Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
Afghanistan Crisis

তালিবান বুঝিয়ে দিল, নির্লজ্জ আমেরিকা কোনওদিন শোধরাবে না

আমেরিকা এসেছিল ‘নতুন আফগানিস্তান’ গড়ার কথা বলে। কিন্তু কী হল? ২০ বছরের বিনিয়োগ ফেলে কার্যত ময়দান ছেড়ে পালাতে হল।

ফাইল ছবি

জ্যোতির্ময় বন্দ্যোপাধ্যায়
জ্যোতির্ময় বন্দ্যোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৪ অগস্ট ২০২১ ১৬:৩৭
Share: Save:

আমেরিকার অস্ত্রেই এখন শানিত তালিবান। যে অস্ত্র ফেলে রেখে গিয়েছে আমেরিকার সেনা, তা কাঁধে উঠেছে তালিবানের। তাতেই শক্তি বেড়েছে তাদের, বেড়েছে শক্তি প্রদর্শনও। মাঝে মধ্যেই তালিব নেতৃত্বকে নেটমাধ্যমে অস্ত্র হাতে ছবি দিতে দেখা যাচ্ছে। সেই অস্ত্র, যেগুলি আমেরিকা দিয়েছিল আফগান সরকারকে। যার মূল্য প্রায় ২৮০ কোটি ডলার। ২০০২ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে অস্ত্রভান্ডারের জন্য দেওয়া এই অর্থের পাশাপাশি সেনার প্রশিক্ষণ ও উন্নতির কাজে প্রায় ৮৩০ কোটি ডলার খরচ করেছিল আমেরিকা। ক্ষমতা দখলের পর এই বিপুল যুদ্ধ-সরঞ্জাম দখল করেছে তালিবান। দু’হাজার অস্ত্রবাহী গাড়ি, হামভি, যুদ্ধবিমান, হেলিকপ্টার (যেমন, ব্ল্যাকহক হেলিকপ্টার), স্ক্যান ইগল ড্রোন ও বিমান, এ সবই এখন তালিবানি দখলে। চার্চিলের ভাষায়, ‘প্রস্তরযুগের হানাদারদের হাতে যেন পৌঁছে দেওয়া হয়েছে আধুনিকতম অস্ত্র।’

মনে রাখতে হবে, এই বিপুল অস্ত্রের একটা বড় অংশের নিয়মিত দেখভাল প্রয়োজন। চালাতে গেলে চাই প্রশিক্ষণও। তালিবানের সেই প্রশিক্ষণ নেই। কিন্তু তাতে কী? এর বাইরেও এমন অনেক যুদ্ধ-সরঞ্জাম আছে, যা তালিবানদের হাসি চওড়া করবে। অ্যাসল্ট রাইফেল এম ১৬, মর্টার, হাউৎজার, বডি আর্মার, নাইট গগল্স, আইইডি বিস্ফোরক, গ্রাউন্ড রকেট, তালিবানের কাছে পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনা এই মারণাস্ত্রগুলি। এক দিকে এই বিপুল অস্ত্র ভান্ডার, অন্য দিকে আমেরিকার তৈরি করা ‘বায়োমেট্রিক ডেটাবেস’, আমেরিকার সেনার ছেড়ে যাওয়া ঘাঁটি, আমেরিকা পিঠটান দেওয়ার পর তালিবানের হাতে ব্যবহৃত হবে সবই। শুধু কি তাই, ব্যবহার করতে না পারলে আছে বিক্রি করে বিপুল উপার্জনের সম্ভাবনাও। অস্ত্র কিনতে আগ্রহী ইরান, চিন, রাশিয়া এবং বিভিন্ন সন্ত্রাসবাদী সংগঠনকে বিক্রি করেও টাকা পকেটে পুরতে পারবে তারা। তাতে লাভও হবে, বন্ধুত্বও বাড়বে।

যে অস্ত্র ফেলে রেখে গিয়েছে আমেরিকার সেনা, তা কাঁধে উঠেছে তালিবানের।

যে অস্ত্র ফেলে রেখে গিয়েছে আমেরিকার সেনা, তা কাঁধে উঠেছে তালিবানের। ফাইল ছবি।

আমেরিকা এসেছিল ‘নতুন আফগানিস্তান’ গড়ার কথা বলে। কিন্তু কী হল? ২০ বছরের বিনিয়োগ ফেলে কার্যত ময়দান ছেড়ে পালাতে হল। তালিবানের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করা তো দূর, সামান্য লড়াইয়ে যাওয়ার চেষ্টাও করল না আমেরিকার মদতপুষ্ট আফগান সেনা।

তথ্য ভিত্তিক এই বর্ণনা কপালে ভাঁজ ফেলার জন্য যথেষ্ট। তবে শুরুতেই এই কথা বলার উদ্দেশ্য একটাই, আঁতের কথাটা খুঁজে দেখা। কেন এমন হল? কেন বিপুল বিনিয়োগের মায়া কাটিয়ে আফগানিস্তান ছাড়ল আমেরিকা? যে দেশ এখন বিশ্বের জ্ঞানচর্চার কারখানা, যেখানে তাবড় তাবড় বিশ্লেষক, রণনৈতিক, সরকারি উপদেষ্টারা বসে আছেন, তাঁরা কি সত্যিই বুঝতে পারেননি যে পায়ের তলার মাটি সরে গিয়েছে? আমেরিকার অজান্তে যে তালিবান গোকুলে বাড়ছে, বোঝেনি সে দেশ?

একবার অতীতের দিকে চেয়ে দেখা যাক। ১৯ শতক থেকে হিন্দুকুশ পর্বতের আদি বাসিন্দারা মাঝেমধ্যেই বেগড়বাঁই করতেন। অস্ত্র নিয়ে লড়াইয়ে নেমে পড়তেন তাঁরা। বিরক্ত হয়েছিল তৎকালীন ভারতের ব্রিটিশ শাসক। প্রথমে ধীরে চলো নীতি থাকলেও পরে হিন্দুকুশের ঝামেলা মেটাতে সামনে থেকে লড়তে শুরু করে ঔপনিবেশিক শক্তি। একের পর এক পার্বত্য প্রদেশ দখল করে। তৈরি করে রাস্তা, দুর্গ। সীমান্তের ওয়াজিরিস্তান এলাকায় উন্নয়নের কাজ করে। তাতে লাভ বিশেষ হয়নি। জঙ্গলের নিয়মে অভ্যস্ত আফগানদের অসুবিধাই হয়েছে এই অনভ্যস্ত জীবনে। স্বাভাবিক ভাবে বিদেশি শক্তির বিরুদ্ধে শুরু হয়েছে ‘জেহাদ’। ১৮৪২ সালে, ১৬ হাজার ভারতীয়-ব্রিটিশ সেনার মধ্যে বেঁচে ফিরেছেন মাত্র একজন। গড় হয়ে পেন্নাম করে কাবুল ছেড়েছিল ব্রিটিশ।

তালিবানের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করা তো দূর, সামান্য লড়াইয়ে যাওয়ার চেষ্টাও করল না আমেরিকার মদতপুষ্ট আফগান সেনা।

তালিবানের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করা তো দূর, সামান্য লড়াইয়ে যাওয়ার চেষ্টাও করল না আমেরিকার মদতপুষ্ট আফগান সেনা। ফাইল ছবি।

একই ঘটনা ঘটেছে রুশদের সঙ্গেও। আফগানিস্তানের চরিত্র পাল্টাতে না পেরে ১৯৮৯ সালে পাততাড়ি গুটিয়েছে রাশিয়াও। কেউ কেউ বলেন, সোভিয়েত রাশিয়া ভেঙে যাওয়ার পিছনেও আফগানিস্তানে পরাজয় এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। রাশিয়া ও ব্রিটেনের অভিজ্ঞতার পাশাপাশি, আমেরিকার কাছে ভিয়েতনামের অভিজ্ঞতাও ছিল। ১৯৭৩ সালে প্রায় এক যুগ ধরে চলা সেনা অভিযান থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিল ওয়াশিংটন। ভিয়েতনামে একটি জোট সরকার গড়তে চেয়েছিল আমেরিকা, কিন্তু লাভ হয়নি। দুর্বল সেই প্রশাসন আসলে ভিয়েতনাম থেকে আমেরিকার চলে যাওয়ার রাস্তা প্রসারিত করেছিল। মূলত, আমেরিকার সামরিক হস্তক্ষেপ আটকাতেই। একই ছবি দেখা যাচ্ছে আজকের কাবুলে। সেখানেও আমেরিকাকে আটকাতে ঢাল হয়েছে তালিবান। ভিয়েতনামের জোট সরকারের মতো এক মেরুদণ্ডহীন আফগান সরকার তালিবানের সঙ্গে আলোচনা চালিয়েছিল। কিন্তু, সর্বনাশ যা হওয়ার তা তো হয়েছেই।

আমেরিকার আসল লক্ষ্য কী ছিল? সেবা?

আমেরিকা শত্রুকে হারাতে চেয়েছিল, পাশাপাশি চেয়েছিল নিজের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি উন্নতে করে নয়া আফগানিস্তান গড়তে। জার্মানি বা জাপানের ক্ষেত্রে এই কাঠামো কাজ করে গিয়েছিল, কিন্তু তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে তা করেনি। তা দেখিয়েছে ভিয়েতনাম, আফগানিস্তান। আমেরিকার নিজস্ব কায়দায় দেশ গঠনের প্রক্রিয়া দক্ষিণ ভিয়েতনাম ও আফগানিস্তানে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। আমেরিকার উচিত ছিল আলকায়দার পাশাপাশি তালিবানকেও ধ্বংস করে সেই ধ্বংসস্তুপের উপর দিয়ে আফগানিস্তান ছাড়া। কিন্তু ব্রিটিশদের মতোই সুতো ছেড়ে খেলতে গিয়ে নিজের মুখ পুড়িয়েছে ওয়াশিংটন। কারণ, তারা মন দিয়েছিল এমন এক দেশ গঠনে যে দেশে ‘ওয়ার লর্ড’-দের প্রভুত্ব চলে। যে দেশে রয়েছে বিপুল জাতিবৈচিত্র্যের ইতিহাস। সেখানে আমেরিকার কায়দা চলবে কেন?

আসলে আমেরিকা আগাগোড়াই তালিবানের নাছোড়বান্দা মনোভাবকে খাটো করে দেখেছিল। আফগানিস্তানের তালিবান হোক ভিয়েতনামের বামশক্তি, এরা কেউই শক্তি দখলের ইচ্ছাটুকু শেষ দিন পর্যন্ত ছাড়েনি। এরা জানত, একদিন না একদিন আমেরিকার সৈন্য এই দেশ থেকে তুলে নিতেই হবে। শুধু ঘাপটি মেরে অপেক্ষা করা, ধৈর্য রাখা, তাতেই আসবে সাফল্য। উল্টো দিকে আফগান সেনার এই একাগ্রতার কণামাত্র ছিল না। দেশরক্ষার কথা বা প্রেসিডেন্ট আশরফ গনির হয়ে লড়াই করার কথা তারা ভাবেনি। সরকারও সেই বার্তা পৌঁছে দিতে পারেনি, বরং তলিয়ে গিয়েছে দুর্নীতির অন্ধকারে।

আমেরিকা কি অতীত থেকে কিছুই শিখল না? উত্তরটা আন্দাজ করছেন সকলেই। অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস ও ঔদ্ধত্যই ডুবিয়েছে আমেরিকাকে। সম্প্রতি ওয়াশিংটন পোস্টের ‘আফগান পেপার’-এ লেখা হয়েছে, কী করে নিজেই নিজের সর্বনাশ ডেকে এনেছে আমেরিকা। ‘শুধু টাকা আর প্রযুক্তির পাহাড় তৈরি করলেই সব হবে’, এই নীতিই আজ এমন হাল করে ছেড়েছে সে দেশের। তবে সবই লুকিয়ে ফেলা হয়েছে চাদরের তলায়। যার ফল ভবিষ্যতে ভুগবে বিশ্ব।

(লেখক আন্তর্জাতিক সম্পর্কের প্রাক্তন অধ্যাপক। মতামত একান্ত ব্যক্তিগত)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Afghanistan Crisis taliban america digital essay
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE