E-Paper

দড়ি টানাটানির কূটনীতি

জয়শঙ্কর পরামর্শ দিচ্ছেন আরাগচিকে সংযত থাকতে, যাতে সংঘর্ষ ছড়িয়ে না পড়ে। ইরানের উপর ইজ়রায়েলের আক্রমণ এক সপ্তাহ পার করেছে। এখনও তেহরান উপায় খুঁজছে, কী করে আরও জুতসই জবাব দেওয়া যায়।

প্রণয় শর্মা

শেষ আপডেট: ২০ জুন ২০২৫ ০৭:২০
অগ্নিবর্ষী: ইরানের পার্বত্য ভূমিতে অবস্থিত খনিজ তৈল সংরক্ষাণাগারে ইজ়রায়েলি ক্ষেপণাস্ত্র হানা, ১৬ জুন।

অগ্নিবর্ষী: ইরানের পার্বত্য ভূমিতে অবস্থিত খনিজ তৈল সংরক্ষাণাগারে ইজ়রায়েলি ক্ষেপণাস্ত্র হানা, ১৬ জুন। ছবি: রয়টার্স।

ইরানের বিদেশমন্ত্রী সৈয়দ আব্বাস আরাগচি গত মে মাসে যখন ভারতে এসেছিলেন, তখন পহেলগামে সন্ত্রাসবাদী হানার জেরে ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধ চলছে। তিনি তৎক্ষণাৎ ভারতের বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্করকে পরামর্শ দিয়েছিলেন সংযম দেখাতে, যাতে যুদ্ধ না ছড়ায়, আলোচনার মাধ্যমেই সমাধান হয়। মাত্র মাসখানেকের মধ্যে পরিস্থিতি একেবারে ঘুরে গিয়েছে। এখন জয়শঙ্কর পরামর্শ দিচ্ছেন আরাগচিকে সংযত থাকতে, যাতে সংঘর্ষ ছড়িয়ে না পড়ে। ইরানের উপর ইজ়রায়েলের আক্রমণ এক সপ্তাহ পার করেছে। এখনও তেহরান উপায় খুঁজছে, কী করে আরও জুতসই জবাব দেওয়া যায়।

ইরানের আণবিক কেন্দ্রগুলির উপর ইজ়রায়েলের ক্ষেপণাস্ত্রের হানা দিয়ে এই সংঘর্ষের শুরু হয়। প্রাণ হারান বেশ কিছু সামরিক আধিকারিক, আণবিক প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত বিজ্ঞানীরা। ইরান তার প্রত্যাঘাত করতে ইজ়রায়েলের যুদ্ধাস্ত্রের ঘাঁটিগুলি নিশানা করে ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ে। অচিরে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে যে, আমেরিকা যদি হস্তক্ষেপ না করে, তা হলে পশ্চিম এশিয়ার দুই প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তির মধ্যে এক দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধ শুরু হবে। ইজ়রায়েলের প্রাক্তন বিদেশমন্ত্রী স্লোমো বেন-আমি’র মতে, এ হল উচ্চাশার সংঘাত। ইরান আণবিক শক্তিসম্পন্ন দেশ হতে চায়। আর ইজ়রায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু মনে করেন, তাতে ইজ়রায়েলের অস্তিত্বই বিপন্ন হবে। সংবাদমাধ্যমকে তিনি বলেছেন, ইরান গোটা এলাকাটাকে এক ‘অন্তহীন যুদ্ধ’-এর দিকে ঠেলে দিচ্ছে, আণবিক অস্ত্র ব্যবহারের কিনারায় এসে দাঁড় করাচ্ছে। নেতানিয়াহু চান, তাঁকে সবাই মনে রাখুক সেই দেশনেতা বলে, যিনি ইরানের আণবিক প্রকল্পকে ধূলিসাৎ করে দিয়েছেন। বেন-আমি’র মতে, এই দুই লক্ষ্যই ভ্রান্ত এবং বিপজ্জনক।

ইরানের কাছে আণবিক অস্ত্র আছে, এ কথা অনেকে বিশ্বাস করলেও, ইরান কখনও স্বীকার করেনি। আমেরিকার সমর্থনের জোরে ইজ়রায়েল ওই অঞ্চলে আর কোনও দেশকে আণবিক অস্ত্র তৈরি করতে না দিয়ে, নিজের আধিপত্য বজায় রেখেছে। ইরানও আণবিক শক্তি হয়ে উঠছে, এই আশঙ্কায় আক্রমণ করল ইজ়রায়েল। কিন্তু তাতে গোটা এলাকা আরও অস্থির হয়ে উঠেছে।

এই দ্রুত-পরিবর্তনশীল পরিস্থিতিতে ভারতের অবস্থান কী? সম্প্রতি শাংহাই কোঅপারেশন অর্গানাইজ়েশন-এ ইজ়রায়েলের নিন্দা করা থেকে ভারত বিরত ছিল। রাষ্ট্রপুঞ্জেও ভারত ইজ়রায়েল-বিরোধী প্রস্তাবকে সমর্থন করেনি। তবে ইজ়রায়েল আর ইরান, দু’দেশেরই নেতাদের সঙ্গে টেলিফোনে বার্তালাপ চালাচ্ছে ভারত। আন্দাজ করতে চাইছে, পরিস্থিতি কোন দিকে বাঁক নিচ্ছে।

ইজ়রায়েল আর ইরান, দু’দেশই ভারতীয় কূটনীতির নিরিখে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভারতের যত তেল ও গ্যাস প্রয়োজন, তার ৬০ শতাংশ জোগান দেয় পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলি। গালফ কোঅপারেশন কাউন্সিলের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্যের অঙ্ক ১৬০ বিলিয়ন ডলার, এই অঞ্চলে ভারতের বিনিয়োগও দ্রুত বেড়েছে। পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলিতে প্রায় নব্বই লক্ষ ভারতীয় কাজ করেন, যাঁরা বাড়িতে পাঠান তিরিশ বিলিয়ন ডলার। তাঁদের পরিবারের খরচ মেটানো ছাড়াও, ওই টাকা ভারতকে সাহায্য করে তেলের বিল খানিকটা মেটাতে। যুদ্ধ যদি ইরান থেকে আশেপাশের দেশগুলিতে ছড়ায়, তা হলে ভারতের তেলের জোগান, ব্যবসা-বাণিজ্য ধাক্কা তো খাবেই, উপরন্তু এই অঞ্চলে কর্মরত এতগুলি ভারতীয়কে নিরাপদে দেশে ফিরিয়ে আনাও এক দুঃসাধ্য কাজ হয়ে উঠবে।

ভারতের সঙ্গে ইজ়রায়েলের সম্পর্ক গত কয়েক বছরে ক্রমশ ঘনিষ্ঠ হয়েছে। আজ ইজ়রায়েল ভারতের সবচেয়ে মূল্যবান জোটসঙ্গীদের অন্যতম। ইজ়রায়েলি অস্ত্রের সবচেয়ে বড় বাজার হল ভারত, দু’দেশ যৌথ ভাবে অস্ত্র তৈরি করে ভারতে। ভারতের অধিকাংশ বৃহৎ শিল্পসংস্থার ভাল রকম উপস্থিতি রয়েছে ইজ়রায়েলে। তার মধ্যে রয়েছে তথ্যপ্রযুক্তি, নির্মাণ, যন্ত্রাংশ ও গাড়ি নির্মাতা, ওষুধ, ব্যাঙ্ক প্রভৃতি নানা সংস্থা।

আমেরিকা যে-হেতু ইজ়রায়েলের সবচেয়ে বড় সমর্থক, তাই ইরানের সঙ্গে সম্পর্কেও সাবধানে ভারসাম্য রেখে চলতে হবে ভারতকে। ভারত আর আমেরিকা এখন বাণিজ্যিক চুক্তি প্রায় চূড়ান্ত করার পথে। জুলাইয়ের আগেই চুক্তি সই হয়ে গেলে ভারতীয়রা ২৫ শতাংশ বাড়তি শুল্ক এড়াতে পারবেন, যা আরোপ করার ভয় দেখিয়েছেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।

তুলনায় ইরানে ভারতের বিনিয়োগ সামান্যই, ভারতীয় বাণিজ্যিক সংস্থাগুলির উপস্থিতিও সে ভাবে দেখা যায় না ইরানে। এর অন্যতম কারণ, তেহরানের উপর আমেরিকার নিষেধাজ্ঞা, যা বহাল রয়েছে কয়েক দশক ধরে। ইরানে কর্মরত ভারতীয় সংস্থার উপরেও তা আরোপিত হতে পারে। গত বছর ভারত ইরানের সঙ্গে একটি চুক্তিতে সই করে, যাতে চাবাহার কমপ্লেক্স-এ শহিদ বেহেশতি বন্দর চালাতে পারে ভারত। ভারত বর্তমানে তালিবানের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করার চেষ্টা চালাচ্ছে। পাকিস্তানকে এড়িয়ে যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তানে খাদ্য, ওষুধ-সহ অত্যাবশ্যক পণ্য সরবরাহ করতে হলে চাবাহারের মাধ্যমে যাওয়ার ব্যবস্থা করা ভারতের জন্য অত্যন্ত জরুরি। তা ছাড়াও এই বন্দর ভারতে মধ্য এশিয়ার নাগাল পেতে সাহায্য করবে, যেখানে ভারত নিজের উপস্থিতি বাড়াতে চাইছে। কিন্তু আমেরিকা ইতিপূর্বে নিষেধাজ্ঞায় ছাড় দিলেও, ট্রাম্প সেই ছাড়পত্র এখন প্রত্যাহার করেছেন। তার ফলে চাবাহারে ভারতের বিপুল বিনিয়োগ, যার অঙ্ক তিনশো মিলিয়ন ডলার, এখন অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে।

তার উপর এই সংঘর্ষের ফলে হরমুজ় প্রণালী বন্ধ হতে পারে, এমন সম্ভাবনাও আছে। এই জলপথ দিয়েই ভারতে তেল এবং গ্যাস আসে। সংঘর্ষ আরও ছড়ালে লোহিত সাগরের যে পথ দিয়ে ভারতীয় পণ্য যায় ইউরোপ এবং আমেরিকায়, তা-ও বন্ধ হতে পারে। সর্বোপরি, দীর্ঘ দিন ধরে সংঘাত চললে তেল আর সারের দাম অত্যন্ত চড়া হবে, বাড়বে জাহাজের বিমার অঙ্কও। এ সব কিছুই ভারতের অর্থনীতিতে আঘাত করবে। অর্থনীতির বৃদ্ধির বর্তমান হার ধরে রাখা কঠিন হয়ে যাবে, এমন সম্ভাবনা যথেষ্ট।

ইজ়রায়েল সংঘর্ষের শুরুতে যত আস্ফালনই করে থাকুক, তা ইরানকে দমিয়ে দেওয়ার মতো আঘাত করে উঠতে পারেনি। পর্বতের গভীর অভ্যন্তরে ফোরডো আণবিক জ্বালানি তৈরির কারখানা এখনও অটুট রয়েছে। তাকে ধ্বংস করার মতো বিপুল বিস্ফোরক ইজ়রায়েলের নেই। বিশেষজ্ঞরা এ-ও মনে করছেন যে, যুদ্ধ বেশি দিন চললে পরিস্থিতি ক্রমশ ইরানের দিকে ঝুঁকতে পারে।

ট্রাম্পের সামনে এখন দুটো পথ। হয় ইজ়রায়েলের পক্ষ নিয়ে যুদ্ধে যোগ দিতে পারেন, না হলে যুদ্ধ থামানোর চেষ্টা করতে পারেন। যদি সংঘর্ষে যোগ দেন, তা হলে তাঁর লাভ কী হবে? বারাক ওবামা ইরানের সঙ্গে যে আণবিক চুক্তি করেছিল ২০১৫ সালে, তার চেয়ে ভাল চুক্তি তিনি আদায় করতে পারবেন না। উপরন্তু যুদ্ধে যোগ দিলে তিনি নিজের ঘোষিত নীতির বিরুদ্ধে যাবেন। আমেরিকার বাহিনীকে আন্তর্জাতিক সংঘাতে যুক্ত হতে দেবেন না, এমনই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তিনি।

এই পরিস্থিতির সামরিক সমাধান সম্ভব নয়, সম্ভব কেবল কূটনৈতিক সমাধান। সেই আলোচনায় মধ্যস্থতার জন্য ট্রাম্পের উপর ভরসা রাখা ছাড়া ইরানের গতি কী? এখন প্রশ্ন হল, ট্রাম্পের উপর কতখানি ভরসা রাখবে ইরান? আসল উদ্বেগ অন্যত্র। এত দিন ইরান বিশ্বের নেতাদের আশ্বস্ত করছিল যে আণবিক বোমা কখনওই বানাবে না। এই যুদ্ধের পর তেহরান যথাসম্ভব দ্রুত আণবিক বোমা তৈরি করার চেষ্টা করলে আশ্চর্য হওয়ার কিছু থাকবে না।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Israel Iran War Nuclear bomb

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy