সম্প্রতি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ দাবি করেছেন যে, নিরন্তর মুসলমান অনুপ্রবেশের ফলে পশ্চিমবঙ্গ ও অসমের বাংলাদেশ-সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে জনবিন্যাস দ্রুত বদলে যাচ্ছে, জাতীয় নিরাপত্তা বিপন্ন। স্বাধীনতা দিবসের ভাষণে প্রধানমন্ত্রীও একই আশঙ্কার কথা বলেছেন। প্রশ্ন হচ্ছে, এই দাবির সত্যাসত্য যাচাই করা যায় কী ভাবে। এই দাবি কি তথ্যনির্ভর, না কি নির্জলা রাজনৈতিক?
২০১১-র পর গত চোদ্দো বছরে কোনও জনশুমারি হয়নি দেশে। অসম রাজ্যের ক্ষেত্রে— ২০১১-র জনশুমারি মতে নয়টি সীমান্ত জেলায় রাজ্যের মোট জনসংখ্যায় মুসলমানদের আনুপাতিক উপস্থিতির হার হিন্দুদের ওই হার থেকে বেশি। ২০১১-র শুমারিতে অসমের চোদ্দোটি জেলায় জনসংখ্যা প্রবৃদ্ধির হার রাজ্যের গড় হার (১৭.০৭)-এর থেকে বেশি, তবে ২০০১-এর গড় হারের তুলনায় ১.৮৫ শতাংশ কম। তা থেকে এই সিদ্ধান্তে আসা যায় না যে, বাংলাদেশ থেকে মুসলমানরা রীতিমতো পরিকল্পনা করে সীমান্ত-জনবিন্যাস পাল্টে দিতে চাইছে। উল্টো দিকে অন্য তথ্যও রয়েছে। অসমে শহর এলাকায় জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ২৭.৮৯ শতাংশ, গ্রামীণ এলাকায় ১৫.৪৭ শতাংশ। হতেই পারে, অর্থনৈতিক কারণে গ্রাম থেকে শহরে আসছেন মানুষ, যা একটি স্বাভাবিক ঘটনা।
রইল বাকি সীমান্ত জেলায় সম্প্রতি মুসলমান জনসংখ্যার বিস্ফোরণের অভিযোগ। এখানে তিনটি পাল্টা যুক্তি দেওয়া জরুরি। প্রথম, অসম রাজ্যে জেলার সংখ্যা বেড়েছে, ফলে জেলাওয়ারি ধর্মীয় জনসংখ্যার অনুপাতে হেরফের হয়েছে। ধরা যাক, ১৯৮৩-র আগে অবিভক্ত কাছাড় জেলার কথা। দক্ষিণ অসমে তখন বাংলাদেশের সঙ্গে সীমান্ত জেলা ওই একটিই ছিল। ১৯৮১-তে অসমে জনশুমারি হয়নি। আমরা তাই অভাবে ১৯৭১-এর শুমারি ব্যবহার করছি। অবিভক্ত কাছাড় জেলায় হিন্দু বসতির অনুপাত ছিল ৫৯.৫৫ শতাংশ, আর মুসলমান, ৪০.৪৫ শতাংশ। অর্থাৎ, কাছাড় জেলায় তখন ছিল সন্তোষজনক হিন্দু আধিক্য। এ বার ১৯৮৩ সালে কাছাড় জেলা ভেঙে করিমগঞ্জ এবং ১৯৮৯ সালে আবার হাইলাকান্দি জেলা তৈরি হল, ছবি গেল পাল্টে। ওই দুই জেলায় মুসলমান হয়ে গেল সংখ্যাগুরু। খণ্ডিত কাছাড় জেলার জনসংখ্যায় হিন্দুদের আধিক্য রাতারাতি বেড়ে গেল। আজ তাই জন্যই বরাক উপত্যকার তিনটি সীমান্ত জেলার দু’টিতেই মুসলমান জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার বেশি।
দ্বিতীয়ত, বছর দুয়েক আগে রাজ্যে বিধানসভা এবং লোকসভা কেন্দ্রের সীমানা পুনর্বিন্যাস (ডিলিমিটেশন) হয়েছে। ওটা কার্যত ‘জেরিমেন্ডারিং’ (ভোটে জেতার জন্য নির্বাচনী কেন্দ্রগুলোতে কৃত্রিম ভাবে জনবিন্যাস পাল্টানো)— হিন্দুদের ঠেলে দেওয়া হল হিন্দু অধ্যুষিত কেন্দ্রগুলিতে। উল্টো দিকে, যে সব নির্বাচনী কেন্দ্রে মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ না হয়েও নির্ণায়ক শক্তি (৩০ শতাংশ), তাঁদের গুঁজে দেওয়া হল মুসলমান অধ্যুষিত কেন্দ্রে। উদ্দেশ্য, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী নিজেই বলেছেন, ‘ক্ষমতা থাকবে পুরোপুরি খিলঞ্জিয়াদের হাতে।’
তৃতীয়ত, ধর্মভিত্তিক ঘনবসতি (গেটো) দ্রুত বাড়ছে অসমে। হিন্দু এলাকায় মুসলমানদের জমি কেনা, ফ্ল্যাট কেনা বা ভাড়া নেওয়ার সুযোগ নেই। হিন্দুরাও মুসলমান এলাকায় বসত গড়তে যান না। সম্প্রতি স্থির হয়েছে, আন্তঃধর্মীয় জমি কেনা-বেচায় আগাম সরকারি অনুমোদন চাই। এর ফলে, মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ জেলায় হয়তো অন্য জেলা থেকে মুসলমানরা চলে গিয়েছেন, ‘নিজ’-এর লোকজনের সঙ্গেই থাকবেন বলে।
দেশের সব ধরনের সরকারি গোয়েন্দা সংস্থা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের অধীনেই কাজ করে। আইবি প্রধান তাঁর কাছেই রিপোর্ট করেন। ঘটনাচক্রে, ব্যুরোর বর্তমান প্রধান অসম-সন্তান। এমন হতেই পারে যে, তপন ডেকা তাঁর নিজের রাজ্যের উপর একটু বেশিই নজর রাখছেন। মোদ্দা কথা, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে নাকি গোয়েন্দা তথ্য রয়েছে যে, অসমের জনবিন্যাস পাল্টে দিতে বেআইনি অনুপ্রবেশ হচ্ছে। বাংলাদেশিরা ফি রোজ সদলবলে সীমান্ত দিয়ে সেঁধোচ্ছেন। প্রশ্ন হল, বিজিবি’র কথা ছেড়েই দিলাম, আমাদের দেশের পরাক্রমী এবং সদা-জাগ্রত বিএসএফ টহলদাররা কিছুই টের পাচ্ছেন না কেন? বিএসএফ-ও তো স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের অধীনেই! অর্থাৎ, অমিত শাহ চাইলেই দলজিৎ সিংহ চৌধরিকে ডেকে পাঠিয়ে জেনে নিতে পারেন সীমান্তে অতন্দ্র প্রহরীদের শ্যেন দৃষ্টি এড়িয়ে কী ভাবে ‘বাংলাদেশ’ ভারতে ঢুকে গেল।
এ সব নতুন নয়। তথ্য, পরিসংখ্যান ছাড়াই সেই বিশ শতকের গোড়া থেকেই অসম রাজ্য দেখে চলেছে অনুপ্রবেশের ভূত। স্বাধীনতার বয়স যখন সবে তিন বছর, অসম সাহিত্য সভার একুশতম অধিবেশনে অগ্নিকবি অম্বিকাগিরি রায়চৌধুরী তাঁর ভাষণে জানান, “অসমের আছে তিন শত্রু। পাকিস্তান-সমর্থক, কমিউনিস্ট আর বাঙালি।” এই জুজুর ভয় দেখিয়ে বরাবরই অসমিয়া জাতিকে আতঙ্কিত করে রেখেছে অসমিয়া জাতীয়তাবাদী শক্তির উগ্র অংশ। আজকাল যে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় দুর্গাপুজোয় বাংলায় লেখা দেখলেই কালি ছিটিয়ে উদ্যোক্তাদের হুমকি দেওয়া হয় তা কি নেহাতই আপতিক? মোটেই নয়।
১৯৯৭ থেকে ছয় বছরের জন্য অসমের রাজ্যপাল ছিলেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল এস কে সিন্হা। বাংলাদেশ থেকে অসমে অনুপ্রবেশের উপর তিনি এক প্রতিবেদন তৈরি করে পাঠান রাষ্ট্রপতির কাছে। গোপন প্রতিবেদন, তবু আশ্চর্য, ২২ পাতার সেই রিপোর্ট জনপরিসরে চলে আসে। রাজ্যে প্রবল আলোড়ন তৈরি করে। ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার সাংবাদিক, গবেষক, লেখক, প্রাবন্ধিক, বুদ্ধিজীবী, আমলাতন্ত্র, রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে সঙ্ঘ-শিবির সর্বত্র তখন বিজাতীয় উল্লাস। অথচ, ওই রিপোর্টে গল্পের গরুকে মগডালে উঠিয়ে অনুপ্রবেশের যে হিসেব দেওয়া হয়েছে তাতে গোটা বাংলাদেশটাই অসমের পেটে ঢুকে যায়। মনে হয়, মুসলমানরা মিছিল করে এসে বিনা-বাধায় অসমে ঢুকছে। এমন একটি রিপোর্ট প্রশাসনিক, রাজনৈতিক, এমনকি দেশের শীর্ষ আদালতে মান্যতা আদায় করে নিল কী ভাবে? সুপ্রিম কোর্টে ন্যায়াধীশ রঞ্জন গগৈ এবং রোহিংটন ফলি নরিম্যানের ২০১৪ সালের এক গুরুত্বপূর্ণ রায়ে শীর্ষ আদালতের নজরদারিতে অসমে এনআরসি প্রক্রিয়া চালু করার কথা বলা হয়।
স্বাধীনতার আগে, প্রশাসনের এক শীর্ষকর্তা চার্লস সেমার ম্যুলান— যিনি অসমের সেন্সাস সুপারিনটেন্ডেন্ট ছিলেন— একটি কুখ্যাত রিপোর্ট ছাপেন, যাতে ছিল ‘ইনভেশন অব আ ভাস্ট হোর্ড অব ল্যান্ড-হাঙ্গরি বেঙ্গলি ইমিগ্র্যান্টস’-এর কথা। দীর্ঘ ছেষট্টি বছর পর ওই বস্তাপচা রিপোর্টের কথাগুলো জেনারেল সিন্হা তাঁর প্রতিবেদনে অন্তর্ভুক্ত করেন। অথচ ১৯৩২ সালে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন ছিল— কোথায় ছিল বাংলাদেশ, কোথায় বা পাকিস্তান? আজকের অসমের সঙ্গে তুলনাই করা যায় না তখনকার চিফ কমিশনার-শাসিত অসম প্রদেশের। বিস্ময়ের এখানেই শেষ নয়। গগৈ এবং নরিম্যান তাঁদের রায়েও ম্যুলানের রিপোর্ট উচ্চারণ করেন। রাজ্যে অনুপ্রবেশ-বিরোধী শক্তি আজও ম্যুলান এবং এস কে সিন্হার মতকে ধ্রুবপদ হিসেবে মেনে নেয়। কারণ, তাতে বৈধ-অবৈধ, হিন্দু-মুসলমান কিছুই আসে যায় না। মোটের উপরে বাঙালি হলেই হল— তাড়াতে সুবিধে হয় যে!
ভারতে অসম রাজ্যের একটা বিশিষ্টতা আছে। ভারত এক বার ভাগ হয়েছে। কিন্তু অসম ভাগ হয়েছে বহু বার। ১৮২৬-এ ইয়ান্ডাবু সন্ধির পর চারটে ঘটনা ঘটে যা ইতিহাসের চারটে গুরুত্বপূর্ণ পৃষ্ঠা। ছ’শো বছরের অহোম রাজত্ব, তার পর ইংরেজ ঔপনিবেশিক শাসন, ইতিহাসের গতিতে আধুনিক অসমের জন্ম, এবং চতুর্থত— অসমকে জুতে দেওয়া হল বেঙ্গল প্রেসিডেন্সিতে। কৃষ্টি, ভাষা, সংস্কৃতি, কোনও মিলই নেই দুই ভুবনে। অসম শুধু রাজনৈতিক সার্বভৌমত্বই হারাল না, জলাঞ্জলি দিতে হল ভাষা ও সংস্কৃতির অধিকারও। ফলে ঔপনিবেশিক ভারতেই তৈরি হল বাঙালি বৈরিতা। ১৮৭৪-এ ঔপনিবেশিক শাসকরা অসমকে চিফ কমিশনার-শাসিত প্রদেশে উন্নীত করল। আপাতভাবে বাংলা ও বাঙালির ‘শাসন’ থেকে মুক্ত হল অসম। কিন্তু সেই সুখ টিকল না। নবগঠিত অসম প্রদেশের সঙ্গে যুক্ত হল তিনটি বাংলাভাষী-প্রধান জেলা, সিলেট, কাছাড় ও গোয়ালপাড়া। সংখ্যালঘু হয়ে গেলেন অসমিয়ারা, অনেকটা নিজভূমে পরবাসী হওয়ার মতো। আর বাঙালিরা প্রাত্যহিক ভিত্তিতে চোরাগোপ্তা হেনস্থা ও আক্রমণের শিকার হতে থাকলেন।
স্বাধীন ভারতে অসমের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী গোপীনাথ বরদলৈ বাঙালিকে সাবধান করে দেন— ‘আসাম ইজ় ওনলি ফর দি আসামিজ়’। বরদলৈ শাসনকালেই রাজ্যপাল জানিয়ে দেন যে, বাঙালিরা নতুন অসমে থাকতে পারবে, কিন্তু শর্তাধীন। তাকে অনুগত হতে হবে অসমিয়া জাতির কাছে। স্বাধীনতার সেই স্বর্ণালি সন্ধ্যায় গোটা দেশ যখন উদ্ভাসিত, তখন বিষণ্ণ, বিপন্ন অসমের বাঙালি অস্তিত্বের নতুন সংগ্রামের কথা ভাবছে। সেই সংগ্রাম এখনও রোজ চলছে। অথচ কে না জানে যে, নানা ধর্ম, জাতি, জনজাতি, ভাষা, সংস্কৃতির অপরূপ মিলনভূমি এই রাজ্যটি রবীন্দ্রনাথের ‘ভারততীর্থ’-এর যজ্ঞশালা হতে পারত। স্বদেশি বিদেশি কোনও শাসকই তা হতে দেননি, দেবেন না।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)