E-Paper

কাছের লড়াই, দূরের লড়াই

ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা হিন্দি আগ্রাসন থেকে জনজাতিদের বাঁচাতে আলাদা রাজ্যের দাবি তোলে, উদ্দেশ্য ছিল ভাষা-সংস্কৃতি রক্ষা। স্বতন্ত্র ঝাড়খণ্ড রাজ্য হয়, সরকার গড়ে বিজেপি। তার পর পরই শুরু হিন্দি আগ্রাসন।

বেবী সাউ

শেষ আপডেট: ০৬ অক্টোবর ২০২৫ ০৬:২৬

হমারা ঘর মে তো কোই বাংলা নহি বোলতি! ফির ভি আমাকে বাংলা ভাল লাগে ম্যাম! আমি বর্ণ শিখে গেছি। আমিবিদ্যাসাগরকেও চিনি!”

পঞ্চম শ্রেণির ছোট্ট মেয়ে নেহা কুমারী। ঘাটশিলায় এক ভাষা-সংখ্যালঘু বিদ্যালয়ের ছাত্রী। ঝাড়খণ্ড রাজ্যে এখন হাতে-গোনা কয়েকটি স্কুল আছে যেখানে বাংলা ভাষা টিমটিমে আলোয় বেঁচে আছে— সংখ্যালঘু পর্যায়ে। অথচ এই ঝাড়খণ্ডেই একদা ছিল বাংলা ভাষাভাষীদের স্বর্ণযুগ। খুব বেশি আগের কথা নয়, পনেরো-কুড়ি বছর আগেও। স্কুলে যেমন বাংলা মাধ্যমে পড়াশোনার সুযোগ ছিল, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও বাংলার ছাত্রছাত্রীদের কলধ্বনিতে মুখর ছিল। নিয়মিত গবেষণার কাজ, অধ্যাপক নিয়োগ, বিদ্যালয়গুলোতে বাংলা শিক্ষক নিয়োগ, পড়াশোনা, সব হত বাংলা মাধ্যমে। সরকার বিনামূল্যে বাংলা পাঠ্যপুস্তক দিত। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা সাহিত্য-পড়ুয়াদের সংখ্যা ছিল চোখে পড়ার মতো। বিশেষত রাঁচী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ ছিল সমৃদ্ধ, প্রাণবন্ত।

পরিবর্তনটা শুরু হয় ঝাড়খণ্ড রাজ্যের আত্মপ্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই। ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা হিন্দি আগ্রাসন থেকে জনজাতিদের বাঁচাতে আলাদা রাজ্যের দাবি তোলে, উদ্দেশ্য ছিল ভাষা-সংস্কৃতি রক্ষা। স্বতন্ত্র ঝাড়খণ্ড রাজ্য হয়, সরকার গড়ে বিজেপি। তার পর পরই শুরু হিন্দি আগ্রাসন।

বিদ্যালয়গুলোকে সরকারি ভাবে হিন্দি মাধ্যম করা না হলেও, বন্ধ করে দেওয়া হয় বাংলা পাঠ্যপুস্তক বিতরণ। ঝাড়খণ্ডে বাংলা বই ছাপাও বন্ধ হয়ে যায়। বন্ধ হয়ে যায় বাংলা ভাষা-শিক্ষাদান। পরে ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা ক্ষমতায় এলেও বাংলা ভাষা তার মর্যাদা ফিরে পায়নি, তাকে ফিরিয়ে আনার ইচ্ছা ঝাড়খণ্ডে বসবাসকারী বাঙালিদের মধ্যেও দেখা যায়নি। সম্প্রতি ‘বাংলা ভাষা উন্নয়ন সমিতি’ দাবি তুলেছিল, বাংলা মাধ্যম স্কুলগুলোয় আবারও বাংলা পড়ানো হোক। কিন্তু প্রশাসনের জবাব, আগে এমন ছাত্রছাত্রী নিয়ে আসুন যারা বাংলা শিখতে চায়, তার পর স্কুল খোলা হবে। আজগুবি, হাস্যকর যুক্তি! রাজনৈতিক নেতার কাছে নেহা কুমারীর মতো শিশুমনের আবদার পৌঁছয় না, পৌঁছতে দেওয়াও হয় না। বাংলা ভাষা ও বাঙালির প্রতি এই উপেক্ষা বাংলার বাইরের যে রাজ্যগুলোতে তীব্র ভাবে অনুভূত হয়, তাদের মধ্যে ঝাড়খণ্ড অন্যতম।

প্রখ্যাত চেক লেখক মিলান কুন্দেরা এক বার ফিলিপ রথকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “মানুষ জানে সে অমর নয়, কিন্তু বিশ্বাস করে তার জাতি ও ভাষার মৃত্যু নেই।” রুশ দখলের পর চেক নাগরিকদের মনে হয়েছিল, তাঁরা ভাষা হারাবেন। আজ সেই ভয়টাই কাজ করছে ঝাড়খণ্ডের বাঙালিদের মধ্যেও। তাঁরা দেখছেন— কী নিপুণ কৌশলে বাংলা ভাষাটিকে এই রাজ্য থেকে সরিয়ে ফেলা হচ্ছে। কিন্তু সরকারি ভাবে স্বচ্ছ থাকতে বাংলা ভাষাকে ‘দ্বিতীয় ভাষা’ ঘোষণা করা হয়েছে— বাস্তবচিত্র যতই অন্য কথা বলুক না কেন।

ঝাড়খণ্ডে বসবাসকারী বাঙালিরা কোণঠাসা। মানসিক ভাবে বোঝানো হয় ঝাড়খণ্ডের সবাই ঝাড়খণ্ডী, কিন্তু বাঙালিরা আলাদা, তাঁরা বাঙালি। মাত্র দশ-পনেরো বছরের মধ্যে বাংলা ভাষাকে প্রায় বিলুপ্ত করে ফেলা হয়েছে। অথচ ঝাড়খণ্ডের রাঁচী, দুমকা, পটকা, পটমদা, পূর্ব সিংভূম, সরাইকেলা-সহ বহু অঞ্চলের ষাট-সত্তর শতাংশ মানুষ বাঙালি। এখানকার লোকগান— করম, টুসু, ভাদু— সবই রচিত ঝাড়খণ্ডী বাংলায়। পূজাপার্বণও হয় বাংলা পঞ্জিকা দেখে। রাস্তায় কান পাতলেই শোনা যায়, ঝাড়খণ্ডী বাংলায় কথা বলছেন সাধারণ মানুষ।

কিন্তু শিক্ষাব্যবস্থায় বাংলার জন্য কোনও জায়গা নেই। স্কুল স্তরে বাংলা পড়ানো বন্ধ হয়ে গেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগে ছাত্রছাত্রীরা কোথা থেকে আসবে? ফলে বাংলা বিভাগগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। অধ্যাপকদের অন্য কাজে যুক্ত করা হচ্ছে। এ কথা তো জানা, শিক্ষাব্যবস্থা থেকে সরিয়ে দিলেই ধীরে ধীরে ভাষার মৃত্যু ঘটে। কিছু দিন আগে ঘাটশিলা ও আশপাশের রেলস্টেশনগুলোতে বাংলায় লেখা নামফলক মুছে ফেলা হয়েছিল। বহু চেষ্টার পরে আবার কিছু ক্ষেত্রে বাংলায় লেখা ফিরেছে, কিন্তু তা সীমিত পরিসরে।

তবু মানুষ স্বপ্ন দেখেন। প্রতিকূলতার মধ্যেও ঝাড়খণ্ডের বাঙালিরা এখন খানিক হলেও জাগছেন। ভাষা ও সংস্কৃতি বাঁচিয়ে রাখার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। বিভিন্ন ছোটখাটো প্রতিষ্ঠান অবৈতনিক ভাবে বাংলা শেখাচ্ছে নতুন প্রজন্মকে। শুধু বাঙালিরা নন, হিন্দিভাষী, সাঁওতাল, ওড়িয়া ছাত্রছাত্রীরাও ভর্তি হচ্ছে এই সব প্রতিষ্ঠানে। বাচ্চারা মাথা দুলিয়ে পড়ছে— ‘আমাদের ছোট নদী...’, পরিচিত হচ্ছে ‘হুঁকোমুখো হ্যাংলা’র সঙ্গে। এই সব অবৈতনিক স্কুলে নেহা কুমারীর মতো ছাত্রীরা বিদ্যাসাগরকে চিনছে, বাংলার সঙ্গে পরিচিত হচ্ছে। শিক্ষাদান করছেন কলেজের অধ্যাপক, অবসরপ্রাপ্ত আধিকারিক বা সদ্য পাশ করা বাংলা সাহিত্য-পড়ুয়া।

আজ যখন বাংলা ভাষা বিপন্ন, এই উদ্যোগগুলো তখন এক দিকে আশা ও স্বপ্নের প্রতিশব্দ, আবার ভাষা আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের প্রতীকও। তবু প্রশ্ন থেকে যায়, এখনও কি সময় হয়নি বাঙালিদের সংগঠিত হয়ে ভাষা-অধিকারের জন্য বিদ্রোহে নামার, পরিপূর্ণ ভাবে ভাষা-অধিকার ছিনিয়ে নেওয়ার? বিরাট একটা প্রশ্ন ঘোরাঘুরি করে, কিন্তু বেড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধতে এগিয়ে যাওয়ার নেতৃত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

JMM Hindi Imposing Bengali

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy