তিন কোটি মানুষের দেশ নেপাল বিগত প্রায় আট দশকে রাজনৈতিক ও প্রাকৃতিক ঝড়ঝাপ্টা কম সামলায়নি। ১৯৫০-এর দশকে রানাশাহির বিরুদ্ধে আন্দোলন, ১৯৯০-এর দশকের গোড়ায় সংসদীয় গণতন্ত্রের লক্ষ্যে জনআন্দোলন, ১৯৯৬ থেকে ২০০৬, তীব্র মাওবাদী আন্দোলন থেকে ২০১৫-তে ভয়াবহ ভূমিকম্প। কিন্তু এই বছরের সেপ্টেম্বর মাসের ৮ এবং ৯ তারিখ যা দেখা গেল, সেটা নজিরবিহীন। বর্তমান শতাব্দীর সন্তানরাই এই বেনজির আন্দোলনের পুরোভাগে ছিলেন— নিশানায় ছিল মাত্রাছাড়া দুর্নীতি এবং স্বজনতন্ত্র। প্রধান রাজনৈতিক দলগুলির নেতৃত্ব, দফতর, নেতাদের ব্যক্তিগত বাসস্থান, বিপণি, পার্লামেন্ট ভবন, সিংহ দরবার সমেত বহু গুরুত্বপূর্ণ সহকারি ভবন এবং সংবাদমাধ্যম— আন্দোলনকারীদের আকস্মিক, অথচ ঝাঁঝালো আক্রমণ থেকে বাদ যায়নি কোনওটিই। এ দিকে প্রাথমিক হিসাবে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কয়েক হাজার কোটি টাকা। দরিদ্র দেশ নেপালের পক্ষে আবার এইগুলি গড়ে তোলা প্রচুর ব্যয় ও সময়ের বিষয়।
এ বারে যে প্রজন্মের মানুষ রাস্তায় আন্দোলনে নেমেছিলেন, পরিসংখ্যান বলছে, তাঁদের ২০ শতাংশই বেকার। অন্য দিকে, অন্তত ত্রিশ লক্ষ নেপালি বংশোদ্ভূত মানুষ প্রতিবেশী ভারতে কর্মরত। পৃথিবীর অন্যত্রও এই সংখ্যা অন্তত আরও ত্রিশ লক্ষের মতো। নেপালের জাতীয় আয়ের তিন ভাগের এক ভাগই আসে এই প্রবাসী নেপালিদের রোজগার থেকে। এই প্রেক্ষাপটে নেপালের অর্থনীতিতে বৈষম্য দক্ষিণ এশিয়ার অন্য প্রতিবেশী দেশগুলির মতোই প্রকট। উল্লেখ্য, নয়া উদার অর্থনীতিজনিত কারণে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে, শুধুমাত্র ও দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া বা লাতিন আমেরিকা নয়, ইউরোপের সমৃদ্ধতর দেশগুলিতেও চরম আর্থিক বৈষম্য তৈরি করেছিল। এই পরিস্থিতিতে জীবিকার দাবিতে, নিজেদের নিরাপত্তা ও সামাজিক সুরক্ষার সন্ধানে এবং গণতান্ত্রিক অধিকারের সন্ধানে নতুন সামাজিক আন্দোলন স্বাভাবিক। নতুনতর প্রজন্ম (জেন জ়ি)-র ক্রমবর্ধমান অসন্তোষ এবং ক্ষোভের প্রতি নজর দেয়নি শাসক। কেবল পুলিশি দমনপীড়নে এই দ্রোহের প্রশমন হয় না।
এই জেন জ়ি’র ক্ষোভ অনেক দেশেই এই পর্যায়ে গেছে যে, পূর্ববর্তী প্রজন্মগুলির মতো রাষ্ট্রীয় এবং গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলির উপরে তাঁরা আজ বিন্দুমাত্র আস্থা রাখেন না। এই প্রবণতা কিন্তু অত্যন্ত বিপজ্জনক। একটি দেশকে গড়তে গেলে ধাপে-ধাপে, বহু পরিশ্রম ও ব্যয়, যে প্রয়োজনীয় প্রতিষ্ঠান, পদ্ধতি ও প্রকরণ গড়ে তুলতে হয়, এক ধাক্কায় তা ভেঙে গুঁড়িয়ে দিলে দেশের এবং বিদেশের মানুষকে সহজেই তাক লাগিয়ে দেওয়া যায়। কিন্তু যাঁরা প্রচলিত আর্থ-রাজনীতির অচলায়তনকে ভাঙলেন, উন্নততর বিকল্প বা রাজনৈতিক দিশা দেখাবার সামর্থ্য তাঁদের মধ্যে রয়েছে তো? ভাঙাগড়ার খেলা পৃথিবীর ইতিহাসে অনেক দেখা গিয়েছে, কিন্তু ফরাসি বিপ্লবের মতো যুগান্তকারী ঘটনার মধ্য দিয়েও রাতারাতি ফ্রান্সে উদার গণতন্ত্রের উন্মেষ ঘটেনি; ঘটেছে দীর্ঘ অরাজকতার পরে। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক দ্রোহকালও এখনও পর্যন্ত সে-দেশে কোনও উন্নততর রাজনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সক্ষম হয়নি।
তথ্যপ্রযুক্তির বৈপ্লবিক রূপান্তর আমাদের হাতের নাগালে নতুন সমাজমাধ্যম এনে দিয়েছে। অথচ, এই নতুন মাধ্যম এক ধরনের শাঁখের করাত। এক দিকে খোলা হাওয়ার বাতায়ন, মানুষের সঙ্ঘবদ্ধ হওয়ার নতুন উপায়। আবার অন্য দিকে, এই মাধ্যম সমাজের চলতি বিভেদগুলিকে বিস্তৃততরও করতে পারে। চোখের আড়ালে থাকা বিভেদ হঠাৎই চোখের সামনে চলে আসে— ভাল ও খারাপ উভয় অর্থেই।
আত্মমুগ্ধতার বর্তমান যুগে নেতা-মন্ত্রী ও অন্যান্য উচ্চ প্রতিষ্ঠিত মানুষের অনেক সন্তান সমাজমাধ্যমে নিজেদের বৈভব, আত্মীয়তা-সূত্রে অর্জিত সম্পদ জাহির করতে উদ্গ্রীব। কিন্তু, নিজেদের ঐশ্বর্যের সীমাহীন এই প্রচার সমাজের অন্য প্রান্তে দৈন্যের দৈনন্দিনতায় আটকে পড়া সমবয়সি যুব সম্প্রদায়কে আরও চোখে আঙুল দিয়ে অসাম্যের মাত্রাহীনতাকে দেখায়। নেপালের ক্ষেত্রেও এমনটিই ঘটেছে। অন্য দিকে, বাংলাদেশে ২০২৪-এর জনরোষ আপাত স্বতঃস্ফূর্ত মনে হলেও বাস্তবে তা ছিল না। এর পিছনে ছিল পূর্ব পরিকল্পনা। নেপালের সাম্প্রতিক আন্দোলনও তেমনই কি না, তার জবাব সময় দেবে। ‘হামি নেপাল’ নামে একটি অসরকারি সংগঠন আন্দোলনের প্রথম দিনে যুব জনতাকে নির্দিষ্ট সময়ে নির্ধারিত স্থানে উপস্থিত হতে বলেছিল। এই সংগঠনটি এক দশক আগের ভূমিকম্পের পরে তৈরি হয়েছিল আর্তত্রাণের উদ্দেশ্যে। আমেরিকার ‘বারবারা ফাউন্ডেশন’ সংস্থাটিকে অর্থ সাহায্য করত বলে অভিযোগ উঠেছিল। ফাউন্ডেশনের তরফে অবশ্য এই দাবি নস্যাৎ করা হয়েছে।
নয়া উদার অর্থনীতি আমাদের মধ্যে তৈরি করেছে এক বল্গাহীন আসক্তি। ফলে একই সমাজে হাতেগোনা মানুষ যেমন তাঁদের আর্থিক সচ্ছলতার কারণে সম্ভাব্য সমস্ত ভোগ্যপণ্যকেই হাতের নাগালে পান, সেই সমাজেরই বাকি মানুষ ন্যূনতম সংস্থানের সন্ধানে অন্তহীন, অনিশ্চিত পরিশ্রমে ব্যস্ত। এটিই হল বহুমাত্রিক সময়সত্তা। বিশ্বায়নের সর্বশেষ পর্যায়ে আমরা যতটা স্থানিক গুরুত্ব কিংবা কোনও এলাকার ভূ-রাজনৈতিক, ভূ-অর্থনৈতিক তাৎপর্য নিয়ে ভাবি, বহুমাত্রিক সময়কে নিয়ে সেই ধরনের ভাবনা কিন্তু অনুপস্থিত। এই অবস্থায় আচমকা আঘাতে নেপালের কষ্টার্জিত শাসনতন্ত্র, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান, চলতি রাজনৈতিক নেতৃত্ব— সবই নড়বড়ে হয়ে গেল। তবে, গণতন্ত্রে যে অর্থসম্পদ ও জন্মপরিচয়ের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা কৃত্রিম অভিজাততন্ত্র অচল, সেটাও পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে।
ইতিমধ্যেই নেপালের প্রাক্তন এবং প্রথম মহিলা প্রধান বিচারপতি সুশীলা কারকি অন্তর্বর্তী প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়েছেন। আন্দোলনকারী যুবসমাজের একাংশই তাঁকে দেশের নেতৃত্বে দেখতে আগ্রহী ছিলেন। কিন্তু পার্লামেন্ট বাতিল করে আগামী ছয় মাসের মধ্যে নতুন নির্বাচন সুষ্ঠু ভাবে করা যাবে কি না, সে প্রশ্নের উত্তর আপাতত অজানা। তা ছাড়া, নেপালে এই প্রথম সেনাবাহিনীকে দেশের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে নিতে দেখা গিয়েছে। তবে, এটিই আশাপ্রদ যে, এই সেনাশাসন একেবারেই সাময়িক এবং সৈন্যরা ছাউনিতে ফেরত গিয়েছেন। প্রসঙ্গত, নেপালে শেষ পর্যন্ত রাজতন্ত্রই অভিপ্রেত কি না, সেই প্রশ্নও উঁকিঝুঁকি দিতে শুরু করেছে।
কিন্তু নেপালে বৈচিত্রপূর্ণ সমাজের জন্য সে দেশের চলতি সংবিধান অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। অনেক সংগ্রামের পরে সে দেশে গণতন্ত্র, প্রজাতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো এবং সমাজের প্রান্তিক মানুষজনের প্রতিনিধিত্বের কাঠামো গড়ে তোলা হয়েছিল। প্রধান রাজনৈতিক দলগুলির নেতৃত্বের একাংশের স্বজনপোষণ ও দুর্নীতির দায় দেশের সংবিধানের উপর বর্তায় না। চলতি সংবিধান বাতিল করা সহজ, কিন্তু তার জায়গায় নতুন সংবিধান রচনা করে সমন্বয়ী বহুমাত্রিক সংস্কৃতিকে উপযুক্ত মর্যাদা দেওয়া— অত্যন্ত দুরূহ কাজ।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)