বাঙালি সমাজে ও সাহিত্যে জাতিভেদ প্রথার প্রকোপ কতখানি, তা নিয়ে বাঙালি নিজে কতখানি অবহিত, এ নিয়ে একটি চর্চা চলতে পারে। এ দিকে বিবাহ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জাতিপ্রথার আন্তঃসম্পর্ক নিয়ে কোনও চর্চার দরকার নেই, এতই তা বহু-প্রতিষ্ঠিত।
আসলে আমরা বাঙালিরা যতই নিজেদের প্রগতিশীল বলে দাবি করি না কেন, বর্ণবাদ গেঁথে রয়েছে আমাদের মননে, মগজে, মজ্জায়। এবং এই বিষের উপস্থিতি সম্বন্ধে আমরা অনেকেই সচেতন নই। যাঁরা সচেতন ভাবে জাতবিভাজনের মতো নিপীড়নকারী ব্যবস্থাকে লালনপালন করেন, মনে করেন এ হল দৈবনির্ধারিত, প্রাকৃতিক, স্বাভাবিক ব্যবস্থা, তাঁদের থেকেও সমস্যাজনক বলে মনে হয় আমাদের মধ্যে সেই মানুষদের, যাঁরা সচেতন ভাবে বহিরবয়বে সাম্যের বার্তা প্রচার করলেও অভ্যন্তরীণ ব্যক্তিজীবনে গভীর ভাবে ব্রাহ্মণ্যবাদী। লক্ষণীয়, বাংলা সাহিত্যের একটা বড় অংশই এই দোষে দুষ্ট। বাংলা সাহিত্যকে উনিশ শতক থেকে যে সাহিত্যিকেরা পুষ্ট করেছেন তাঁদের মধ্যে খুব অল্প কয়েক জনই সমাজের জাতিভিত্তিক অসাম্যকে দৃপ্তকণ্ঠে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় প্রশ্ন করেছেন। বাঙালি সাহিত্যিকদের জাত-সংক্রান্ত মনোভাবের মধ্যে বরং দেখা যায় এক রক্ষণশীল অথবা দোদুল্যমান অবস্থান। যে-হেতু পিতৃতন্ত্রের সঙ্গে জাতিভেদপ্রথার গাঁটছড়া বাঁধা, জাতের তথাকথিত শুদ্ধতা বজায় রাখতে প্রয়োজন নারীর জীবনের উপর, যৌনতার উপর নিয়ন্ত্রণ, জীবনসঙ্গী নির্বাচনের স্বাধীনতার উপর কড়া লাগাম। নারী যেন ভিন্ন জাতে বিয়ে না করেন অথবা ভিন্ন জাতের পুরুষের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন না করেন। নতুবা সন্তানের রক্ত হবে অশুদ্ধ, কলুষিত, জাতের শুদ্ধতা হবে বিপন্ন। অর্থাৎ জাতের শুদ্ধতা বজায় রাখার দায়টা বেশি নারীর।
এই উদ্বেগ বিশেষত উচ্চ জাতের মানুষের। আর এই উদ্বেগ থেকেই আন্তঃজাতি বিবাহের (কাস্ট এন্ডোগ্যামি) প্রচলন। প্রাচীন যুগে এই নিয়মের বজ্র আঁটুনির পাশাপাশি ব্যতিক্রমী যাপনের সুযোগ ছিল, তা বোঝা যায় অনুলোম বা প্রতিলোম বিবাহের স্বীকৃতি থেকে। তবে অবশ্যই স্বীকৃত হওয়া আর কাঙ্ক্ষিত হওয়া এক বিষয় নয়।
বর্তমান সময়ে কি এই অনুশাসনের করাল গ্রাস শিথিল হয়েছে? এখনও ভিন্ন জাতে বিয়ে করার শাস্তি হিসেবে নির্বিচারে হত্যা করা হয়। ভারতের অন্যান্য প্রদেশের তুলনায় বাংলায় হয়তো সম্মান-হত্যার ঘটনা কম ঘটে কিন্তু একেবারে ঘটে না তা নয়। কয়েকটি উদাহরণ দিই। ২০১৩ সালে বর্ধমানের ভাতার থানার অন্তর্গত একটি গ্রামে এক দম্পতিকে হত্যা করা হয়, কারণ তাঁরা বাড়ির অমতে পরস্পরকে ভালবেসে বিয়ে করেছিলেন। ২০১৯ সালে মালদহের এক দম্পতি তাঁদের ষোলো বছরের কন্যাকে হত্যা করে গঙ্গায় ফেলে দেন, কারণ সে ভিন জাতের ছেলের সঙ্গে প্রেম করেছিল। উল্লেখ্য, দু’জনের পদবি ছিল মণ্ডল, কিন্তু পদবি এক হলেও জাতিকাঠামোয় ছেলেটির অবস্থান ছিল নীচে। ২০২১ সালে আরামবাগের এক প্রেমিকযুগলকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়, বাড়ির অসম্মতিতে বিয়ে করেছিল তারা। ভিন্ন জাতে প্রেম বা বিয়ের ঘটনা ঘটলে আজও বাংলার বহু গ্রামে গ্রামে সালিশি সভা বসে। ভিন্ন ধর্মের বিয়ে বা বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্কের ক্ষেত্রে তো শাস্তি আরও ভয়ঙ্কর। বাংলার বিভিন্ন পত্রপত্রিকা বা অনলাইন ম্যাট্রিমোনিয়াল সাইটে উচ্চ শিক্ষিত উচ্চ প্রতিষ্ঠিত পাত্রপাত্রীর বিয়ের বিজ্ঞাপন দেখলে বোঝা যায়, শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সমাজেও অভিভাবক-নির্ধারিত বিয়ের ক্ষেত্রে জাতপাত এখনও জাঁকিয়ে বসে আছে। দুই একটা ‘অসবর্ণ চলিবে’ মার্কা বিজ্ঞাপন চোখে পড়ে ঠিকই, কিন্তু সিংহভাগ বিজ্ঞাপনে এখনও সমান জাতের পাত্র বা পাত্রী চাওয়া হয়। অর্থাৎ সমাজের একটা বড় অংশ আজও জাতপাত মেনেই বিয়ে করে, অথবা তাদের বিয়ে দেওয়া হয়।
উনিশ শতকে বাংলায় যে সমাজসংস্কার আন্দোলনের সূত্রপাত হয়েছিল তাকেও একটু প্রশ্ন করা দরকার এই প্রসঙ্গে। তখন কিন্তু শুধু উচ্চ জাতের মেয়েদের জীবন কিছুটা সহনীয় করে তোলার উদ্দেশ্যেই চালিত হয়েছিল সমাজসংস্কারের ধারা। নিম্ন জাতির মেয়েরা সেই সংস্কার প্রকল্পের আওতার বাইরে ছিল। শুধু তা-ই নয়, জাতিভেদপ্রথা সম্বন্ধে বেশির ভাগ চিন্তক ও সাহিত্যিকরা তখন ছিলেন নীরব। বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর নায়ক নায়িকাদের জাতি-ধর্ম-শ্রেণি মেনেই বিয়ে দিয়েছেন, যেখানে ধর্ম বা জাতের ফারাক, সেখানে বিয়ে শেষ অবধি ঘটেনি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কোনও গল্প উপন্যাসে ‘কাস্ট এন্ডোগ্যামি’ নিয়মের উল্লঙ্ঘন ঘটেছে কি?
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘বামুনের মেয়ে’, ‘অভাগীর স্বর্গ’ প্রভৃতি গল্পে গ্রামীণ সমাজের জাতিগত নিষ্পেষণের মর্মস্পর্শী চিত্র তুলে ধরেছেন। সরসীবালা বসুর ‘আগাছা’ এবং প্রবোধকুমার সান্যালের ‘আগ্নেয়গিরি’ ছোটগল্পে নিচু জাতের মানুষের প্রতি উঁচু জাতের বিদ্বেষের এক নিদারুণ উপস্থাপন ঘটছে। ‘বিলাসী’ গল্পে নিচু জাতের মেয়েকে বিয়ে করার কারণে এক জন উঁচু জাতের পুরুষের চূড়ান্ত হেনস্থা ও সামাজিক বয়কটের চিত্র তুলে ধরেছেন শরৎচন্দ্র। রমেশচন্দ্র দত্ত ‘সমাজ’ উপন্যাসে অসবর্ণ বিবাহ দেখানোর সাহস দেখিয়েছেন। এই ব্যতিক্রমী দু’-চারটি গল্প-উপন্যাস বাদ দিলে সাধারণ ভাবে জাতরেখা মেনেই প্রেম বা বিবাহ উপস্থাপিত হয়েছে ঔপনিবেশিক যুগের বাংলা সাহিত্যে। প্রেম বা বিয়ের ক্ষেত্রে জাতিগত সীমা লঙ্ঘনের দৃষ্টান্ত সে ভাবে চোখে পড়ে না।
স্বাধীনতা-পরবর্তী যুগে চিত্রটা খুব বেশি বদলেছে কি? ১৯৫৬ সালে সুবোধ ঘোষ তাঁর ‘সুজাতা’ উপন্যাসে (পরবর্তী কালে হিন্দি ভাষায় চলচ্চিত্রায়িত) একটি নিম্নবর্ণীয় মেয়ের সঙ্গে উচ্চবর্ণের পুরুষের প্রেম ও বিয়ে দেখিয়েছেন। তবে বাংলা চলচ্চিত্র জাত-মানসিকতায় কোনও বড় বদলের বার্তা দেয়নি। মন হরণ করা তুমুল জনপ্রিয় রোম্যান্টিক ছবির অনেক ক’টিতেই ব্রাহ্মণের সঙ্গে ব্রাহ্মণের প্রেম ও বিবাহ। শুধুমাত্র মুখোপাধ্যায়, চট্টোপাধ্যায় বা বন্দ্যোপাধ্যায় পদবি-যুক্ত নায়ক-নায়িকার মধ্যে প্রেম ও বিবাহ দেখানো ছবির তালিকা করলে সেটি বেশ লম্বাই হবে। পথে হল দেরী, পুত্রবধূ, হারানো সুর, সবার উপরে, ভানু গোয়েন্দা জহর এ্যাসিস্ট্যান্ট, দাদার কীর্তি, ভালবাসা ভালবাসা কয়েকটি উদাহরণ মাত্র। বাংলা ছবিতে ধনীর সঙ্গে দরিদ্রের প্রেম ও বিয়ে হামেশাই ঘটেছে, অর্থাৎ শ্রেণিগত অসাম্যকে অতিক্রম করা গিয়েছে, কিন্তু জাতের ফারাককে লঙ্ঘন করার স্পর্ধা মূলধারার চলচ্চিত্র-নির্মাতারা দেখাতে পারেননি। ব্যতিক্রমও আছে। ইন্দ্রাণী ছবিতে অভিভাবকদের প্রবল আপত্তির তোয়াক্কা না করে নায়ক-নায়িকা অসবর্ণ বিবাহ করেই ছাড়ে।
এখন বাংলা মেগা-সিরিয়ালেও এই ট্র্যাডিশন অব্যাহত। গল্পের কেন্দ্রে একটি মধ্যবিত্ত ব্রাহ্মণ বা কায়স্থ যৌথ পরিবার। জাত মেনেই প্রেম এবং বিবাহ। অবশ্য কখনও কোনও আদিবাসী মেয়ে বা শহুরে বস্তির মেয়ে গল্পে ঢুকে পড়ে সব ওলোটপালট করে দেয়। অবশ্য পরে জানা যায় মেয়েটি কোনও শহুরে মধ্যবিত্ত ব্রাহ্মণ পুরুষের অবৈধ সন্তান।
২০১৩ সালে কেন্দ্রীয় সরকারের উদ্যোগে চালু হয়েছে সবিতাবেন আম্বেডকর আন্তঃজাতি বিবাহ সহায়তা প্রকল্প। পশ্চিমবঙ্গে রাজ্য সরকারও অসবর্ণ বিবাহকে উৎসাহিত করার উদ্দেশ্যে একটি প্রকল্প গ্রহণ করেছে। এই প্রকল্প অনুযায়ী তফসিলি জাতিভুক্ত ব্যক্তি যদি অন্য কোনও জাতের ব্যক্তিকে বৈধ ভাবে বিয়ে করার পর আবেদন জানায় তা হলে ওই দম্পতিকে ভাতা প্রদান করা হবে।
তবে রাষ্ট্রীয় অবস্থান ব্যক্তিক বা সামাজিক অবস্থানে বদল ঘটাতে পারছে কত দূর, তা একটি বড় প্রশ্ন। প্রেম বা বিয়ে হতে হবে সমান জাতির নারী-পুরুষের মধ্যে, সাহিত্যে, চলচ্চিত্রে বা টিভির মেগাধারাবাহিকে আজও এই নিয়মের ব্যতিক্রম চোখে পড়ে না। তা ছাড়া সাহিত্য বা সংস্কৃতিতে স্রষ্টার নিজস্ব বিশ্বাস যা-ই হোক না কেন, পাঠক বা দর্শকের কাছে যে অসবর্ণ বিবাহ এখনও গ্রহণযোগ্য নয় তাও স্পষ্ট। কাঠগড়ায় তোলা হবে কত জন সাহিত্যিক বা চলচ্চিত্র/সিরিয়ালের নির্মাতাকে? এমন গভীরে এই জাতপাতের শিকড় গাঁথা যে গ্রাম উজাড় হয়ে যাবে বাছাবাছিতে বসলে। এটুকুই বলা যায় যে, যাঁরা পারতেন এই অতিপ্রয়োজনীয় মন বদলের কাজে সামনে এসে দাঁড়াতে, বাঙালি সমাজে, বাঙালি সাহিত্যে, তাঁরা তা করে উঠতে পারেননি।
ইতিহাস বিভাগ, ডায়মন্ড হারবার মহিলা বিশ্ববিদ্যালয়।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)