Advertisement
E-Paper

ঘরে ফেরা! নীরজ দেখিয়ে দিলেন পাঁকেও পদ্ম ফোটে

দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল, নীরজ মানুষের গল্প বলেন। জীবনের গল্প বলেন। তাঁকে তাঁর সিনেমার পাশে দাঁড়ানোর জন্য জনতার কাছে আবেদন জানাতে হয় না। ফ্ল্যাশ মবের সঙ্গে রাস্তায় নাচতে হয় না। দক্ষিণী ছবির অনুসরণ করতে হয় না।

অনিন্দ্য জানা

অনিন্দ্য জানা

শেষ আপডেট: ২১ অক্টোবর ২০২৫ ০৭:৫৭
ছবির মূল দুই চরিত্রে ঈশান খট্টর এবং বিশাল জেঠওয়া (বাঁ দিকে)। পরিচালক নীরজ ঘেওয়ান (ডান দিকে)।

ছবির মূল দুই চরিত্রে ঈশান খট্টর এবং বিশাল জেঠওয়া (বাঁ দিকে)। পরিচালক নীরজ ঘেওয়ান (ডান দিকে)। গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।

দীর্ঘ এক হাইওয়ে। অন্ধকারে পড়ে আছে লম্বা অজগরের মতো। কয়েকশো ফুট অন্তর অন্তর সেই অতিকায় সরীসৃপের গায়ে পড়েছে জোরালো সোডিয়াম ভেপার ল্যাম্পের আলো। অন্তরীক্ষ থেকে দেখা যাচ্ছে সেই আলোকবৃত্তের মধ্যে অজস্র খুদে খুদে পোকামাকড়ের সারি। তারা সেই দৈত্যাকার উরগের গা বেয়ে বেয়ে চলেছে দূরে কোথাও, আরও দূরে।

ওই পোকামাকড়ের ঝাঁক আসলে মানুষের দঙ্গল। এক একটা আলোর বৃত্তে তারা দৃশ্যমান। সেই বৃত্ত পেরিয়ে আবার নিকষ অন্ধকারে। তার পরে আবার একটা আলোকবৃত্ত। আবার অন্ধকার। নাচার, অসহায়, নিরন্ন মানুষের সারি পর্যায়ক্রমে সেই আলো আর আঁধার পেরিয়ে যাচ্ছে ধুঁকতে ধুঁকতে।

সেলুলয়েড থেকে দৃশ্যটা সটান এসে মেল ট্রেনের মতো ধাক্কা মারে! এ দৃশ্য ‘হোমবাউন্ড’ নামক এক চলচ্চিত্রের। পরিচালক নীরজ ঘেওয়ান।

বারাণসী শহরকে পটভূমিকায় রেখে ২০১৫ সালে নীরজ তৈরি করেছিলেন এক অকল্পনীয় ছবি— ‘মসান’। দশ বছর পরে তিনি তৈরি করেছেন তাঁর কেরিয়ারের দ্বিতীয় পূর্ণদৈর্ঘ্যের কাহিনিচিত্র ‘হোমবাউন্ড’। গত ২১ মে কান চলচ্চিত্র উৎসবে ছবিটির প্রদর্শন শেষ হওয়ার পরে দর্শকেরা উঠে দাঁড়িয়ে অভিবাদন জানিয়েছেন ছবিটির নির্মাতাদের (সম্পাদনায় আছেন অস্কারজয়ী পরিচালক মার্টিন স্করসেসি)। টানা ন’মিনিট (ভুল লিখিনি। ন’মিনিট। ৫৪০ সেকেন্ড। একটানা) ধরে চলেছে হাততালির ঝড়। ভারতের বিভিন্ন মাল্টিপ্লেক্সে ছবিটি মুক্তি পেয়েছে সেপ্টেম্বরের ২৬ তারিখে। আমাদের এই শহর কলকাতায়ও সামান্য কয়েকটি মাল্টিপ্লেক্সে এক আপাত-কঠিন সময়ে (সকাল ৯টা) ছবিটির প্রদর্শনী হচ্ছিল। আপাতত আরও কিছু মাল্টিপ্লেক্সে বেশি সন্ধ্যা এবং গভীর রাতের শো অর্জন করেছে ছবিটি। ‘অর্জন’ই বলব। কারণ, শো বেড়েছে কারও দাক্ষিণ্য বা আনুকূল্যে নয়। ছবির স্বকীয়তা এবং গুণের জোরে। ছবিটি প্রযোজনা এবং পরিবেশনা করে বলিউডের মূলস্রোতের তারকা পরিচালক এবং প্রযোজক কর্ণ জোহরও নিঃসন্দেহে একটি পুণ্য অর্জন করেছেন। তাঁর ‘ধর্মা প্রোডাকশন্‌স’-এর মুকুটে নীরজের এই ছবি একটি ঝলমলে পালক হয়ে থাকবে।

ছবির বীজ রোপিত হয়েছিল ২০২০ সালে ‘নিউ ইয়র্ক টাইম্‌স’-এর দিল্লিস্থিত সাংবাদিক বশরত পিরের লেখা একটি খবর থেকে। আমেরিকার অন্যতম পরিচিত কাগজের রবিবারের সংস্করণে প্রকাশিত সেই খবরের শিরোনাম ছিল ‘টেকিং অমৃত হোম’। কর্ণের সংস্থা ‘নিউ ইয়র্ক টাইম্‌স’ কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে ওই খবরটির স্বত্ব কিনে নেওয়ার পরে যে কাহিনির নাম বদলে গিয়ে হয়েছে ‘আ ফ্রেন্ডশিপ, আ প্যানডেমিক অ্যান্ড আ ডেথ বিসাইড দ্য হাইওয়ে’। সেই এই ছবির বীজ বপন।

আসলে তা-ও নয়। এতক্ষণ যা লিখলাম, তা আসলে বীজ থেকে তৈরি হওয়া চারাগাছের কাহিনি। যা এক্ষণে বড় হতে হতে ভারতীয় ছবির ইতিহাসে গুণমানে মহীরুহের আকার নিতে চলেছে। এই ছবির বীজ আসলে ছিল কোভিডের সময় তৎকালীন টুইটারে ভেসে আসা একটি ঝাপসা ছবিতে। সে ছবি মধ্যপ্রদেশের এক মহাসড়কের পাশে মে মাসের খর রোদে ফুটিফাটা জমিতে পড়ে-থাকা দুই তরুণের।

সাংবাদিকসুলভ কৌতূহলে খোঁজ নিয়ে বশরত জানতে পারেন, দুই তরুণের একজনের নাম মহম্মদ সাইয়ুব। অন্যজন অমৃত কুমার। দু’জনেই মজুরের কাজ করতেন সুরাতের সুতোকলে। কোভিডে লকডাউন ঘোষণা হওয়ার পর দুই বন্ধু রওনা দিয়েছিলেন গুজরাতের সুরাত থেকে ১,৫০০ কিলোমিটার দূরে উত্তরপ্রদেশে তাঁদের গ্রাম বস্তির উদ্দেশে।

মধ্যপ্রদেশ পর্যন্ত পৌঁছোতে পৌঁছোতে হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত হন অমৃত। যে ট্রাকে পয়সাকড়ি দিয়ে তাঁরা সুরাত থেকে চড়েছিলেন, তার সন্দেহাকুল চালক তাঁদের মাঝরাস্তায় ফেলে দিয়ে চলে যান। হাঁটতে হাঁটতে একটা সময়ে অমৃত চলচ্ছক্তি হারিয়ে ফেলেন। কিন্তু সাইয়ুব তাঁকে মাঝরাস্তায় ফেলে চলে যাননি। অসুস্থ, অশক্ত বন্ধুকে পিঠে বহন করে সাইয়ুব মাইলের পর মাইল হাঁটতে থাকেন তাঁদের বাড়ির দিকে। শেষপর্যন্ত মধ্যপ্রদেশের এক হাইওয়েতে পৌঁছোন তাঁরা। তবে একসঙ্গে বাড়ি ফেরা হয়নি তাঁদের। রাস্তার উপর সাইয়ুবের কোলে নেতিয়ে পড়েন অমৃত। বিনা চিকিৎসায় সেখানেই প্রাণবায়ু বেরিয়ে যায় তাঁর। কিন্তু সাইয়ুব তাঁর আবাল্যের বন্ধুকে বেওয়ারিশ লাশ হয়ে গণসৎকারের চিতায় পঞ্চভূতে বিলীন হওয়ার জন্য ফেলে যাননি। হাইওয়ে পেট্রলের পুলিশকর্মী এবং কোভিড-যোদ্ধাদের সহযোগিতায় সরকারি অ্যাম্বুল্যান্স যোগাড় করে তিনি অমৃতের মরদেহ নিয়ে পৌঁছোন তাঁদের বসতভূমি বস্তি গ্রামে। পরিবার-পরিজনের উপস্থিতিতে গ্রামের বাইরে মহুয়া গাছের ছায়ায় ঘাসে-ঢাকা জমিতে মাটি দেওয়া হয় অমৃতকে। ধর্মে হিন্দু এবং জাতে দলিত অমৃতকে জীবিতাবস্থায় সামাজিক সম্মান পেতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছিল। মৃত্যুতে প্রাপ্য সম্মানটুকু তিনি পেলেন ভিন্‌ধর্মের মুসলমান বন্ধুর সৌজন্যে।

অমৃত চলচ্ছক্তি হারিয়ে ফেলেন। কিন্তু সাইয়ুব তাঁকে মাঝরাস্তায় ফেলে চলে যাননি। ‘হোমবাউন্ড’ ছবির দৃশ্য।

অমৃত চলচ্ছক্তি হারিয়ে ফেলেন। কিন্তু সাইয়ুব তাঁকে মাঝরাস্তায় ফেলে চলে যাননি। ‘হোমবাউন্ড’ ছবির দৃশ্য।

কোভিড-জর্জর সময়ে গোটা দেশ যখন পরিচিতদের মুখের উপর অহরহ দুয়ার এঁটে দিচ্ছে, পড়শির দিকে তাকাচ্ছে অবিশ্বাসীর চোখে, সহমর্মিতা-বন্ধুত্ব এবং যাবতীয় সুকুমার বৃত্তি লাটে উঠেছে, প্রান্তিক মানুষেরা আরও প্রান্তিক হয়ে পড়ছেন, জীবিকা হারাচ্ছেন, হারাচ্ছেন প্রাণ, দেশের বিভিন্ন প্রান্তে গণচিতা জ্বলছে, কোথাও খোঁড়া হচ্ছে গণকবর, গঙ্গায় ভেসে আসছে একের পর এক মৃতদেহ, হাজার হাজার পরিযায়ী শ্রমিক পাঁয়ে হেঁটে কোথাও সড়কপথে, কোথাও রেললাইন ধরে ঘরে ফিরতে শুরু করেছেন, কেউ কেউ পথিমধ্যে প্রাণ হারাচ্ছেন, কিন্তু অসহায় প্রিয়জনেরা তাঁদের দেহ ফেলে রেখেই পাড়ি দিচ্ছেন বাকি পথ, মানবিকতার সেই গভীর সঙ্কটের সময় টুইটারে ওই ঝাপসা ছবি এবং সাইয়ুব-অমৃতের কাহিনি সাংবাদিক বশরতকে তাড়া করে ফিরছিল। নিউ ইয়র্কে তাঁর বস্‌-এর সঙ্গে কথা বলে উচ্চ রক্তচাপ এবং বহুমূত্র রোগের রুগী সাংবাদিক ঠিক করে ফেলেন, সাইয়ুবের সঙ্গে তাঁকে দেখা করে তাঁকেই লিখতে হবে এই ‘স্টোরি’। দিল্লি থেকে সহকর্মী চিত্র সাংবাদিককে নিয়ে সড়কপথে বশরত পৌঁছোন বস্তি গ্রামে। কথা বলেন সাইয়ুবের সঙ্গে।

গর্ভাধান হয় পাঁচ বছর পরে সারা পৃথিবীর সিনেমা-বিদগ্ধ মহলে সাড়া ফেলে-দেওয়া ‘হোমবাউন্ড’ ছবির।

সাড়া ফেলবে না-ই বা কেন! নীরজের ১২২ মিনিটের ছবি দর্শকের সমগ্র সত্তা ধরে অনবরত ঝাঁকুনি দেয়। মনখারাপ করায়। তারপর স্রেফ চুপ করিয়ে দেয়! এক ধাক্কায় নিয়ে ফেলে পাঁচ বছর আগের সেই অবিশ্বাস্য, অসহনীয় এবং সমষ্টিগত শঙ্কার দিনগুলোয়। নীরজের ছবি দেখতে দেখতে মনে হয়, ওহ্! এমনও সব দিন ছিল? সব কেমন ভুলে গেলাম আমরা! তারপরে মনে হয়, যেখানে যেখানে সত্যিকারের শিক্ষা থাকে, কষ্ট থাকে, সেই দিনগুলো আমরা ভুলে যাই। আসলে ভুলে যেতে চাই। কারণ, সেই কষ্টের মধ্যে ভীতি থাকে। অনিশ্চয়তা থাকে। যন্ত্রণা থাকে। সেগুলো মনে রাখলে আমরা আর আনন্দে জীবন কাটাতে পারি না। মনে রাখলে এখনকার যে যাপন, তা আমরা করতে পারতাম না। আমরা শুধু মনে রাখি কিছু আবেগহীন, রসকষহীন বৌদ্ধিক পরিসংখ্যান। নীরজের ছবি আমাদের সেই পরিসংখ্যানের বেড়া টপকে অনতি-অতীতে নিয়ে যায়।

সমাজ এবং রাষ্ট্রের গিঁটগুলো পরম যত্নে এবং পরতে পরতে খুলে অপাপবিদ্ধ বন্ধুত্ব এবং মানবিকতার এক মসৃণ সুতো নির্মাণ করেছেন পরিচালক নীরজ। সেই সুতোয় মালার মতো গেঁথেছেন কিছু স্বপ্ন, কিছু মুহূর্ত, কিছু আশা, কিছু আশাভঙ্গ আর অদম্য ইচ্ছাশক্তিপ্রসূত মায়া।

নীরজের ছবি আমাদের জামার কলার ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে পরিপার্শ্ব সম্পর্কে আরও একবার সচেতন করে। আমাদের মনে করিয়ে দেয়, এখনও কত-শত স্তরে নিরন্তর লেখা হতে থাকে বঞ্চনার ইতিহাস। এই ছবি আমাদের টর্চ-হাতে ঘুণধরা সিস্টেমের অলিগলিতে নিয়ে যায়। আমাদের সামনে প্রতিষ্ঠানের চিরকালীন দৈন্য তুলে ধরে (আশ্চর্য নয় যে, সেন্সর বোর্ড ছবিতে মোট ছ’টি ‘কাট’ প্রস্তাব করেছিল। কিছু কিছু জায়গায় পাল্টাতে হয়েছে সংলাপও)। আমাদের মনে করায় চারপাশের পাড়া এবং সমাজে জাত-পাত, ধর্ম-অধর্ম, লিঙ্গবৈষম্য, ধনী-দরিদ্রের তারতম্য, সরকারি কাজের দীর্ঘসূত্রিতা, এই একুশ শতকেও আমাদের দেশের গ্রামে গ্রামে অপমান আর অপ্রাপ্তির চৌকাঠে ঠোক্কর খেতে খেতে বড় হওয়া হরিজন পরিবার এবং সরকারি চাকরির ফর্মে সেই পরিবারের সন্তানের নিজের ‘দলিত’ পরিচয় লিখতে দ্বিধার কথা। এই ছবি আমাদের দেখায় কর্পোরেট অফিসে বেয়ারার পদে কর্মরত মুসলিম তরুণের হাতে ভরা জলের বোতল তার টেবিলে রাখতে বাধা-দেওয়া তথাকথিত শিক্ষিত এবং হিন্দু কর্মচারীকে। দেখায় অফিসের উপরওয়ালার বাড়ির নৈশভোজে যখন ভারত ক্রিকেটে হারায় পাকিস্তানকে, তখন মুসলিম কর্মচারীটিকে ঘিরে কিছু পান-প্রিয় রঙ্গ-রসিকতা-টীকা এবং টিপ্পনী।

এই ছবি আমাদের দেখায় পুলিশ কনস্টেবলের চাকরিপ্রয়াসী হাজার হাজার যুবক-যুবতীর দূরাগত ট্রেনের ইঞ্জিনের ভোঁ শুনে রেললাইন পেরিয়ে প্ল্যাটফর্ম বদলানোর প্রাণান্তকর দৌড়। যদি কোনওমতে ট্রেনের মেঝেতেও বসার জায়গাটুকু পাওয়া যায়! দেখায় পুলিশে চাকরির পরীক্ষায় পাশ করলেও চাকরি হয় না। কারণ, কোনও অজ্ঞাত কারণে সেই নির্দেশের উপর স্থগিতাদেশ এসে পড়ে। অথচ সেই চাকরির উপর নির্ভর করে ততদিনে গরিবস্য গরিব পরিবারে ভবিষ্যতের ছবি আঁকা হয়ে গিয়েছে। এই ছবি আমাদের দেখায়, পুলিশে চাকরির চিঠি অবশেষে যখন বাড়িতে এসে পৌঁছোয়, তখন চাকরি-পাওয়া মানুষটাই আর ইহজগতে নেই। এই ছবি আমাদের দেখায়, গ্রামে গ্রামে স্মার্টফোন ঢুকেছে বটে। কিন্তু মানুষের দৈনন্দিন যাপন এখনও থমকে আছে সেই আদিপ্রস্তর যুগে।

আবার এই ছবি একই সঙ্গে বলে আশাবাদের কথা। অর্থলোভী, প্রচারসর্বস্ব এবং অসত্যের ফুলঝুরির দুনিয়ার ছায়া ভেদ করে কোথাও একটা সরু আলোর রেখা দেখা যায়। গ্রাম্য বাছবিচার, ছোঁয়াছানি ঘুচে যায়, যখন দিন আনা-দিন খাওয়া পরিযায়ী শ্রমিকেরা পাশাপাশি বিছানায় ঘুমোয়, একই শৌচাগারে লাইন দিয়ে প্রাতঃকৃত্য সেরে নেয়। একই শয্যা দিন এবং রাতের শিফ্‌টে ভাগাভাগি হয়। দলিত বাড়ির মায়ের পাঠানো আচারের বয়াম নিয়ে কাড়াকাড়ি করে সকলে। সেখানে ধর্ম, জাত-পাত, সাম্প্রদায়িকতা এক লহমায় ঘুচে যায়।

ছবির স্বার্থেই সাইয়ুব-অমৃতের নাম এবং তাঁদের জীবন এবং যাপনের পটভূমি বদলে দিয়েছেন নীরজ (সম্ভবত সেই কারণেই গল্পের নামও বদলে গিয়েছে)। সাইয়ুব হয়েছে মহম্মদ শোয়েব আলি। অমৃত হয়েছে চন্দন কুমার (আসলে চন্দন কুমার বাল্মীকি। কিন্তু শেষের শব্দটা চন্দন ঊহ্যই রাখে। কারণ, সেই শব্দটি তার ‘দলিত’ পরিচয়ের জ্ঞাপক)। শোয়েবের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন ঈশান খট্টর। চন্দনের ভূমিকায় বিশাল জেঠওয়া। চন্দনের প্রেমিকার ভূমিকায় আদ্যন্ত ‘ডিগ্ল্যামারাইজ়ড’ জাহ্নবী কপূর। বাকি সমস্ত অভিনেতা-অভিনেত্রী প্রায় অনামি। কেউ কেউ নাটকের মঞ্চ থেকে এসেছেন।

অসামান্য অভিনয় করেছেন ঈশান এবং বিশাল। দুই বাল্যবন্ধুর সারল্য, খুনসুটি, স্বপ্ন দেখা এবং স্বপ্নভঙ্গ, ঝগড়া-হাতাহাতি এবং তারপরে আবার পরস্পরের কাছে অবলম্বন হয়ে ফিরে যাওয়ার যে নকশিকাঁথা নীরজ বুনেছেন, তার প্রতিটি সুচের ফোঁড়ে রয়েছে ঈশান-বিশালের অভিনয়ের সূক্ষ্ম কারুকাজ।

ছোট ছোট সব মুহূর্ত রচনা করেছেন পরিচালক নীরজ। যা গভীর, গভীরতম অভিঘাত রেখে যায়। ঝিম ধরিয়ে দেয়। ছবি শেষ হওয়ার পরেও পিছু ছাড়ে না। সময়ে সময়ে ফিরে ফিরে হাজির হয় হৃদয় দ্রব করার জন্য।

দলিতসন্তান চন্দনের মা অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী। তিনি গ্রামের ইস্কুলে রান্না করতে যান। উচ্চবর্ণেরা এসে টান মেরে তাঁর রান্না ফেলে দেয়। অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে থাকেন প্রধানশিক্ষক।

পথশ্রমে হতক্লান্ত, অসুস্থ বন্ধুর জন্য পথচলতি গাঁয়ের নির্জলা টিউবওয়েল প্রাণপণে পাম্প করতে থাকে শোয়েব। কোভিড-সন্দিগ্ধু গ্রামবাসীরা তাদের লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছুড়তে শুরু করে। ভীত-সন্ত্রস্ত এবং পলায়নপর দুই তরুণের সামনে আচম্বিতে স্টেনলেস স্টিলের গ্রাম্য জগ নিয়ে উদয় হন দেড়হাত ঘোমটা টানা গ্রাম্য বধূ। দুই অচেনা এবং আপাত-সন্দেহভাজন আগন্তুকের দু’হাতে জড়ো-করা আঁজলায় জল ঢেলে তিনি তাদের তৃষ্ণা মেটান। তার সঙ্গে বুঝি বা নীরবে ঝরে পড়ে সহানুভূতির বারিধারা। নিশ্চুপে তিনি যখন ফিরে যাচ্ছেন, তাঁর খালি পায়ের ফাটা গোড়ালির দিকে নজর যায় চন্দনের। তার মায়ের পায়ের মতো। মুহূর্তটি আবার ফিরে আসে, যখন সাদা কাপড়ে বাঁধা চন্দনের মৃতদেহ খাপরার চালের বাড়ির দাওয়ায় রেখে ঘরের ভিতরে আসে শোয়েব। দ্বিধাগ্রস্ত হাতে সন্তানহারা মায়ের হাতে তুলে দেয় মৃত বন্ধুর মলিন ব্যাকপ্যাক হাতড়ে পাওয়া নতুন একজোড়া মেয়েদের চপ্পল। ফাটা গোড়ালির বৃত্ত সম্পূর্ণ হয়। শোকে পাথর এবং মূক মায়ের কান্নার বাঁধ ভেঙে যায়।

পুলিশে চাকরির পরীক্ষায় পাশ-ফেল জনিত কলহ-হাতাহাতির দীর্ঘদিন পরে আশাহত এবং ভেঙে-পড়া শোয়েব হাজির হয় সুরাতের সুতোকলে কর্মরত বন্ধু চন্দনের ডেরায়। ছাদের নিভৃতিতে চন্দন কাঁধ জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দিতে যায় শোয়েবকে। ঘাড় গোঁজ করে থাকা শোয়েব তাকে বারবার ঠেলে দূরে সরিয়ে দেয়। অবশেষে চন্দনকে জড়িয়ে ধরে আকুল কান্নায় ভেঙে পড়ে তারই বুকে মুখ লুকিয়ে। মুছে যায় অভিমান। মুছে যায় কয়েক মাসের দুস্তর ব্যবধান।

মধ্যপ্রদেশের জনহীন মহাসড়কে টলে পড়েছে চন্দন। আকুল হয়ে তাকে জাগিয়ে রাখার চেষ্টা করছে শোয়েব। কখনও আদর করে, কখনও বকে-ধমকে, কখনও তার অবসন্ন হাতের তালুতে ক্যাম্বিসের ক্রিকেটবল গুঁজে দিয়ে, কখনও প্রেমিকার কথা বলে, কখনও মায়ের হাতে বানানো বিরিয়ানির সুগন্ধের অসত্য প্রতিশ্রুতি দিয়ে, কখনও ঠোঁটের ফাঁকে বোতল থেকে বিন্দু বিন্দু জল ছুঁইয়ে তাকে জীবনে ফিরিয়ে আনার অসাধ্যসাধনের চেষ্টা করছে বন্ধু। জীবনে জীবন যোগ হয়ে যাচ্ছে। তৈরি হচ্ছে আকুতি, অসহায়তা, হার না-মানার চেষ্টা, মানবিক বোধ আর অদম্য ইচ্ছাশক্তির কোলাজ।

দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল, মধ্য চল্লিশের নীরজ মানুষের গল্প বলেন। জীবনের গল্প বলেন। তাঁকে তাঁর সিনেমার পাশে দাঁড়ানোর জন্য জনতার কাছে আবেদন জানাতে হয় না। ফ্ল্যাশ মবের সঙ্গে রাস্তায় নাচতে হয় না। ছবিতে ‘আইটেম সং’ ঢোকাতে হয় না। নায়িকাকে বিকিনি পরাতে হয় না। দক্ষিণী ছবির অনুসরণ করতে হয় না। বিশ্ববরেণ্য পরিচালককে পদে পদে অনুকরণ করতে হয় না। কালজয়ী সাহিত্যিকের সৃষ্ট বাংলার প্রথম ব্রিটিশবিরোধী নারীচরিত্র তথা বিপ্লবীকে ‘ডাকাতরানি’ (ব্যান্ডিট কুইন) বলে পোস্টারে বিজ্ঞাপিত করে শেখর কপূর কৃত ফুলন দেবীর জীবনী ‘ব্যান্ডিট কুইন’-এর সঙ্গে সাযুজ্য টেনে এনে ‘ব্র্যান্ড রি’কল’ করতে হয় না। কিন্তু এতৎসত্ত্বেও নীরজের সৃষ্টির প্রতিটি ফ্রেমে, প্রতিটি সংলাপে তাঁর মেধাসঞ্জাত সংবেদনশীলতার বিচ্ছুরণ ঝিলমিল করে।

‘হোমবাউন্ড’ দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল, অধুনা আমরা মধ্যমেধার জয়জয়কারের চেয়েও কয়েকধাপ নীচে নেমে নিম্নমেধার নির্লজ্জ উদ্‌যাপনে মেতেছি। এই হতাশ সময়ে নীরজ ঘেওয়ান আমাদের দেখালেন, মেধার প্রয়োজন এখনও ফুরোয়নি। মেধার প্রয়োজন ফুরোয় না। মেধাবী মানুষ এখনও তাঁর একটি সৃষ্টিতে সকলকে নিঝুম করে দিতে পারেন।

‘নীরজ’ শব্দের অর্থ পদ্মফুল। পদ্ম জলে ফোটে। পদ্ম পাঁকেও ফোটে!

Homebound Movie Neeraj Ghaywan Ishaan Khatter
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy