Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
hockey

ক্রিকেট মাঠের বাইরেও দেখুন

টোকিয়ো অলিম্পিক্সে ভারতীয় ক্রীড়াবিদদের সাফল্যের রেশ যদি মিলিয়ে যায়, তা হলে আবার সেই পুরনো একঘেয়ে হতাশার গল্প ফিরে আসবে।

সূর্যশেখর দাস
শেষ আপডেট: ১৬ অগস্ট ২০২১ ০৪:২২
Share: Save:

দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান। হকিতে আবার পদক পেল ভারত। একটা সময় ছিল যখন ভারতীয় পুরুষ দল অলিম্পিক্সে হকিতে টানা খেতাব জয় করেছে। বস্তুত, ১৯২৮ থেকে ১৯৭২ পর্যন্ত হকির জাদুকর ধ্যানচাঁদের দেশ অলিম্পিক্সে পুরুষদের হকিতে কখনও পদক হাতছাড়া করেনি। শেষ সোনা এসেছিল ১৯৮০’তে। তার পর ৪১ বছরের খরা। এ বারের টোকিয়ো অলিম্পিক্সেও ব্রোঞ্জ পদকের ম্যাচে (ছবিতে) ভারত যখন ২৫ মিনিটেই জার্মানির বিরুদ্ধে ১-৩ গোলে পিছিয়ে যায়, তখন মনে হয়েছিল এ বারও হয়তো সেই ব্যর্থতারই পুনরাবৃত্তি হবে। কিন্তু বার বার হারতে হারতে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া মনপ্রীত-সিমরনজিৎ-হরমনপ্রীতরা পাল্টা লড়াই করে বুঝিয়ে দেন যে, এ বার অন্য কাহিনি লেখা হবে। এর ফল হাতেনাতে পাওয়া গেল। ২৫ থেকে ৩৪ মিনিট— এই ন’মিনিটের মধ্যে ভারতীয়রা মোট চার বার জার্মানির গর্বের দুর্গ ভেঙে দেয়। এর পরে চিরলড়াকু জার্মানরা ভারতের পদক কেড়ে নিতে পারেনি।

অলিম্পিক্সের দ্বিতীয় ম্যাচে ভারত যখন অস্ট্রেলিয়ার কাছে ১-৭ গোলে পর্যদুস্ত হল, তখন অনেক কট্টর ভারতীয় সমর্থকই হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন। এর আগের অলিম্পিক্সগুলোয় ভারত যখনই অস্ট্রেলিয়া, জার্মানি কিংবা নেদারল্যান্ডসের মতো মহাশক্তিধর হকি-খেলিয়ে দেশগুলোর কাছে অসহায় ভাবে পরাজিত হয়েছে, তখন তারা টানা ব্যর্থতার কানাগলিতে হারিয়ে গিয়েছে। সর্বোচ্চ পর্যায়ে সফল হতে দক্ষতার পাশাপাশি মানসিক ভাবেও খুব শক্তপোক্ত হতে হয়। বস্তুত, ওই অলিম্পিক্সগুলোয় ভারতীয় হকি দলের মানসিকতা ঠিকঠাক ছিল না। কিন্তু বর্তমান হকি দলটায় ইস্পাতকঠিন মানসিকতার কোনও ঘাটতি নেই। সেমিফাইনালে বর্তমান বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন বেলজিয়ামের কাছে হেরে গিয়েও তাই তো রুপিন্দর-মনপ্রীত-সৃজেশদের মনোবলে বিন্দুমাত্র চিড় ধরেনি। তারই ফল ব্রোঞ্জ পদক নির্ধারণের ম্যাচে জার্মানির বিরুদ্ধে অমন রুদ্ধশ্বাস জয়। ও-দিকে ভারতীয় মেয়েরাও এই প্রতিযোগিতায় রূপকথার ছবি এঁকেছেন। প্রায় ব্যাখ্যাতীত প্রতিকূলতাকে অতিক্রম করে রানি রামপাল-সবিতা পুনিয়া-গুরজিৎ কৌররা যে লড়াইটা চালিয়েছেন, তা নিছক পদক অপ্রাপ্তির হিসেব দিয়ে বোঝা যায় না।

বলা বাহুল্য, এ বারের অলিম্পিক্সে পুরুষ এবং মহিলাদের হকিতে মারকাটারি সংগ্রাম অনেক উঠতি খেলোয়াড়কে অনুপ্রাণিত করবে। হকি খেলেও সুন্দর কেরিয়ার তৈরি করা সম্ভব, এই উপলব্ধি এঁদের অনেকেই নিশ্চয়ই করতে পেরেছেন। খেলাধুলোর ক্ষেত্রে ভারত ভীষণ ভাবে ক্রিকেট-কেন্দ্রিক— এমন অভিযোগ বহু বার উঠেছে। ক্রিকেটের চাপে অন্য খেলাগুলো যেন একঘরে হয়ে গিয়েছে। আমরা বিরাট কোহালি, রোহিত শর্মা, যশপ্রীত বুমরাদের কেন্দ্র করে আবর্তিত ক্রিকেট পৃথিবীর বাইরে কিছু ভাবতেই পারি না। মিডিয়া থেকে শুরু করে বিজ্ঞাপন সংস্থা— সবাই যেন ক্রিকেট-পুজোয় মেতে রয়েছে! তাই, যার প্রতিভা বর্তমান হকি দলের অধিনায়ক মনপ্রীত সিংহের সমতুল্য ছিল, সে-ও বাধ্য হয়ে হকিস্টিক বিসর্জন দিয়ে হাতে ব্যাট তুলে নেয়। চেষ্টা করে, কী ভাবে বিরাট কোহালি কিংবা রোহিত শর্মার মতো বড় ব্যাটসম্যান হওয়া যায়। যে ছোট্ট মেয়েটি তার সহজাত দক্ষতার দৌলতে হকিস্টিক দিয়ে প্রচণ্ড জোরে শট মেরে গোল করতে পারে, সেই মেয়েটিই একটা সময় ভাবতে বাধ্য হয়— আর খেলে কী লাভ! কারণ সেই ঘুরিয়েফিরিয়ে কেরিয়ার সংক্রান্ত অনিশ্চয়তা। তবু এ বারের অলিম্পিক্সে ভারতীয় হকি দল দুটোর হার-না-মানা লড়াই হকির পাশাপাশি অন্যান্য খেলার সঙ্গে যুক্ত খেলোয়াড়দেরও নতুন করে উৎসাহ জোগাবে। হকিতে সাফল্য আরও একটা বিশেষ কারণে উল্লেখযোগ্য। ক্রিকেটকে বাদ দিলে অন্যান্য দলগত খেলায় ভারত সম্প্রতি সে ভাবে বড় কোনও সাফল্য পায়নি। অনেক বিশেষজ্ঞই বলেন, ব্যক্তিগত খেলার থেকে দলগত খেলায় খেতাব জয় অনেক বেশি কঠিন। কারণ, ব্যক্তিগত খেলায় সংশ্লিষ্ট খেলোয়াড় তাঁর প্রতিভা এবং দক্ষতার সমন্বয়ে অনেক সময় উতরে যান। কিন্তু দলগত খেলায় সম্মিলিত উদ্যোগের যথার্থ প্রয়োগ প্রয়োজন।

অলিম্পিক্সে যে সব ভারতীয় খেলোয়াড় পদক পান, তাঁদের নিয়ে কিছু দিন ধরে মিডিয়ায় পুঙ্খানুপুঙ্খ আলোচনা হয়। পদকজয়ীরাও যথারীতি পুরস্কৃত হন। আর্থিক ভাবে সমৃদ্ধ হওয়ার পাশাপাশি ভাল চাকরিও পেয়ে যান তাঁরা। তার পর একটা সময়ে আমাদের নজর অন্য দিকে ঘুরে যায়। টোকিয়ো অলিম্পিক্সে ভারতীয় ক্রীড়াবিদদের সাফল্যের রেশ যদি মিলিয়ে যায়, তা হলে আবার সেই পুরনো একঘেয়ে হতাশার গল্প ফিরে আসবে। হকি, কুস্তি, ব্যাডমিন্টন থেকে শুরু করে অন্যান্য খেলার ক্ষেত্রে পরিকাঠামোগত কোনও গলদ যেন না থাকে, সে দিকে কড়া নজর রাখতে হবে। প্রয়োজনে নতুন করে পরিকাঠামো তৈরি করতে হবে। বেসরকারি বিনিয়োগের তাৎপর্য অস্বীকার করা যায় না, তবে সরকারি উদ্যোগের কোনও বিকল্প নেই। নবীন পট্টনায়কের নেতৃত্বাধীন ওড়িশা সরকার ভারতীয় হকিতে ২০১৮ সাল থেকে অকাতরে বিনিয়োগ করে চলেছে। ভারতীয় পুরুষ এবং মহিলা, দুই দলেরই স্পনসর বর্তমান ওড়িশা সরকার। উপযুক্ত পরিবেশ-পরিকাঠামো পেলে সফল হতে বেশি সময় লাগে না, সেটাই এ বারের অলিম্পিক্সে প্রমাণ করে দিল পুরুষদের হকি দল। খেলোয়াড়দের প্রতিভা যাতে ‘কুঁড়ি’ অবস্থাতেই ঝরে না যায়, সেই দিকে সংশ্লিষ্ট প্রশাসকদের আন্তরিক নজর রাখা উচিত। রানি রামপাল, মনপ্রীত সিংহ, নীরজ চোপড়া, মীরাবাই চানু, রবি কুমার দাহিয়ারা প্রমাণ করে দিয়েছেন যে, আমাদের দেশে প্রতিভার কোনও অভাব নেই। প্রতিভার বিকাশ ঠিকঠাক হলে অলিম্পিক্সের ‘বাগান’-এ প্রচুর ভারতীয় ‘ফুল’ ফুটবে। আর ক্রিকেট-সর্বস্ব অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার এটাই তো সেরা সময়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

hockey Tokyo Olympics 2020
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE