এ বছর কোয়ান্টাম বলবিদ্যা আবিষ্কারের শতবর্ষ। ইউনেস্কো ২০২৫-কে ঘোষণা করছে কোয়ান্টাম বলবিদ্যা ও প্রযুক্তির আন্তর্জাতিক বর্ষ হিসেবে। আর, এই বছরই পদার্থবিদ্যায় নোবেল পেলেন তিন আমেরিকান পদার্থবিজ্ঞানী জন ক্লার্ক, মিশেল এইচ ডেভোরে ও জন এম মার্টিনিস— কোয়ান্টাম বলবিদ্যার ব্যবহারিক জগতে একটি যুগান্তকারী আবিষ্কারের জন্য— ম্যাক্রোস্কোপিক কোয়ান্টাম মেকানিক্যাল টানেলিং।
মাধ্যমিক স্তরে পরমাণুর গঠন বুঝতে পড়তে হয় বোরের মডেল। সৌরমণ্ডলের সঙ্গে তুলনা করে নিউক্লিয়াসকে কেন্দ্রে রেখে ইলেকট্রন ঘুরতে থাকার সময় যদি সে এক কক্ষপথ থেকে অন্য কক্ষে চলে যায়, তখন শক্তি বিকিরিত হয় কোয়ান্টাম কণার মাধ্যমে, তৈরি হয় বর্ণালি। আলোকশক্তির এই কোয়ান্টাম কণাকে বলে ফোটন। বিজ্ঞানী ম্যাক্স প্লাঙ্ক এই কোয়ান্টাম তত্ত্বের প্রবর্তক হলেও এই ধারণাটিকে সঠিক ভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে এগিয়ে আসেন আলবার্ট আইনস্টাইন। ১৯০৫ সালে প্রকাশিত তাঁর যুগান্তকারী পাঁচটি গবেষণাপত্রের একটি ছিল আলোকতড়িৎ ক্রিয়ার ব্যাখ্যায় কোয়ান্টাম তত্ত্বের প্রয়োগ। কিছু ধাতুর উপরে আলো পড়লে, আলোর ফোটন কণার শক্তি শোষণ করে ধাতুর ইলেকট্রন বেরিয়ে আসতে পারে বাইরে। আইনস্টাইন একটি সহজ সমীকরণের সাহায্যে বুঝিয়েছিলেন এই ঘটনার নানা পরীক্ষালব্ধ ফলাফল। পরবর্তী কালে আইনস্টাইন আপেক্ষিকতাবাদের বিশেষ ও সাধারণ তত্ত্বের মতো ঐতিহাসিক ভাবে গুরুত্বপূর্ণ নানা গবেষণা করেছেন। ১৯২১ সালে তাঁকে নোবেল পুরস্কার প্রদানের সময় তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানে বিস্ময়কর অবদান ছাড়াও আলোকতড়িৎ ক্রিয়ার সঠিক কোয়ান্টাম ব্যাখ্যা প্রদানের কথা বিশেষ ভাবে উল্লেখ করা হয়। শুরু হয় কোয়ান্টাম তত্ত্বের জয়জয়কার।
অণু-পরমাণুর ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জগৎকে নিউটনের বলবিদ্যা ব্যবহার করে বুঝতে চাইলে তৈরি হয় বিস্তর অসঙ্গতি। ইলেকট্রন, প্রোটন, নিউট্রন ও আরও ছোট ছোট কণা কেমন করে ছুটে বেড়ায়? ঢিল মারলে পাটকেল খেতে হবে— নিউটনের তৃতীয় গতিসূত্র কি এই সব কণা মেনে চলে? উত্তর মিলল ১৯২৫-১৯২৬ সাল জুড়ে। কোয়ান্টাম বলবিদ্যার সূচনা হল দুই বিজ্ঞানীর হাত ধরে— আরউইন শ্রোডিঙ্গার ও ওয়ার্নার হাইজ়েনবার্গ। কী অদ্ভুত সমাপতন! ইউরোপের এই দুই বিজ্ঞানী, একে অপরের দ্বারা সরাসরি প্রভাবিত না হয়ে স্বাধীন ভাবে ভিন্ন ভিন্ন পথে একই তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করলেন। অণু পরমাণুর জগতের কণাদের গতিপ্রকৃতি নির্ধারিত হল তাঁদের নামাঙ্কিত নতুন সমীকরণ দিয়ে। কণা, তরঙ্গ, অনিশ্চয়তা সব কিছু নিয়ে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হল পদার্থবিজ্ঞানে। পদার্থবিজ্ঞানের অনেক ব্যাখ্যাহীন ঘটনার একের পর এক জট খুলতে শুরু করল। বাকিটা আজ ইতিহাস। কোয়ান্টাম বলবিদ্যার প্রয়োগে রসায়ন, জীববিদ্যা থেকে শুরু করে বিজ্ঞানের নানা শাখা প্রশাখা সমৃদ্ধ হয়ে রাসায়নিক, মেডিক্যাল, ইলেকট্রনিক, কম্পিউটার ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আজ চরম বিস্ময়ের।
