারই চেম্বারে বসে চা আর বিস্কুট সহযোগে কথা চলছিল। স্কুলের কথা, এটা ওটা কথায় যেমন আড্ডা হয় আর কী! কথায় কথায় প্রশ্নটা টেবিলে উঠে এল— আচ্ছা, জেলা হাসপাতালে যে তরুণ বা তরুণী হাউসস্টাফ হিসেবে কাজ করে এল, গ্রামীণ হাসপাতালে মেডিক্যাল অফিসার হিসেবে নিযুক্ত হওয়ার পর সে রোগীকে আবার জেলা হাসপাতালে রেফার করবে কেন? দেখা যাবে রাতে ডিউটিতে থাকাকালীন জেলা হাসপাতালে বসে সে এ রকম অনেক সমস্যা সমাধান করেছে। তবে কেন?
গ্রামীণ হাসপাতালের সুপারের উত্তর— দেখো ভাই, এখানে যে মেডিক্যাল অফিসার হিসেবে কাজে জয়েন করল, এত দিন সে কাজ করে এসেছে জেলা হাসপাতালের উন্নততর পরিকাঠামোয়। যে জন্যে সে রেফার করছে, ওই কাজটা এখানে বসে সে একটু সময় নিয়ে চেষ্টা করলে হয়তো করে ফেলতেই পারবে, কিন্তু সেটা করতে গিয়ে যদি কোনও জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, আর তার ফলে অপারেশন করার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়, তা হলে কী হবে? জেলা হাসপাতালে সেই সুবিধা ছিল, কিন্তু এই গ্রামীণ হাসপাতালে অপারেশন থিয়েটার কোথায়?
শুধু তা-ই নয়, আরও অনেক দিক আছে। যে সময়টা সে ওই কাজে নিজেকে জড়িয়ে রাখবে, সেই সময় ইমার্জেন্সিতে অন্য কোনও জটিলতর সমস্যা নিয়ে কোনও রোগী উপস্থিত হলে কী হবে? অথবা দুর্ঘটনার কবলে পড়ে আহত হওয়া এক বা একাধিক মানুষ ইমার্জেন্সিতে উপস্থিত হলে কী হবে? অন্য যে সব রোগী ভর্তি আছেন তাঁদের কারও পরিস্থিতি জটিল হলে, অথবা প্রসূতি বিভাগে কারও অবস্থার অবনতি হলে তখন কী হবে?
এর পর সময় গড়িয়েছে। এসেছে কোভিডের কাল। সমস্ত আলো ও আগ্রহ গিয়ে পড়েছে তারই উপর। অন্যান্য রোগের চিকিৎসা কিছুটা পিছনের সারিতে চলে গেছে। এক, দুই, আড়াই নম্বর ঢেউ পার করে আবার দৈনন্দিন চিকিৎসা ব্যবস্থার হাল-হকিকত নতুন করে সাজাচ্ছে স্বাস্থ্য দফতর। সম্প্রতি স্বাস্থ্য দফতরের তরফ থেকে নতুন নির্দেশিকা জারি হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে রোগী রেফার করার অভ্যাস কমাতে হবে। কিন্তু, কোভিড-পরবর্তী কালে পরিকাঠামোর কোনও বদল হয়েছে কি?
গ্রামীণ হাসপাতালগুলিতে ডাক্তারদের সংখ্যা কত হবে গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকে তা জরিপ করা হয়েছিল। সেই জরিপ অনুযায়ী নির্দিষ্ট সংখ্যা দিয়ে এখনও গ্রামীণ হাসপাতাল চলছে। অথচ অনস্বীকার্য যে, ইতিমধ্যে জনসংখ্যা অনেক বেড়েছে। নব্বইয়ের দশকের সেই জরিপ থেকে নির্ণয় করা সংখ্যারও প্রায় অর্ধেক ডাক্তার নিয়ে গ্রামীণ হাসপাতালগুলি চলছে। নির্দেশিকায় বলা হয়েছে কোনও হাসপাতালে এক জন মেডিক্যাল অফিসারের ডিউটির সময় কখনওই সপ্তাহে চল্লিশ ঘণ্টার কম হতে পারে না। বরং পরিস্থিতির দাবি মেনে চল্লিশ ঘণ্টার বেশি হতে পারে। স্বাস্থ্য দফতরের ওই নির্দেশিকায় একটি মডেল সূচি তৈরি করে দেওয়া হয়েছে, যেখানে বলা হয়েছে দু’জন ডাক্তারবাবু সমবেত ভাবে রাতে ডিউটি করবেন। কারা কোন দিন ডিউটিতে আছেন সেটি মুদ্রিত আকারে হাসপাতালে নির্দিষ্ট জায়গায় লাগানো থাকবে, যাতে রোগী এবং তাঁর পরিবার সেটি সম্পর্কে অবহিত হতে পারেন।
স্বচ্ছতা যে কোনও প্রশাসনেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই ধরনের উদ্যোগ গ্রামীণ স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ক্ষেত্রে সেই স্বচ্ছতা আনতে পারে। কিন্তু প্রশ্ন হল— সীমাবদ্ধ পরিকাঠামো এবং প্রায় অর্ধেক কর্মক্ষমতা নিয়ে চলা গ্রামীণ হাসপাতালগুলির পক্ষে এই নির্দেশ কার্যকর করা কত দূর সম্ভব। এ ছাড়া, সপ্তাহে চল্লিশ ঘণ্টার অতিরিক্ত সময় ডিউটি করলে স্বাস্থ্যকর্মীদের আবাসন ইত্যাদি বিষয়ে যে পরিমাণ সুবিধা ও সুব্যবস্থার জোগান দেওয়া উচিত, গ্রামীণ হাসপাতালগুলির পরিকাঠামো কোথাও কোথাও তার বিপক্ষে কথা বলে। বিভিন্ন গ্রামীণ হাসপাতালে ডাক্তার নার্স-সহ বিভিন্ন স্তরের স্বাস্থ্যকর্মীদের পর্যাপ্ত আবাসন নেই। কোথাও আবার ভগ্নপ্রায় ও বাতিল।
এটি কোনও নির্দিষ্ট সরকার বা রাজনৈতিক দলের উপর দায়িত্ব চাপিয়ে হাত ঝেড়ে ফেলার ব্যাপার নয়। সরকারি নির্দেশনামা তবু দফতরে থাকে। ক্রমশ উপর থেকে নীচে সেই নির্দেশ বয়ে যায় ভিতরে ভিতরে। কিন্তু প্রকাশ্য সভা থেকে আসা জনমোহিনী কোনও সরকারি নির্দেশ জনগণের মনে বিপুল প্রত্যাশার সৃষ্টি করে, যার চাপ এসে পড়ে সিস্টেমের তৃণমূল স্তরে। যে রোগী গুগল দেখে ডাক্তারবাবুকে প্রশ্ন করতে চান, সরকারি নির্দেশিকার পিডিএফ কপি দেখিয়ে তিনি অবশ্যই তাঁর প্রাপ্য বুঝে নিতে চাইবেন। গ্রামীণ হাসপাতালের সীমাবদ্ধ পরিকাঠামো এবং কর্মক্ষমতার কথা বুঝতে চাইবেন না— এটাই স্বাভাবিক। তাই মঞ্চের উপর থেকে প্রকাশ্য সভায় জনমোহিনী কোনও নির্দেশ দেওয়ার আগে কর্মক্ষমতা এবং পরিকাঠামোর এই রূঢ় বাস্তব নিয়ে কিছু ভাবনাচিন্তা আবশ্যক বলে মনে হয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy