গোলাম আলি হলে হয়তো গেয়ে উঠতেন, ‘হাঙ্গামা হ্যায় কিঁউ বরপা!’ এত হাঙ্গামা কেন? কারণ ২০২৬ সাল আসছে। না, পশ্চিমবঙ্গে ভোট বলে নয়। ২০২৬-এর পরে যে জনগণনা হবে, তার ভিত্তিতেই লোকসভার আসন পুনর্বিন্যাস হওয়ার কথা। নতুন করে লোকসভা কেন্দ্রের মানচিত্র আঁকা হবে। তার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ হল, বর্তমান জনসংখ্যা অনুযায়ী লোকসভার আসন সংখ্যা বাড়বে।
১৯৫১ সালে জনগণনার পরে যখন প্রথম ১৯৫২ সালে লোকসভা নির্বাচন হল, তাতে লোকসভার আসন সংখ্যা ছিল ৪৯৪টি। দেশের জনসংখ্যা তখন মাত্র ৩৬ কোটির মতো। ১৯৬১ সালের জনগণনার পরে লোকসভার আসন-সংখ্যা বেড়ে হল ৫২২টি। তার পরে ১৯৭১ সালে জনগণনার পরে লোকসভার আসন আরও বেড়ে ৫৪৩টি হল। সে সময় দেশে ৫৫ কোটির মতো জনসংখ্যা। তার পর থেকে জনগণনা হয়েছে। জনসংখ্যা বেড়ে ১৪০ কোটি ছুঁয়েছে। কিন্তু লোকসভার আসন-সংখ্যা আর বাড়ানো হয়নি।
সংবিধানের ৮২তম অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, প্রতি দশ বছর অন্তর জনগণনার পরে লোকসভার আসন-সংখ্যাও বাড়বে। না হলে তো এক-একটি লোকসভা কেন্দ্রে ভোটার সংখ্যা বা জনসংখ্যা অনেক বেড়ে যাবে। এক জন সাংসদ এত মানুষের দায়িত্ব কী ভাবে সামলাবেন? যেমন, পশ্চিমবঙ্গে ৪২টি লোকসভা কেন্দ্র। ১৯৭১ সালে প্রতিটি লোকসভা কেন্দ্রের গড় জনসংখ্যা ছিল ১০ লক্ষ ৫৫ হাজারের মতো। কারণ তখন রাজ্যের জনসংখ্যাই মোটে ৪ কোটি ৪৩ লক্ষ। ২০১১ সালের জনগণনায় দেখা গেল, পশ্চিমবঙ্গের জনসংখ্যা বেড়ে ৯ কোটি ১৩ লক্ষ ছাপিয়ে গিয়েছে। প্রতি লোকসভা কেন্দ্রের গড় জনসংখ্যা ২১ লক্ষ ৭৪ হাজার। কারণ লোকসভা কেন্দ্রের সংখ্যা বাড়েনি।
প্রশ্ন হল, লোকসভা কেন্দ্র সে সময়ে আর বাড়ল না কেন? কেননা, ১৯৭৬ সালে সংবিধানে ৪২তম সংশোধনে বলা হল, ২০০১ সালের জনগণনা পর্যন্ত লোকসভা আসনের সংখ্যা আর বাড়বে না। তার কারণ হিসাবে বলা হল, সব রাজ্যের জনসংখ্যা সমান গতিতে বাড়ছে না। ইন্দিরা গান্ধী হয়তো ভেবেছিলেন, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে নানা পদক্ষেপের ফলে সব রাজ্যের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কাছাকাছি চলে আসবে। ২০০১ সালে দেখা গেল, তেমন কিছু ঘটেনি। ওই বছরই ফের সংবিধানে ৮৪তম সংশোধন করে ঠিক হল, ২০২৬-এর পরে যে জনগণনা হবে, সেই অনুযায়ী লোকসভা আসন বাড়ানো হবে। আসন পুনর্বিন্যাস বা ‘ডিলিমিটেশন’ করা হবে।
তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী এম কে স্ট্যালিন এই লোকসভার আসন পুনর্বিন্যাস নিয়ে হইচই ফেলে দিয়েছেন। তাঁর অভিযোগ, লোকসভার আসন পুনর্বিন্যাস হলে তামিলনাড়ু-সহ দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলি থেকে লোকসভায় সাংসদ কমে যাবে। কারণ দক্ষিণের রাজ্যগুলি জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে সাফল্য দেখিয়েছে। উল্টো দিকে উত্তর ভারত বা হিন্দি বলয়ের রাজ্যগুলিতে জনসংখ্যা বেড়েছে হুহু করে। এখন জনসংখ্যার ভিত্তিতে কোন রাজ্যের কত লোকসভা কেন্দ্র হবে, তা ঠিক হলে উত্তর ভারতের রাজ্যগুলি থেকে অনেক বেশি সাংসদ লোকসভায় যাবেন। সেই অনুপাতে দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলির সাংসদের সংখ্যা কমবে। ফলে সংসদে তামিলনাড়ু, কেরল, কর্নাটক, অন্ধ্রপ্রদেশ, তেলঙ্গানার প্রতিনিধিত্ব কমবে। দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলির রাজনৈতিক প্রাসঙ্গিকতা কমে যাবে। বিজেপির মতো রাজনৈতিক দল, যাদের দাক্ষিণাত্যের তুলনায় উত্তর ভারতে শক্তি অনেক বেশি, তারা শুধু উত্তর ভারতে ভাল ফল করেই কেন্দ্রে সরকার গড়ে ফেলবে।
প্রশ্ন হল, স্ট্যালিন হঠাৎ এখন এ নিয়ে হইচই শুরু করলেন কেন? ২০২৬ আসতে এখনও এক বছর। ২০২৬-এর পরে যে জনগণনা হবে, সেই অনুযায়ী আসন পুনর্বিন্যাস হওয়ার কথা। দশ বছর অন্তর জনগণনার হিসেবে ধরলে ২০৩১-এ পরবর্তী জনগণনা হবে। তার পরে আসন পুনর্বিন্যাস। অর্থাৎ ২০৩৪-এর লোকসভা নির্বাচনে তার প্রভাব পড়বে।
তবু ডিএমকে প্রধান স্ট্যালিন এখন থেকেই হইচই করছেন। কারণ তাঁর রাজ্যে ২০২৬-এর এপ্রিল-মে মাসে বিধানসভা ভোট। তিনি দ্রাবিড়ভূমের মানুষকে দেখাতে চান, কেন্দ্রের ক্ষমতাসীন বিজেপি তামিলনাড়ুকে রাজনৈতিক ভাবে বঞ্চিত করতে চাইছে। জনসংখ্যা কম বলে তামিলনাড়ু আর্থিক ভাবে বঞ্চিত হবে যুক্তি দিয়ে তিনি ১৬টি করে সন্তান উৎপাদন করতে বলছেন। তামিল আবেগ উস্কে দিতে কেন্দ্রের বিরুদ্ধে হিন্দি চাপিয়ে দেওয়ার অভিযোগ তুলছেন। আগামী কয়েক মাস স্ট্যালিন এ নিয়েই কথা বলবেন, যাতে তামিল আবেগে ভর করে তিনি আবার ফিরে আসতে পারেন মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে।
স্ট্যালিন তাঁর রাজনৈতিক লক্ষ্যে লোকসভার আসন পুনর্বিন্যাস নিয়ে হাঙ্গামা বাধালেও প্রশ্নগুলো অমূলক নয়। বর্তমান জনসংখ্যার হিসেবে লোকসভার আসন রাজ্যগুলোর মধ্যে ভাগবাঁটোয়ারা হলে দক্ষিণ ভারত, এমনকি পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িশার ভাগে তুলনামূলক রাজ্যে কম আসন পড়বে। হিন্দি বলয়ের রাজ্যগুলির আসন সংখ্যা তুলনায় বাড়বে।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে, যদি লোকসভার আসন-সংখ্যা ৫৪৩টি রেখে দিয়ে ২০২৬-এর আনুমানিক জনসংখ্যা অনুযায়ী রাজ্যগুলির মধ্যে নতুন করে ভাগবাঁটোয়ারা হয়, তা হলে উত্তর ভারতের রাজ্যগুলির সাংসদ বেড়ে যাবে। দক্ষিণ ভারত থেকে সাংসদ কমবে। অন্যথায় বর্তমান জনসংখ্যা অনুযায়ী লোকসভার আসন-সংখ্যা বেড়ে ৮৪৮টি করা হতে পারে। সেই লোকসভায় উত্তরপ্রদেশের সাংসদ সংখ্যা ৮০ থেকে বেড়ে ১৪৩ হবে। উত্তরপ্রদেশ, বিহার, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান— হিন্দি বলয় থেকে ৩২৪ জন সাংসদ থাকবেন। কিন্তু তামিলনাড়ুর সাংসদ সংখ্যা ৩৯ থেকে বেড়ে হবে মাত্র ৪০। পশ্চিমবঙ্গের সাংসদ সংখ্যা ৪২ থেকে বেড়ে মাত্র ৬০ হবে। কারণ ১৯৭১ থেকে এখনও পর্যন্ত দক্ষিণের রাজ্য বা পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িশার মতো পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলির তুলনায় হিন্দি বলয়ের জনসংখ্যা অনেক বেশি বেড়েছে।
কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ দাবি করেছেন, অনুপাতের হিসেবে দক্ষিণ ভারতের একটি রাজ্যেরও আসন কমবে না। দক্ষিণের মানুষকে তাঁর আশ্বাস, লোকসভায় যা আসন বাড়বে, তাতে অনুপাতের হিসেবে উচিত ভাগ পাবে দক্ষিণের রাজ্যগুলি।
মুশকিল হল, এই অনুপাত কোন অনুপাত, তা অমিত শাহ স্পষ্ট করে বলেননি। লোকসভার মোট আসনের সঙ্গে রাজ্যের লোকসভা আসনের অনুপাত? না কি জনসংখ্যার অনুপাত? দক্ষিণের মুখ্যমন্ত্রীরা এর স্পষ্টিকরণ চাইছেন। যদি লোকসভার মোট আসনের সঙ্গে একটি রাজ্যের লোকসভা আসনের অনুপাত একই থাকার কথা বলা হয়, তা হলে আপাতভাবে সমস্যা মিটবে বলে মনে হয়। কারণ এখন লোকসভার মোট আসনের ১৪ ভাগের এক ভাগ তামিলনাড়ুর আসন হলে, ভবিষ্যতেও তাই থাকবে। সে লোকসভার আসন বেড়ে যতই হোক।
সমস্যা হল, সে ক্ষেত্রে রাজ্যগুলির মধ্যে লোকসভা কেন্দ্র-পিছু গড় ভোটার বা জনসংখ্যার বিরাট ফারাক দেখা দেবে। ‘এক ব্যক্তি, এক ভোট’-এর নীতি মেনে এত দিন আসন পুনর্বিন্যাস কমিশন লোকসভা কেন্দ্র-পিছু গড় জনসংখ্যা একই রাখার চেষ্টা করেছে। ছোট রাজ্যগুলিতে লোকসভা কেন্দ্র-পিছু গড় জনসংখ্যা কম হয়। কিন্তু বাকি রাজ্যে ওই গড় জনসংখ্যা লোকসভা কেন্দ্র-পিছু একই থাকে। ১৯৭৭ সালে লোকসভা কেন্দ্র-পিছু গড় জনসংখ্যা ছিল ১০ লক্ষ ১১ হাজার। তার পরে আর লোকসভা আসন পুনর্বিন্যাস হয়নি। ফলে এখন দক্ষিণ ভারতের কোনও রাজ্যে লোকসভা কেন্দ্র-পিছু জনসংখ্যা ২০ লক্ষ হলে উত্তর ভারতে তা ৩০ লক্ষ। এই অবস্থা চললে উত্তরপ্রদেশের সাংসদরা লোকসভায় দাবি করবেন, তাঁদের কথা বলার জন্য বেশি সময় দিতে হবে। কারণ তাঁরা অনেক বেশি মানুষের প্রতিনিধিত্ব করেন। লোকসভার আসন পুনর্বিন্যাসের সময় জনসংখ্যার অনুপাত দেখার যুক্তি এটাই। স্ট্যালিনরা এরই বিরোধিতা করছেন।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর আশ্বাসে আরও একটি বড় ফাঁক রয়েছে। তা হল, ২০২৬-এর পরে স্বাভাবিক নিয়মে ২০৩১-এর জনগণনা অনুযায়ী আসন পুনর্বিন্যাস হওয়ার কথা, কিন্তু তার আগে ২০২১-এর জনগণনাই এখনও হয়নি। কোভিডের জন্য জনগণনা পিছিয়েছিল। পাঁচ বছর কেটে গেলেও কবে জনগণনা হবে, তার উত্তর নেই। অথচ লোকসভা ভোটের আগে ২০২৩-এর ২০ সেপ্টেম্বর মহিলা সংরক্ষণ বিল পাশ হওয়ার সময় সংসদে অমিত শাহ বলেছিলেন, লোকসভা নির্বাচনের পরেই ‘তুরন্ত’ জনগণনা হবে। তার পরে আসন পুনর্বিন্যাস হবে।
লোকসভা ভোটের পরে নতুন বছর এসে গেলেও জনগণনা নিয়ে উচ্চবাচ্য নেই। এ বার বাজেটে জনগণনা খাতে যে টাকা বরাদ্দ হয়েছে, তাতে ইঙ্গিত, ২০২৫-এও জনগণনা হবে না। ২০২১ সালের নির্ধারিত জনগণনা ২০২৬ সালে করিয়ে মোদী সরকার তাড়াহুড়ো করে আসন পুনর্বিন্যাস করে ফেলবে, এমন সম্ভাবনা হয়েছে। সে ক্ষেত্রে ২০২৯-এর লোকসভা ভোটেই ৫৪৩টির জায়গায় ৮৪৮টির মতো লোকসভা কেন্দ্রে ভোট হতে পারে। মনে রাখা দরকার, নতুন সংসদ ভবনের লোকসভায় ৮৮৮টি আসন তৈরি রাখা হয়েছে। জনসংখ্যার অনুপাতে লোকসভার আসন ভাগ হলে দক্ষিণের তুলনায় উত্তর ভারতের রাজ্যগুলিতে আসনের সংখ্যা বেশি থাকবেই— যে সব রাজ্যে বিজেপির শক্তি বেশি।
২০২৪-এ বিজেপির আসন কমে যাওয়ার পরে ২০২৯-এ বিজেপি ক্ষমতা ধরে রাখতে এই ছক কষতেই পারে। আর সেই চেষ্টা হলে উত্তর বনাম দক্ষিণ ভারতের লড়াই আরও বাড়বে। তামিলনাড়ুর ভোট মিটে গেলেও হলফ করে বলা যায়, এই হাঙ্গামা কমবে না। বরং বাড়বে।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)