সাধারণত কোয়ান্টাম বলবিদ্যার প্রয়োগ ভাবা হয় অতি ক্ষুদ্র কণাদের নিয়ে তৈরি জগতে। একটু বড় মাপের জগতে, অর্থাৎ ম্যাক্রোস্কেলে, কোয়ান্টাম ঘটনার দেখা মেলা কঠিন চ্যালেঞ্জের বিষয়। সুপারকনডাক্টিভিটি বা অতিপরিবাহিতা বলে পদার্থবিজ্ঞানে একটি বিষয় আছে। একটি তাপমাত্রার নীচে কিছু কিছু পদার্থের কোনও রোধ থাকে না। যেমন, তরল পারদ -২৬৮.৯৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় রোধশূন্য হয়ে যায়। প্রসঙ্গত, এই অতিপরিবাহিতার ক্ষেত্রটি সরাসরি পদার্থবিজ্ঞানে এনে দিয়েছে একের পর নোবেল পুরস্কার। যেমন, ১৯১১ সালে অতিপরিবাহিতা ঘটনার প্রথম আবিষ্কারের জন্য কেমারলিং ওনস ১৯১৩ সালে নোবেল জয়ী হন। কোয়ান্টাম বলবিদ্যা প্রয়োগ করে সফল তত্ত্বের জন্য বার্ডিন, কুপার ও স্রিফার ১৯৭২ সালে নোবেল পুরস্কার পান।
১৯৬২ সালে কেমব্রিজের বাইশ বছরের তরুণ তাত্ত্বিক গবেষক জোসেফসন আরও একটি নতুন সম্ভাবনার কথা জানালেন— অতিপরিবাহীদের মধ্যে একটি পাতলা অপরিবাহীর জংশন বা সন্ধি তৈরি করলে তার মধ্যে দিয়ে অতিপরিবাহী বিদ্যুৎ কী ভাবে যায়, সেই বিষয়ে। অতিপরিবাহীর কুপারযুগ্ম কোয়ান্টাম কণারা যেন একজোট হয়ে সামনের প্রাচীর ভেদ করে চলে যায়। পদার্থবিজ্ঞানের ভাষায় এই ঘটনাকে বলা হয় টানেলিং। অচিরেই পরীক্ষার দ্বারা জোসেফসনের অনুমান সত্য প্রমাণিত হয়েছিল— ১৯৭৩ সালে তিনিও নোবেল পুরস্কার পান। এর পর অতিপরিবাহিতা একটু বেশি তাপমাত্রায় সম্ভব আবিষ্কার হতেই দুই বিজ্ঞানী বেদনোর্জ ও মুলার ১৯৮৭ সালে পান নোবেল পুরস্কার। ২০০৩ সালে আরও তিন বিজ্ঞানী আব্রিকসভ, গিন্সবার্গ ও লেজেট অতিপরিবাহিতা ও অতিপরিবাহিতাসংক্রান্ত মৌলিক গবেষণার জন্য নোবেলে ভূষিত হন। কিন্তু এই ধারবাহিকতায় জোসেফসন জংশন বা সন্ধি আজও সমান প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে।
এ বছরের তিন নোবেলজয়ীর আবিষ্কারের পিছনেও আছে সেই জোসেফসন জংশন। অধ্যাপক জন, গবেষক ছাত্র জন ও পোস্টডক মিশেল আশির দশকে একের পর গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছিলেন। তাঁদের গবেষণার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হল এক নতুন দিগন্ত। কোয়ান্টাম বলবিদ্যার অতিক্ষুদ্র জগতের সীমানা ছাড়িয়ে যেন আমাদের দৃশ্যমান জগতের পরিসরে এই জোসেফসন জংশনের টানেলিং সম্ভব। সব কুপারযুগ্ম একজোট হয়ে দশা পরিবর্তন করতে পারে— শূন্য বিভব থেকে একটি নির্দিষ্ট বিভব দশায় আসতে যে সময় নেয়, তাও বার বার পরিমাপের মাধ্যমে তত্ত্বের সঙ্গে পরীক্ষালব্ধ ফলাফল প্রতিষ্ঠিত হল। এই কণাজোটের তাৎপর্য অপরিসীম। কোয়ান্টাম কম্পিউটারের বাস্তবায়নে এই কণাজোটের ব্যবহার কিউবিটের ধারণাকে আরও সাফল্যের দিকে চালিত করতে পারে। ভবিষ্যৎ বলবে এই ধরনের আবিষ্কার কোয়ান্টাম প্রযুক্তি-সহ মানবসভ্যতাকে কী ভাবে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
পদার্থবিদ্যা বিভাগ, সেন্ট জ়েভিয়ার’স কলেজ, কলকাতা।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)