রাত বারোটায় ঢং করে ঘণ্টা পড়লে সিন্ডারেলাকেহুড়মুড় করে বাড়ি পৌঁছতে হত। আর আমার বাড়ির ঘড়ি সাড়ে সাতটা বাজলেই হাকড়-পাকড় করে সাড়ে বারোটা হয়ে যাচ্ছে।
বলেন কী, এত ফাস্ট!
ফাস্ট কী মশাই? ‘পবআস’ তো চালু হয়ে গিয়েছে।
সেটা কী? ‘পশ্চিমবঙ্গ আদর্শ সময়’। মুখ্যমন্ত্রী বললেন যে রাত সাড়ে বারোটায় মেয়েটি কেন বেরোল? সেই থেকে তো রাত সাড়ে সাতটা হয়ে গেল রাত সাড়ে বারোটা। এখন এই নিয়মেইচলতে হবে।
আর কী কী নিয়ম হয়েছে বলুন তো? নিজেকে তো রিপ ভ্যান উইঙ্কল মনে হচ্ছে। একটা শতক ঘুমিয়ে নিয়ে উঠে যেন দেখচি, জগৎ বদলে গিয়েছে।
একদম ঠিক। এই যেমন পশ্চিমবঙ্গে মেয়েদের রাতে বেরোনো বন্ধ হয়ে গেল, বাঁধগুলো ভেঙে সব মন্দির হয়ে গেল আর দিল্লি তালিবান দখল করে নিল। মহিলা সাংবাদিকদের প্রেস কনফারেন্সে ডাকলই না।
বলেন কী? দিল্লি তালিবান দখল করে নিয়েছে?
হ্যাঁ। আপনি সত্যিই ঘুমোচ্ছিলেন। তালিবান আর তার ভাই হিন্দুবলবান দখল করে নিয়েছে। দেখছেন না, তার জেরে পশ্চিমবঙ্গে মশারা পর্যন্ত সুর বদলে ফেলেছে। আগে ভনভন করত, এখন মুসলমান মুসলমান করে, বাড়ির রং নীল সাদা আর গাছের পাতার রং গেরুয়া।
গেরুয়া! পাতাগুলো লাল হলুদ তো হেমন্তে হয়, বিদেশে সকলে ‘ফল’ ‘ফল’ বলে নাচানাচি করে।
না রে বাবা, সত্যিই দেখছি নিদ্রা দিয়েছিলেন কুম্ভকর্ণের মতো। এই দেশে মানুষ এখন দু’রকম, হিন্দু আর মুসলমান। ফলে তৃণমূলের মিছিল থেকে ছোড়া বোমায় একটা শিশু মরে গেল কিন্তু ন্যাত্যারা তার ধারেকাছ দিয়ে গেলেন না, কারণ শিশুটি মুসলমান, কিন্তু ধর্ষণের ঘটনায় অভিযুক্তদের চার জন মুসলমান হওয়ায় প্রতিবাদ জানাতে বসে গেলেন। এমনকি যেখানে যেখানে অভিযুক্ত মুসলমান সেখানে নির্যাতিতার সাকিন পর্যন্ত আইন ভেঙে বলে দিলেন অথচ আর একটি অভিযুক্ত যে হিন্দু তা বেমালুম চেপে গেলেন। চোর মুসলমান, ডাকাত মুসলমান, জঙ্গি মুসলমান, দেশদ্রোহী মুসলমান, ধর্ষক সব ক’টা মুসলমান। অপরাধ— দুর্নীতি, আইনশৃঙ্খলা, শিক্ষা বেচা সব গেল জলে, কারণ এগুলো নিয়ে বললেই পাল্টা প্রশ্ন শুনতে হবে, তির আসবে নিজেদের দিকে। তাই ধর্ম, ধর্ম ধর্ম ধর্ম করে ভনভনানি। আর ভনভনানির এমন জের যে মশা নিজেকে মনে করতে লাগল বাঘ।
মশাই আপনি কী উল্টোপাল্টা বকছেন? কিছু খেয়েছেন না কি। মশা কী ভাবে বাঘ হবে? ইঁদুর নিজেকে ভেবেছিল সিংহ। উল্টোপাল্টা বলার অভ্যাস কি বঙ্গে নতুন ভাইরাস?
খেয়েছি ভাই খেয়েছি। এক দিকে জর্জিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, আর এক দিকে ওয়টস্যাপ বিশ্ববিদ্যালয়, দুইয়ে মিলে এমন পাতার পর পাতা গিলিয়েছে যে পেটে গজগজ করলেও আমার দৃষ্টি এখন জলের মতো স্বচ্ছ। দুনিয়াটা আমি পোস্কার দেখতে পাচ্ছি। ভারত যে ২০১৪ সালে স্বাধীন হয়েছে, সে আমার জানতে বাকি নেই।
ভারত আবার ২০১৪ সালে স্বাধীন হল কবে?
নিজের মাথাটা ঝামা দিয়ে ঘষে আগে পরিষ্কার করুন। ইতিহাস নতুন করে লেখা হচ্ছে। দামোদর সাভারকর হয়ে গিয়েছেন স্বাধীনতা সংগ্রামী, আর ২০১৪-র আগে ভারত ছিল একটি জঙ্গুলে জায়গা। ২০১৪ সাল থেকেই তো ভারতীয় সভ্যতা শুরু। সব পটাপট তৈরি হয়ে গিয়েছে মায়াদানবের হাত ধরে।
অ, তা মশা বাঘ হল কী করে?
বুম চেনেন বুম? মশার মুখের কাছে বুম ধরুন, ওই ভনভনভনভন কেমন জোরে জোরে বাজবে আপনার কানে। আর পুরসভা মশা মারার কোনও ব্যবস্থাই করে না, ফলে মশার বৃদ্ধি হয়েই চলেছে। এ হেন মশার দল যদি সাংবাদিকের বুমের সামনে একযোগে গলা ফুলিয়ে মুসলমান মুসলমান করতে থাকে, তাকে গর্জনের মতো শোনায় কি না? ফলে মশা ভাবছে আমি বাঘ, ভেবে ভেবে ল্যাজ আছড়াচ্ছে। কাশ্মীর যাচ্ছে না, মুসলমান বেশি বলে। প্রসাদ খাচ্ছে না যদি মুসলমানের দোকান থেকে ফল, মিষ্টি আসে! আবার ঘাস, পাতা সব কাটতে শুরু করেছে সবুজ বলে, শুনলাম চাঁদ তারাও নাকি দেখছে না পাছে পাকিস্তানের পতাকা মনে হয়।
তা হলে, জাতীয় পতাকার কী হবে? সেখানেতো সবুজ।
আপনাকে আর মানুষ করতে পারছি না দেখছি। উপরে গেরুয়া, মাঝখানে বিষ্ণুর চক্র। ওতে পাপ ধুয়ে য়াচ্ছে।
কী ভুল বকছেন? ও তো বিজেপির গেরুয়া নয়, আর বিষ্ণু চক্রও নয়। ওটি তো অশোকচক্র।
ধুর মশাই কে আপনার অশোক? বলছি না, ইতিহাস লেখা হয়েছে সবেমাত্র। মোদী-অব্দের আগে ভারতে কিসুই ছিল না। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডই ছিল কি না সন্দেহ। বিরিঞ্চিবাবা ওঠওঠওঠ বললে সূর্য ওঠে, যা যা যা বললে মেঘের আড়াল থেকে ক্ষেপণাস্ত্র, বোমা সব পাকিস্তানের জঙ্গিঘাঁটিতে গিয়ে পড়ে। বাংলা ভাষা হয়ে গিয়েছে বাংলাদেশি ভাষা। হিন্দু-হিন্দি-হিন্দুস্থান। বাঙালি গায়কগায়িকারাও একটি নিখাদ বাংলা গান জ্যানোগ্যানো মন অধিনায়ক জ্যায়ো হে বলে গাইছে।
আমি জেগে ঘুমনোর সময় আর কী কী বদল হয়েছে বলুন তো?
মানুষের শরীর কাটলে টাকা বেরোচ্ছে।
সে কী?
দেখছেন না, মানুষ মরলেই টাকা, যা-ই ঘটুক টাকার তোড়া চলে আসছে। আবার নিলাম হচ্ছে।
মানুষের নিলাম?
হ্যাঁ। কে কত টাকা দিয়ে কাকে কিনবে। এখানেও হিন্দু, মুসলমান দরে ফারাক। উনিজি হিন্দু ছাড়া কিনবেন না, ইনিজি সকলকেই কিনবেন। পথশ্রী রয়েছে, কিন্তু পথে বাতি নেই, স্কুল আছে, শিক্ষকশিক্ষিকা নেই, মিড-ডে মিল আছে, তাতে খাবার নেই। ধর্ষণ হলে কোন ধর্ম, কোন দল? ধর্ষকেরও রং আছে। নীল সাদা হলে ধর্ষণ হয়ইনি, গেরুয়া হলে গাঁদাফুলের মালা ফ্রি! তৃণু থেকে হনু, হনু থেকে তৃণু, বাম থেকে রাম, ট্রাপিজ়ের খেলা জমে উঠেছে।
তা এত জেনে আপনি কী করছেন?
কিছুই করছি না। সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ দিয়ে গায়েছাপ্পা মারা ভেড়ার দলের মতো হেঁটে চলেছি। স্বেচ্ছায় গলা চরণে দিয়ে আসব। তার আগে এট্টুখানি চারদিক দেখতে দেখতে চলেছি। এই আর কী!
যতক্ষণ বাঁচবেন, ধারাবিবরণীটা চালিয়েযান শুনি।
এখন আর পারব না মশাই। ডাক এয়েছে, উৎসবে যেতে হবে। তার আগে মেরুদণ্ডের বাজারটা ঘুরে যাব।
বেচবেন না কিনবেন? অমৃত মহোৎসব না কার্নিভাল?
বলব কেন? সব শুনে নিয়ে আমাকেই দেশদ্রোহের মামলা দিয়ে জেলে ঢোকাবেন নাকি? তা হলে আবার বিনা বিচারে পাঁচ বছর। ওই মুসলমান ছাত্রটার মতো। তারিখের পর তারিখ।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)