Advertisement
E-Paper

‘আমি’ পরে, আগে ‘আমরা’, ‘আমি’ পরে, আগে ‘দেশ’! এমন লক্ষ আলো জ্বলে উঠুক

এ জিনিস আগে কখনও দেখিনি। হারা ম্যাচেও ব্যক্তিগত কীর্তির সৌধ স্থাপন করে ক্রিকেটারেরা ব্যাট তোলেন। সে গলির ক্রিকেট হোক বা আইপিএল। চোখে লাগছিল। তবে দেখে একটা অবাক-করা আনন্দও হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, জেমাইমা ‘মাছের চোখ’ দেখছেন। বিশ্বকাপ ফাইনাল।

অনিন্দ্য জানা

অনিন্দ্য জানা

শেষ আপডেট: ০১ নভেম্বর ২০২৫ ০৭:৫৯
লক্ষ আলো।

লক্ষ আলো। ছবি: পিটিআই।

জিডি মার্কেটের সেলুনে ঢুকে দেখলাম, টিভি বন্ধ! সে কী, ইন্ডিয়ার খেলা দেখছে না কেউ? চালা-চালা, আগে টিভি চালা!

অফিস থেকে বেরোনোর সময় দেখে গিয়েছি, শেফালি বর্মা আর স্মৃতি মন্ধানা দ্রুত ফিরে গিয়েছেন। কিন্তু জেমাইমা-হরমনপ্রীত ইনিংসটা ধরেছেন। সেলুনের টিভি-তে দেখলাম, জেমাইমার তখন পঞ্চাশ হয়ে গিয়েছে। হরমন পঞ্চাশের দোরগোড়ায়।

বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল। বিপক্ষে অস্ট্রেলিয়ার মতো বাঘা টিম। সাত বারের চ্যাম্পিয়ন। ২০১৭ সাল থেকে অপরাজিত। প্রথমে ব্যাট করে তুলেছে ৩৩৮। তাতে অবশ্য ভারতেরও কিছু অবদান ছিল। ক্যাচ তো বটেই, ফিল্ডিংয়ে ২০ থেকে ২২ রান গলিয়েছে হরমনের ভারত। বিরক্তিকর। হতাশাজনক। ক্রিকেট-উৎসাহী এবং ক্রিকেট-বুঝদার (এ এক বিরল সহাবস্থান) সহকর্মী অঙ্গীরা বলছিল, ভারত যা ফিল্ডিং করেছে, তাতে এই ম্যাচ জিতলে অন্যায় হবে! ভুল বলেনি। অসাধ্যসাধনই করতে হবে বটে। একে তো ঘাড়ের উপর প্রায় সাড়ে তিনশো রান। তার উপর অস্ট্রেলীয়রা বাজপাখি এবং চিলের সমাহারে তৈরি এখনও না-জন্মানো এক ধরনের কল্পিত পাখির মতো ফিল্ডিং করে মাঠ জুড়ে।

তবু কেন যেন একটা ক্ষীণ আশা হচ্ছিল। মূলত দুটো কারণে। এক, ভারতের এই মেয়েদের দলটা একটা খুশিয়াল ঝাঁক। আপন আনন্দে থাকে। আর কে না জানে, আ হ্যাপি ইউনিট ইজ় আ সাকসেসফুল ইউনিট। যারা নিজেদের মধ্যে, নিজেদের নিয়ে আনন্দে থাকে, তারা সফল হয়। ওই খুশি, ওই আনন্দটা খুব দরকার। অসুখী মানুষের ঝাঁক কখনও পারফর্ম করতে পারে না। দুই, শব্দব্রহ্ম। নভি মুম্বইয়ের ডিওয়াই পাতিল স্টেডিয়ামে দর্শক ধরে ৩৫ থেকে ৪০ হাজার। কোথায় একটা দেখছিলাম, ভারত সেমিফাইনালে ওঠার পরেই সমস্ত টিকিট বিক্রি হয়ে গিয়েছে। ৪০ হাজার কণ্ঠের সমবেত গর্জন কি একটু হলেও বিশ্ব চ্যাম্পিয়নদের চাপে রাখবে না?

নরসুন্দর যখন কাজ শেষ করলেন, তখন জেমাইমা ৯০। ফর্মুলা ওয়ান ড্রাইভারের মতো গাড়ি চালিয়ে বাড়ি পৌঁছোলাম। জেমাইমা ৯৪। যাক বাবা, সেঞ্চুরিটা মিস্ করিনি!

মুশকিল হল, কখন যে সেঞ্চুরিটা হল, ঠিক বুঝতে পারলাম না। কারণ, জেমাইমা কোনও উদ্‌যাপনই করলেন না। না ব্যাট তোলা, না আকাশে মুষ্টিবদ্ধ হাত দেখানো, না হাঁটু গেড়ে মাঠে বসে পিচে চুমু-টুমু। সিঙ্গল নিয়ে সেঞ্চুরিতে পৌঁছোনোর পরেও তাঁকে দেখে মনে হচ্ছিল, ব্যক্তিগত রান ২ থেকে ৩ হল। এ জিনিস আগে কখনও দেখিনি। হারা ম্যাচেও ব্যক্তিগত কীর্তির সৌধ স্থাপন করে ক্রিকেটারেরা ব্যাট তোলেন। সে গলির ক্রিকেট হোক বা আইপিএল। চোখে লাগছিল। তবে দেখে একটা অবাক-করা আনন্দও হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, জেমাইমা জানেন, তাঁর কাজ তখনও শেষ হয়নি। তিনি ‘মাছের চোখ’ দেখছেন। বিশ্বকাপ ফাইনাল। ঠিকই। ম্যাচের পরে তো বললেনও, ‘‘ওটা আমার হাফ সেঞ্চুরি বা সেঞ্চুরির বিষয় নয়। আমার একটাই লক্ষ্য ছিল— আমাদের ম্যাচটা জিততে হবে। আমি জায়ান্ট স্ক্রিনে শুধু দেখতে চেয়েছিলাম ‘ইন্ডিয়া উইন’!

তাঁর কথা শুনতে শুনতে কিছু স্বঘোষিত বিদ্যা-দিগ্‌গজের কথা মনে পড়ছিল। যাঁরা এই তত্ত্বে গভীর ভাবে বিশ্বাসী যে, পেশাদার খেলোয়াড়েরা দেশের হয়ে খেলতে মোটেই আগ্রহী নন। কারণ, তাতে টাকা কম। দেশের হয়ে ম্যাচ খেলতে নেমে নাকি আবেগ-টাবেগও কাজ করে না। সে তিনি দেশজ ক্রীড়াবিদই হন বা বিদেশি। উদাহরণ: নোভাক জকোভিচ নাকি সার্বিয়ার হয়ে অলিম্পিক্সের সোনার পদক জেতার চেয়ে গ্র্যান্ড স্লাম খেলায় বেশি মনোনিবেশ করেন। সেই সবজান্তা যুগন্ধরদের কান ধরে বসিয়ে ২৫ বছরের (জন্ম ২০০০ সালে। ‘শতাব্দীর কন্যা’ তিনি) জেমাইমার কথা শোনাতে ইচ্ছে করছিল।

রোমান ক্যাথলিক পরিবারের সন্তান। বাবা ইভান রদ্রিগেস মুম্বইয়ের ভান্ডুপ থেকে তল্পিতল্পা গুটিয়ে বান্দ্রা চলে এসেছিলেন স্রেফ সন্তানদের খেলাধুলোর সুযোগসুবিধা একটু বেশি দিতে পারবেন বলে। দুই দাদার সঙ্গে মুম্বইয়ের খার জিমখানায় ক্রিকেট খেলতে যেতেন জেমাইমা। গোটা ক্লাবে তিনিই একমাত্র ক্রিকেট শিক্ষার্থিনী। ওহো, বলতে ভুলে গেলাম, ক্রিকেটের আগে মহারাষ্ট্রের অনূর্ধ্ব-১৭ এবং অনূর্ধ্ব-১৯ রাজ্য দলে হকিও খেলেছেন এই পুঁচকে মেয়ে।

এ সম্ভবত নেহাতই নিয়তির পরিহাস যে, জেমাইমার বাবা ইভানের বিরুদ্ধে খার জিমখানার সদস্যদের একাংশ একদা ধর্মান্তরণের অভিযোগ এনেছিলেন। তাঁদের বক্তব্য ছিল, জেমাইমার সাম্মানিক সদস্যপদের ‘সুযোগ’ নিয়ে তাঁর বাবা ক্লাবের চত্বরে ধর্মান্তরণের সভা আয়োজন করেছেন। ১৮ মাসে ৩৫ বার ওই ধরনের সভা হয়েছে। সেই অভিযোগে খার জিমখানা ২০২৪ সালে জেমাইমার সাম্মানিক সদস্যপদই বাতিল করে দিয়েছিল! ইভান যদিও সমস্ত অভিযোগই অস্বীকার করেছিলেন। বলেছিলেন, তিনি প্রার্থনাসভার আয়োজন করেছিলেন ঠিকই। কিন্তু সে সবই ক্লাবের নিয়মকানুন মেনে। সেই সমস্ত সভার সঙ্গে ধর্মান্তরণের কোনও সম্পর্ক ছিল না। সেগুলি ছিল সাধারণ প্রার্থনাসভা। দলমত নির্বিশেষে যে কেউই সেখানে যোগ দিতে পারতেন। যোগ দিয়েওছিলেন। ক্লাবের তৎকালীন কর্তা ইভানের বিরুদ্ধে অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছিলেন। তাঁর বক্তব্য ছিল, ক্লাবের ভোটের জন্য ওই ‘রাজনৈতিক অভিযোগ’ আনা হয়েছিল। কিন্তু সেই অভিযোগের পক্ষে কোনও প্রমাণ মেলেনি।

সেই প্রমাণহীন অভিযোগ, তার ভিত্তিতে ক্লাবের সদস্যপদ চলে-যাওয়ার ঘটনাও কি অশ্রু হয়ে ঝরে পড়ছিল ম্যাচ-জেতানো রাতে? যখন তিনি কিশোরী কন্যার মতো বাবার বুকে মুখ গুঁজে দিলেন?

বাবার বুকে মুখ গুঁজে।

বাবার বুকে মুখ গুঁজে। ছবি: আইসিসি।

উপরের ছবিটা দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল, যে দেশের জনতা বৃহস্পতিবার রাত থেকে তাদের টাইমলাইন ভরিয়ে ফেলেছে জেমাইমার সাহসী, ক্লান্ত, ভঙ্গুর এবং তুঙ্গ সাফল্যের মুহূর্তের ছবিতে, যে দেশের অন্যতম খ্যাতনামী দীপিকা পাড়ুকোন তাঁর অবসাদের সঙ্গে লড়াইয়ের কথা প্রকাশ্যে বলার সঙ্গে তুলনা করছেন জেমাইমার সর্বসমক্ষে নির্দ্বিধায় বলা নিজস্ব উদ্বেগ এবং দুর্বলতার মুহূর্তের স্বীকারোক্তির, সেই দেশেরই কিছু মানুষ এই মেয়েটির বাবাকে ধর্মান্তরণের অভিযোগে কাঠগড়ায় তুলেছিলেন। এবং কী আশ্চর্য, সেই দেশেরই জন্য পড়ে যেতে যেতেও (ফিল্ডিং এবং ব্যাটিং মিলিয়ে মোট ৯৭ ওভার মাঠে ছিলেন জেমাইমা) ক্রিজ়ে দাঁড়িয়েছিলেন এই রোমান ক্যাথলিক কন্যা।

এমনিতেই এই ভারতীয় দলে জেমাইমা হলেন একঝলক টাটকা বাতাসের মতো। যখন-তখন গিটার বাজিয়ে গান ধরেন, নাচেন। গোটা টিমের সঙ্গে হ্যা-হ্যা, হি-হি করেন। বিশ্বকাপের সময়েই একদিন প্র্যাকটিসে হাজির করেছিলেন পোষ্য কুকুরকে। তাকে নিয়েও রিল বানিয়েছেন অকাতরে। জেমাইমাকে দেখলেই মনে হয়, তাঁর মধ্যে একটা অমোঘ ইতিবাচক তরঙ্গ আছে। তিড়িং-বিড়িং করে লাফিয়ে-ঝাঁপিয়ে গোটা টিমের মধ্যে সেই তরঙ্গটা তিনি বইয়ে দিতে পারেন।

কিন্তু সেটা তাঁর বহিরঙ্গ। অন্তরঙ্গে তাঁর মধ্যে আছে বিশ্বাস। গভীর বিশ্বাস। যে কারণে ওই সাফল্যের পরেও তিনি বলতে পেরেছেন, ‘‘আমি এমনকিছুই করিনি। আমি শুধু ওখানে দাঁড়িয়েছিলাম। বাকিটা করেছেন আমার ঈশ্বর।’’ সেই বিশ্বাসের কারণেই তিনি সম্পূর্ণ অসঙ্কোচে মনকে নিরাবরণ করে জনতার সামনে দাঁড়াতে পেরেছেন। নিঃসঙ্কোচে বলতে পেরেছেন নিজের নিরাপত্তাহীনতা, নিজের উদ্বেগ আর দুর্বল মুহূর্তগুলোর কথা। যে কারণে তাঁর চোখের জল বাঁধ মানেনি। বাধা মানেনি।

পঁচিশ বছরের মেয়েটিকে দেখতে দেখতে আত্মশুদ্ধ বলে মনে হয়। সে তিনি ক্রিকেট খেলুন বা না-খেলুন। বিশ্বকাপের মতো মঞ্চে মহা-সেমিফাইনাল জেতানো মহাকাব্যিক এবং ঐতিহাসিক একটি ইনিংস খেলুন বা না-খেলুন। তাঁর মতো পরিশুদ্ধ মানুষ আমাদের চারপাশে খুব বেশি দেখা যায় না। মনে হয়, ইস্, যদি এমন ঝরঝরে, এমন স্বচ্ছ, এমন স্বাভাবিক হতে পারতাম!

সেই আত্মার শুদ্ধিকে বৃহস্পতিবার রাতে পূর্ণতার পর্যায়ে উত্তরণ দিয়েছেন জেমাইমা।

সারা দেশ আবেগে ভাসছে তাঁর কান্না নিয়ে। তাঁর আবেগ নিয়ে। স্বাভাবিক। নিজের সীমা নিজে অতিক্রম করে ১৪০ কোটির দেশে আলো জ্বেলে দিয়েছেন তিনি। ভারতীয় ক্রিকেটের ইতিহাসে ঢুকে গিয়েছে তাঁর ১৩৪ বলে ১২৭ রানের ইনিংস।

তবু, তবুও এই লেখা লিখতে বসে রিওয়াইন্ড করে দেখছি, স্নায়ুকে নড়বড়ে করে-দেওয়া ম্যাচের গভীরতম মুহূর্ত তৈরি হয়েছিল, যখন শতরান করেও তা উদ্‌যাপন করেননি জেমাইমা। ব্যাট-ট্যাট তোলা তো দূরের কথা, মুখের একটি রেখাও কাঁপেনি তাঁর। ‘আমি’কে সরিয়ে রেখে ‘আমরা’ হয়েছিলেন। ‘আমি’ ভুলে ‘দেশ’ হয়েছিলেন। পঁচিশের তরুণী উড়ান দিয়েছিলেন সেই জগতে, যেখানে ব্যক্তিগত মাইলফলক কোনও মাহাত্ম্য তৈরি করে না। ব্যক্তিস্বার্থ ছাপিয়ে বড় হয়ে ওঠে দেশ। তার জন্য কোনও দেখনদারি প্রয়োজন হয় না। প্রতিপক্ষের অধিনায়কের সঙ্গে হাত না-মেলানোর অভব্যতা করতে হয় না। টুর্নামেন্ট জিতেও ট্রফি নিতে না-যাওয়ার মতো অবিমৃশ্যকারিতার পরিচয় দিতে হয় না। কোনও চিত্রনাট্য মেনে আরোপিত আগ্রাসন দেখাতে হয় না।

ব্যক্তিগত কৃতিত্বের বেড়া টপকেও উচ্ছ্বাসহীন। লক্ষ্যে স্থির। অচঞ্চল। নিজের সঙ্গে কথা বলতে বলতে নতুন করে গার্ড নেওয়া। নিজের কীর্তির প্রতি এমন নির্মোহ থেকে দেশের জয়ের জন্য এত উদগ্র থাকতে শেষ কবে কাউকে দেখেছি মনে পড়ে না। বৃহস্পতি-রাতের ওই মুহূর্তটাই সেরা ছিল। ওটাই সেরা থাকবে। সেই মুহূর্তে এক রোমান ক্যাথলিক কন্যার উত্তরণ হয়েছিল জনগণ-ঐক্য-বিধায়কে।

জেমাইমারা বিশ্বকাপ জিতুন বা না-জিতুন, এ পোড়া দেশে এমন লক্ষ আলো জ্বলে উঠুক।

Cricket Jemimah Rodrigues ICC Womens World Cup 2025
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy