আমেরিকান কম্পিউটার বিজ্ঞানী জন ম্যাকার্থি (১৯২৭-২০১১) ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা’-র জনক হিসাবে পরিচিত। এক রাতে হঠাৎই তিনি ভেসে উঠলেন কম্পিউটারের পর্দায়। প্রাথমিক অস্বস্তি কাটিয়ে তাঁর সঙ্গে কথাবার্তা শুরু হল। জানতে চাইলাম, এখন এআই-এর চমকপ্রদ সাফল্য অনেকাংশে যে ডিপ লার্নিং প্রযুক্তির উপরে দাঁড়িয়ে, তার ব্যবহারিক প্রয়োগ আপনি নিজেই দেখে গিয়েছেন। সম্প্রতি এরই একটি বিশেষ রূপ ‘লার্জ ল্যাঙ্গুয়েজ মডেল’ ব্যবহার করে চ্যাটজিপিটির মতো চ্যাটবটগুলি সাড়া ফেলে দিয়েছে। ছেলেমেয়েদের হোমওয়ার্ক থেকে শুরু করে বিজ্ঞাপনের কপি লেখা, সিনেমার চিত্রনাট্য তৈরি করা, এমনকি সফ্টওয়্যারের ক্ষেত্রে অধিকাংশ রুটিন কোড লেখা— সবই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা অনায়াসে করতে পারছে। আশঙ্কা প্রবল যে, এর ফলে অনেকেই কাজ হারাবেন।
ম্যাকার্থি বললেন, “এটা সত্যিই চিন্তার বিষয়। আশির দশকে কম্পিউটার আসার পরে অনেকে কাজ হারিয়েছিলেন। কিন্তু প্রোগ্রামিং, সোশ্যাল মিডিয়া, ডিজিটাল মার্কেটিং, ই-কমার্স ইত্যাদি ক্ষেত্রে তার থেকে অনেক বেশি কর্মসংস্থান হয়েছিল। এআই-এর ক্ষেত্রেও কিছু নতুন কাজের সুযোগ আসবে। যেমন, এআই সেফটি অ্যান্ড অ্যালাইনমেন্ট-এর দিকটা দেখতেও বিশেষজ্ঞ লাগবে। তবে ডিপ লার্নিং বা সাম্প্রতিক অন্য কিছু প্রযুক্তি এতটাই ট্রান্সফর্মেটিভ, বা গুণগত ভাবে এতটাই আলাদা যে, সমাজ-অর্থনীতির চেহারা আমূল পাল্টে যেতে পারে। ভবিষ্যতে হয়তো তথাকথিত উচ্চপর্যায়ের কাজ যেমন মৌলিক গবেষণা, অধ্যাপনা, স্ট্র্যাটেজিক প্ল্যানিং ইত্যাদি ছাড়া বাকি সব কাজ এআই বা তার পরিচালিত রোবটরাই করবে। তবে কত দিনে তা বলা কঠিন। এই সব নতুন প্রযুক্তি শিল্পক্ষেত্রে ব্যবহার করতে এখনও অনেক বিনিয়োগ ও গবেষণার প্রয়োজন।”
তবে, আলোর রেখাও আছে। এ যুগের বিখ্যাত বিজ্ঞানী ও চিন্তাবিদ নিক বোস্ট্রম তাঁর ডিপ ইউটোপিয়া (২০২৪) বইতে দেখিয়েছেন, গত কয়েক শতাব্দীতে প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে উৎপাদনশীলতাও উল্লেখযোগ্য ভাবে বেড়েছে। এআই এবং রোবটিক্সের কল্যাণেও উৎপাদনশীলতা বাড়বে, বিভিন্ন অত্যাবশ্যক সামগ্রী ও ভোগ্যপণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। একই সঙ্গে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে থাকলে গড়পড়তা মানুষের জীবনযাত্রার মানওবাড়া উচিত।
কিন্তু সেই সম্পদের কি সুষম বণ্টন হবে, না কি মুষ্টিমেয় মানুষের হাতেই জমা হবে?— অনিবার্য পাল্টা প্রশ্নটা করেই ফেললাম। ম্যাকার্থি মুচকি হেসে বললেন, “বর্তমান সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে দেখলে দ্বিতীয় সম্ভাবনাই প্রবল। আসলে প্রযুক্তির পাশাপাশি রাজনীতি, সমাজ ও অর্থনীতিকেও পাল্টাতে হবে। সরকারকে শিল্প ও পরিষেবাক্ষেত্রে এআই-এর ব্যবহার ধীরে ও নিয়ন্ত্রিত ভাবে করতে হবে এবং প্রয়োজন হলে বিশেষ কর বসাতে হবে। এমনকি পরিকাঠামো ও অন্যান্য সুযোগসুবিধার বিনিময়ে নতুন প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনের মেধাস্বত্বের একটা অংশ সরকার নিজের কাছেই রাখতে পারে। এর ফলে সরকারের পক্ষে সকলকেই যথেষ্ট অনুদান দেওয়া সহজ হবে।”
প্রশ্ন করলাম, আশঙ্কার কথা শুনি, এআই একটা সময়ের পর ‘সুপার-ইন্টেলিজেন্ট’ হয়ে মানুষকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেবে বা এমনকি নিশ্চিহ্ন করে দেবে। কিন্তু, মানুষকে সরিয়ে দিয়ে যান্ত্রিক মস্তিষ্কের লাভ কী? তা ছাড়া, ক্ষমতা দখল করার জন্য তার মধ্যে চেতনা বা ইচ্ছার মতো মানবিক ধর্মগুলি তো থাকা চাই। অধ্যাপক ম্যাকার্থি খুশি হয়ে বললেন, “খুব ভাল প্রশ্ন। সাধারণ বুদ্ধিতে তাই বলে। আর যন্ত্রের মধ্যে চেতনা সঞ্চার করা আদৌ সম্ভব কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন আছে। অবশ্য গবেষণা চলছে। ইউরোপে কিছু দিন আগে ‘ব্লু ব্রেন’ নামে একটি গবেষণা-প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে। লক্ষ্য ছিল কম্পিউটারে ইঁদুরের মস্তিষ্কের একটি ডিজিটাল মডেল তৈরি করা। তবে সভ্যতার বিপদ শুধু সচেতন যান্ত্রিক মস্তিষ্ক থেকে, এমন তো নয়। ধরা যাক ভবিষ্যতে অত্যন্ত শক্তিশালী কোনও কম্পিউটারকে কোনও নির্দেশ দেওয়া হল। সে চাইবে যে-কোনও মূল্যে নির্দেশটি পালন করতে— তাতে সমাজ-পৃথিবী-পরিবেশ ইত্যাদি ধ্বংস হয়ে গেলেও তার কিছু যায় আসে না। একটা দেশ বা গোটা পৃথিবীর প্রশাসন-প্রযুক্তি-বিচারব্যবস্থা সব কিছুই যদি কম্পিউটার নিয়ন্ত্রণ করে, তাতে বিশাল ঝুঁকি বা অনিশ্চয়তা তৈরি হবে।”
প্রশ্ন করলাম, এর প্রতিকারের কথা বিজ্ঞানীরা কিছু ভাবছেন?
ম্যাকার্থি বললেন, “অবশ্যই। ভবিষ্যতের এই সমস্যাকে ‘কন্ট্রোল প্রবলেম’ বলা হয়। নিক বোস্ট্রম, স্টুয়ার্ট রাসেল, পল ক্রিশ্চিয়ানোর মতো বিজ্ঞানীরা ইতিমধ্যেই বিভিন্ন তত্ত্ব ও পদ্ধতি প্রস্তাব করেছেন। নতুন প্রযুক্তি নিয়ে শুভ-অশুভের দ্বন্দ্ব তো শিল্পবিপ্লব থেকেই চলে আসছে। এআই-এর ক্ষেত্রে ঝুঁকি অবশ্যই অনেক বেশি। কিন্তু প্রযুক্তিকে জোর করে ঠেকিয়ে রাখাও তো সম্ভব নয়। অন্য যে সব প্রযুক্তি দরজায় কড়া নাড়ছে, যেমন জিন-থেরাপি, ন্যানো-টেকনোলজি— ঝুঁকি কম-বেশি সেখানেও আছে। তবু, শুভচিন্তা ও দায়িত্ববোধ জাগিয়ে তুলতে পারলে মানুষ হয়তো এক দিন প্রযুক্তির হাত ধরেই ভাল ভাবে বাঁচতে পারবে।”
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)