E-Paper

আসল যুদ্ধটা অন্যত্র

অণ্ণা হজারের দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনের ঢেউ, আইটি-র বাড়বাড়ন্ত, নিত্যনতুন শহরের পত্তন, জিডিপি-র উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি ইত্যাদির ফলে হিন্দু-মুসলমান, জাতপাত, ঘৃণার রাজনীতি প্রায় মুছে যেতে বসল।

সুমন নাথ

শেষ আপডেট: ১৪ জুলাই ২০২৫ ০৬:১৮

২০০১ সালে দেশে যে মনমোহন সিংহ জমানা শুরু হয়, অনেকেরই মতে তা এক এমন শাসনব্যবস্থা তৈরি করে যা শেষ অবধি ‘টেকনোক্র্যাসি’কে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। মনমোহন সিংহ নিজে উদারনীতি এবং বাজার অর্থনীতির প্রতি বিশ্বাসী ছিলেন। কিন্তু তাঁর সরকার যে মহাত্মা গান্ধী ন্যাশনাল রুরাল এমপ্লয়মেন্ট গ্যারান্টি স্কিম, অথবা ফুড সিকিয়োরিটি অ্যাক্ট-এর মতো জনকল্যাণমূলক প্রকল্প চালু করে বাজারের উল্টো পথে হাঁটল, সে ক্ষেত্রে বামেদের গুরুত্ব অনস্বীকার্য, আর তার সঙ্গে অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ কংগ্রেসের অভ্যন্তরে সনিয়া গান্ধীর প্রতি সমর্থন। কংগ্রেস যে ভাবে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি এবং গবেষণা-নির্ভর প্রকল্প নির্মাণে মনোনিবেশ করেছিল, তা অচিরেই সরকারের সঙ্গে সঙ্গে দলেরও অভ্যন্তরে ন্যারেটিভ নির্মাণে জনকল্যাণমূলক প্রকল্পের প্রতি নির্ভরতা গড়ে দিল। ফলত দেশের মূল ন্যারেটিভ হয়ে গেল উন্নয়ন এবং তার ত্রুটি-বিচ্যুতি। ক্রমে অণ্ণা হজারের দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনের ঢেউ, আইটি-র বাড়বাড়ন্ত, নিত্যনতুন শহরের পত্তন, জিডিপি-র উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি ইত্যাদির ফলে হিন্দু-মুসলমান, জাতপাত, ঘৃণার রাজনীতি প্রায় মুছে যেতে বসল। ২০১৪ সালে ক্ষমতায় এসে বিজেপি-ও যে ন্যারেটিভ নির্মাণ করে, তা মূলত ছিল উন্নয়ন, গুজরাত মডেল, স্মার্ট সিটি এবং দুর্নীতিমুক্ত সরকার।

এ দিকে বিজেপি শাসনের এগারো বছর অতিক্রান্ত। স্মার্ট সিটি প্রকল্প নিয়ে আজকাল কোনও কথা কেউ শুনতে পান না। ম্যানুফ্যাকচারিং সেক্টরে বাড়বাড়ন্ত কিছু ঘটেছে এমনটা নয়। বিশ্বের দরবারে ভারত এক বিশালাকার শক্তিশালী দেশ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছে এ কথা এক শ্রেণির মিডিয়া প্রচার করলেও, দেশের প্রাপ্তির ভাঁড়ারে লাফিয়ে ওঠার মতো কিছু ঘটেনি। এ কথা যে কোনও সুস্থচিত্তের মানুষ স্বীকার করবেন যে রাতারাতি এ সব হয় না। সময় লাগে।

কিন্তু যেটা জরুরি সেটা হল দেশের মানুষের মধ্যে আকাঙ্ক্ষা তৈরি করে রাখা, জিইয়ে রাখা। আর এখানেই একটা মস্ত সমস্যা আমরা তৈরি করে ফেলেছি। ঠিক যে ভাবে আমাদের সমষ্টির স্মৃতি থেকে স্মার্ট সিটি প্রকল্প মুছে গেছে, ডিজিটাল ইন্ডিয়া-ও অস্তমিত, ঠিক সে ভাবেই আমাদের স্মৃতিতে তৈরি হয়েছে প্রতিশোধস্পৃহা, জাত্যভিমান এবং এক প্রবল অস্থিরতা। আর ঠিক এখানেই বিজেপির ন্যারেটিভ নির্মাণের সাফল্য।

বিজেপি যে ভাবে সাংস্কৃতিক অস্ত্রে প্রতিনিয়ত শাণ দিয়ে চলেছে, তা এক নির্দিষ্ট প্রকারের ভ্রান্তির জন্ম দিচ্ছে। এই ভ্রান্তির দরুন আমজনতার মধ্যে এক অদ্ভুত উন্মাদনা এবং অস্থিরতার সৃষ্টি হয়, এবং তা অত্যন্ত সুচারু ভাবে জিইয়ে রাখার জন্য রচিত হয় একের পর এক অপরায়ণের ধারা। গত কিছু বছরে আমরা যেমন দেখেছি ‘দেশদ্রোহী’, ‘টুকড়ে টুকড়ে গ্যাং’, ‘আরবান নকশাল’ ইত্যাদি শব্দবন্ধ সমস্বরে যে কোনও ভিন্নমতের গলা চেপে ধরা হয়েছে, তেমনই হাজার রকমের জেহাদ, যেমন ‘লাভ জেহাদ’, ‘জমি জেহাদ’, ‘ভোট জেহাদ’ এমনকি ‘করোনা জেহাদ’ একত্রে বুঝিয়ে দিয়েছে, কে কাকে করবে দোষারোপ, কাকে করতে হবে ঘৃণা এবং কাকেই বা ভাববে দেশদ্রোহী। এই রাজনৈতিক অপরায়ণে পেটোয়া সংবাদমাধ্যমের ক্রমাগত মিথ্যা প্রচার ও সামান্য সাফল্যকেও অতিরিক্ত বড় করে দেখানোর ফলে আজ জনমানসে দেশ সম্পর্কে যে একটা ভ্রান্ত বিকৃত ধারণা তৈরি হয়েছে, তা অমৃতকাল কিংবা রামরাজ্য নাম নিয়ে নিজেই নিজের দামামা বাজাতে ব্যস্ত।

এর সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছে গোমাংস সংক্রান্ত গণধোলাইয়ের যৌক্তিকতা থেকে শুরু করে নাগরিকত্ব আইন, তিন তালাক এবং রাম মন্দির। আজ বিজেপি যে সাফল্যের চূড়ায় বসে আছে, ২০২৪-এ বিরোধীদের লোকসভায় তুলনামূলক ভাল ফল সত্ত্বেও, তার একটি বড় কারণ বিরোধী দলগুলি, বিশেষত বাম এবং কংগ্রেস। এরা বিজেপির এই সাংস্কৃতিক ন্যারেটিভকে এখনও পর্যন্ত সঠিক মূল্যায়ন করে তা বদলানোর দিশা খুঁজে পায়নি।

এই প্রসঙ্গে সম্ভবত একমাত্র রাহুল গান্ধীরই প্রকাশ্য ও নিরবচ্ছিন্ন আরএসএস-বিরোধিতা, ‘ভারত জোড়ো যাত্রা’ দিয়ে ঘৃণার বিরুদ্ধে ভালবাসার ইস্তাহার দিয়ে তৈরি হল এক বিকল্প মেরু। তিনি যে জনসমর্থন তৈরি করতে পেরেছিলেন, ২০২৪-এর ভোটের ন্যারেটিভ নির্মাণে তা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল। আজ আর সহজে তাঁকে ‘পাপ্পু’, ‘শাহজ়াদা’ ইত্যাদি বলে লাভ হয় না। তবে দুর্ভাগ্য, ভোটের আগে তাঁর প্রতি যে সমর্থনের অনুরণন দেখা গিয়েছিল, তাতে ভাটা পড়েছে অনেকটাই।

ঘৃণার বিরুদ্ধে ভালবাসার সংগ্রাম যে অসম লড়াই রাহুল গান্ধী তা বিলক্ষণ জানেন, যেমন জানতেন মোহনদাস গান্ধী। এক অর্থে মহাত্মা গান্ধীর স্বাধীনতার লড়াই এক সাংস্কৃতিক রাজনীতি। তাঁর ‘আইডিয়া অব ইন্ডিয়া’ তিনি তৈরি করতে চেয়েছেন প্রার্থনাসঙ্গীতে। ‘বৈষ্ণব জন তো’ কিংবা ‘রঘুপতি রাঘব রাজা রাম’ তৈরি করেছিল ভারতীয় প্রতিবাদী রাজনীতির এক মৌলিক সুর। তেমনই তাঁর সত্যাগ্রহ, চরকা, অথবা ভাষাভিত্তিক রাজ্য গঠনের পক্ষে সওয়াল, সবই সাংস্কৃতিক শক্তিকে ভিত্তি করে গড়ে ওঠে। স্বাধীনতা-উত্তর ভারতবর্ষ জওহরলাল নেহরুর নেতৃত্বে যে বিজ্ঞান-প্রযুক্তি এবং প্রতিষ্ঠানভিত্তিক উন্নয়নের পথে অগ্রসর হয়েছিল, তার একটি শক্তপোক্ত এবং বৈচিত্রপূর্ণ সাংস্কৃতিক ভিত্তি ছিল— যার নির্মাণের পিছনে মোহনদাস গান্ধীর অবদান বিশাল।

মজার ব্যাপার, মহাত্মা গান্ধী যে ভাবে কংগ্রেসকে একটি সার্বিক সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে কল্পনা ও নির্মাণ করেছিলেন, আরএসএস ঠিক তারই বিপরীতে একটি হিন্দুত্ববাদী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। আজ রাহুল গান্ধী তথা কংগ্রেসের লড়াই যতটা রাজনৈতিক, তার চেয়েও অনেক ব্যাপক আকারে সাংস্কৃতিক। ভারতীয় সভ্যতার ভবিষ্যৎ স্বরূপ বিকাশের লড়াই চলছে এই দুই প্রতিষ্ঠানের মধ্যে। এই লড়াইয়ে আরএসএস-এর ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তা, স্থিতিস্থাপকতা এবং পরিবর্তনশীলতার সঙ্গে এঁটে ওঠার প্রয়োজনে কংগ্রেস ও বাম দলগুলির এখনই নিজেদের সাংস্কৃতিক শক্তির পর্যালোচনা প্রয়োজন। আরএসএস এবং বিজেপি তাদের দীর্ঘমেয়াদি সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে যে ভারত নির্মাণ করেছে, তাদের এই নিরলস পরিশ্রমের প্রতি যথেষ্ট গুরুত্ব আরোপ করা জরুরি।

আর এর থেকেও জরুরি আরএসএস ও তার ছত্রছায়ায় থাকা ‘শ্যাডো’ প্রতিষ্ঠানগুলি সম্পর্কে জানা এবং নিজ নিজ দলীয় কর্মীদের এ সম্পর্কে সচেতন করা। ধর্ম, কর্ম, ভারত বনাম ইন্ডিয়া-র লড়াই, হিন্দির আধিপত্য, অতি সম্প্রতি অমিত শাহের ইংরেজি ভাষা সম্পর্কে বিরূপ মনোভাব যে একটি একমাত্রিক অথচ সর্ব-অন্তর্ভুক্তিকরণ প্রক্রিয়ার অত্যন্ত শক্তিশালী অংশ, সে সম্পর্কে সম্যক ধারণা প্রয়োজন। যে ভাবে আরএসএস জনজাতিদের সঙ্গী করেছে, সে ভাবেই তারা এখন বিভিন্ন অপেক্ষাকৃত দুর্বল শ্রেণির অন্তর্ভুক্তিকরণের লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছে, এবং সফল হচ্ছে।

এক জন অন্ত্যজ মানুষ ঠিক কোন কোন ক্ষেত্রে অবহেলিত এবং উপেক্ষিত হয়েছেন দীর্ঘ দিন, শুধু ইংরেজি না জানার জন্য, এবং ঠিক কোথায় গিয়ে অমিত শাহের এই বক্তব্য আসলে তাঁরও বক্তব্য হয়ে ওঠে, এটা বলার অপেক্ষা রাখে না। আঞ্চলিক দলগুলি যত সহজে আঞ্চলিক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ব্যবহার করতে পারে, নমনীয় হিন্দুত্বকে তার অস্ত্র করে তুলতে পারে— কংগ্রেস এবং বামেদের পক্ষে তা করতে পারা প্রায় অসম্ভব।

সংবিধান রক্ষা, বহুত্বের পক্ষে লড়াই, দেশের অর্থনৈতিক সমস্যা, বিকল্প নীতির দিশা— এ সবে ভোটের ময়দানে কিছু সুবিধা হলেও, সাংস্কৃতিক দিশা ছাড়া জনমানসে এর প্রভাব হবে ক্ষণস্থায়ী।

নৃতত্ত্ব বিভাগ, ড. এ পি জে আবদুল কালাম সরকারি কলেজ

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Politics Culture BJP RSS

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy