পুনশ্চ দিয়ে কি লেখা শুরু হয়। সে তো থাকবে শেষে। কিছু ভুলে গেলে আবার ফিরে আসা।
না হে, পুনশ্চ দিয়েও শুরু করা যায়। ফিরে আসার পর। ঠিক সেমিকোলন ট্যাটু আন্দোলনের মতো। পূর্ণচিহ্ন পড়তে পারত, পড়েনি। বরং তা না দিয়ে আরও এগিয়ে যাওয়া। যাঁরা ফিরে এসেছেন স্বেচ্ছামৃত্যুর থেকে, তাঁদের পাশে দাঁড়াতে সেমিকোলন আঁকা হয় শরীরে।
কিন্তু এখানে তো স্বেচ্ছামৃত্যু নেই।
নেই। তবে ফিরে আসা আছে। রমাপদ চৌধুরীর চড়াই উপন্যাসে নিরূপা আত্মহত্যা করতে গিয়েছিল গঙ্গার ঘাটে। পারেনি। পরে জীবনের হাত ধরে সমীরণকে সে বলেছিল, গঙ্গার পাড়ে সেই জায়গায় তাকে আবার নিয়ে যাবে কি না। কেন? ওখান থেকেই তো সব বদলে গেল।
ওই লাইনটাই তো মাথায় ঘোরে। সব বদলে গেল!
কী ভাবে বদলায়?
কেন একটা বারান্দায়!
কণিকা না সুচিত্রা?
মাথা নেড়ে সম্মতি দ্বিতীয় নামে।
লম্বা টানা বারান্দায় শীতের রোদ। অল্প সময়ের জন্য তার তাপ নিতে বসানো হয়েছে বৃদ্ধাকে।
ভাল লাগছে রোদ?
হ্যাঁ।
মোবাইল নিয়ে আসেন সহায়িকা। গান চালিয়ে দেন। তিনি কিছু খোঁজার চেষ্টা করেন।
এসে দাঁড়ান পুত্র।
জিজ্ঞাসা, রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনবে?
রোগতপ্ত বারান্দায় হঠাৎ জেগে ওঠেন সুচিত্রা মিত্র, ‘এই মলিন বস্ত্র ছাড়তে হবে’। পর পর গান চলে। এক সময় নির্ভুল গলা মেলান বৃদ্ধা, এই সে দিনও যিনি আইটিইউ-তে ছিলেন।
এক সময়ে চোখ বুজে সুচিত্রার সঙ্গে তিনি গাইতে থাকেন— ‘আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু’।
তরঙ্গ মিলায়ে যায়, তরঙ্গ উঠে... বৃদ্ধার গলায় শুনতে শুনতে যাদের শরীর কেঁপে ওঠে, তাদের এক জন ভাবতে থাকে, রবীন্দ্রসঙ্গীত তো নয়, সব কিছু এলোমেলো হয়ে যাওয়া ঠেকাতে সে তো রাতে বার বার ভাবছিল টেনিদার বাকি তিন সঙ্গীর নাম কী, লুপে মাথার মধ্যে ওয়াশিং পাউডার নিরমা-র জিঙ্গল। পুরো জিঙ্গলটা বার বার মনে করতে পারছে কি না, সেই চেষ্টা করতে করতে সে ভাবছিল, বেরোতেই হবে এই অন্ধকার থেকে। তার মনে হচ্ছিল, শরীরের কাঁপুনি অনেকটা উল্কাপাত দেখার মতো। কেউ প্রথমে দেখতে পায়, কেউ পরে। তার পর এক সময়ে সকলে এক সঙ্গে দেখতে পায় আকাশ থেকে ঝরে পড়ছে উজ্জ্বল কিছু। তেমনই কাঁপুনি প্রথমে দেখতে পান না সিস্টার, ডাক্তার দেখতে পান না, তার পর সকলেই দেখেন এক সময়ে। আইভি-র তরল বদলায়।
ওই টানা বারান্দায় সকালে হাসিমুখে হাঁটে কোলন ক্যানসার-জয়ী তরুণী। যার দু’টি অস্ত্রোপচার হয়েছে। আরও দুটো হবে। হাতে বর্জ্য-পাউচ ধরে হাঁটতে হাঁটতে ভোরের আলোর মতো সে হাসে।
আসলে হাসে জীবন।
কেমো-ক্লান্ত শরীরে স্ট্র দিয়ে ডাবের জল টানার প্রলেপের মতো জীবন ভাসে ওই বারান্দায় কখনও।
জীবন হাঁটে। আস্তে আস্তে। কখনও গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে দেখে, সামনের মাঠে উচ্ছল তরুণীর দল দৌড়চ্ছে, প্রাণপণ। স্পোর্টস? কাদের?
নার্সিংয়ের ছাত্রী সব। হস্টেলে থাকে।
ওটা কী খেলা? পাশ থেকে সিস্টার বলে যান, খো খো। জীবন মৃত্যুর সামনে বসে দান দেয়।
জীবনই তো! নইলে রোগ-জর্জর ওয়র্ডে সাফাইকর্মী থেকে নার্স, সকলে হাসিমুখে বলে যান— হ্যাপি নিউ ইয়ার! কী আশ্চর্য। রোগ, মৃত্যু, ব্যথা, বর্জ্য নিয়ে ঘাঁটতে ঘাঁটতেও ভেসে বেড়ায় অকৃত্রিম শুভেচ্ছা, নতুন বছর, নতুন আশা।
কেমন সে আশা? বাবার চাকরি হবে।
“বাবার চাকরি গিয়েছে, কারখানা বন্ধ হয়ে গেল। আমার বাবার বয়স তখন ৪৯ বছর। এখন ৫০। কাজ করতে পারে ভাল রকম। অনেককে বলেছি চাকরির কথা। কেউ দেয়নি। দেখি...।” কারখানারই পুরনো কোয়ার্টার্সে মা-বাবা-মেয়ের সংসার। ভরসা বলতে মেয়ের রোজগার। নাইট ডিউটিতে এসে সেই মেয়ে বলে, “আজ ভাল খাবার এনেছি দিদি, পরোটা-মাংস। মা রেঁধে দিয়েছে।” মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। প্রজাপতির মতো সে উড়ে বেড়ায়। চোখের সামনে ভেসে ওঠে একটা পুরনো কোয়ার্টার্স, উঠোন, হয়তো মলিন আলোর বাল্ব, ঘরে একটা খাটে ডাঁই করা লেপ-তোশক। রান্নাঘরে বসে মা রাঁধছেন মেয়ের রাতের খাবার। হাসপাতালে এলেই বাবার ফোন, ঠিকমতো পৌঁছেছে কি না। রাতে ঠিকমতো আছে কি না, খেয়েছে কি না।
মধ্যরাত পেরোলে আর এক সহায়িকা টুক করে কাছে এসে বলেন, “মেরি ক্রিসমাস। একটা কেক সকলে ভাগ করে খেয়ে জিসাস ক্রাইস্টের জন্মদিন পালন করলাম।” আর যাঁকে বলেন, তাঁর মনে পড়ে টাইটানিক ছবিতে ডুবতে থাকা দু’টি মানুষ আকাশের তারা দেখে পরস্পরকে বলছিল— মেরি ক্রিসমাস। আর সেন্ট্রাল লাইন করার সময়ে রোগীর মনে হয়, “হাতে-পায়ে পেরেক ঠোকার সময়ে কী মনে হয়েছিল জিশু খ্রিস্টের, সেই রকম যন্ত্রণা তো কিছু হচ্ছে না। সহ্য করি। সহ্য করি।”
আর তাঁদের কী মনে হয়?
ওই ওয়র্ডের বাইরে যে আলাদা জগৎ! যেখানে রোগী-পরিজন ঠাসাঠাসি করিডরে এগোনোর উপায়ই নেই হুইল চেয়ার ঠেলে। রোদ মাথায় নিয়ে ট্রলিতে স্ত্রীকে কোনও ক্রমে গেলাস থেকে কিছু খাওয়ানোর চেষ্টা করেন স্বামী। স্ত্রী হাত ধরে কিছু বলেন অসুস্থ সঙ্গীকে, যুবকের গলা দিয়ে কিছু অদ্ভুত গোঙানি বেরোয়। শিশুপুত্র ‘বাবা, বাবা’ বলে ডাকতে থাকে। অসুস্থ সন্তানকে কম্বলে জড়িয়ে মেঝেতে বসে থাকেন মা। পাশে আর একটি সন্তান।
ডাক্তার দেখানোর অপেক্ষায় মাটিতে বসে থাকা লাইনে অক্লেশে মুড়ি, জল, বিস্কুট খেতে থাকেন মানুষ। ভনভন করে মাছি, বোতলের জল ছোট ছোট কাদার গর্ত তৈরি করে। রাতে, শীতে প্লাস্টিক-ছাউনি করে কম্বল জড়িয়ে শুয়ে থাকেন মানুষেরা। পর দিন ডাক্তার দেখাবেন বলে। নিঝুম রাতে সেখানেই কেউ কেঁদে ওঠেন, “ও ছাড়া আমার তো আর কেউ নেই।”
সহ্য করো, মানিয়ে নাও। এই তো অপেক্ষা-তলার জীবন। নইলে গণশৌচালয়ে স্নান সেরে সকালে-দুপুরে নিপুণ ভাবে কেউ ধোয়া শাড়ি মেলে দেন, কেউ শার্ট? যেমন ভাবে মানুষ নিজের উঠোনে কাপড় মেলে দেন অনায়াসে! হাসপাতালে, খোলা আকাশের নীচে গাছতলায় কী ভাবে মানিয়ে নিয়েছেন মানুষ। কত দিনের সংসার ওই খোলা মাঠে, শুধু চিকিৎসার জন্য। দুপুরে ডিমভাতের স্টলে লাইন দেন কেউ। কেউ কাগজ পেতে, স্বামী, সন্তানকে বসিয়ে কৌটো খুলে খাওয়াতে বসেন। ধুলোর মধ্যেই। আর এক বৃদ্ধ শুয়ে পড়েছেন পাশে। তাঁকে ওঠানোর চেষ্টা করেন ছেলে, খাওয়াবেন। কোনও ক্রমে উঠে কাগজের প্লেট থেকে খাওয়ার চেষ্টা করেন বৃদ্ধ। কী খান? গাছের আড়াল থেকে বোঝা যায় না।
ভোর থেকে তাঁরা আসতে থাকেন। দু’টি বড় ব্যাগে ঠেসে ঢোকানো জামাকাপড়, বড় টিফিন কৌটো, ধূসর হয়ে আসা জলের বোতল। শীতে লাল-কালো কম্বল থাকে ব্যাগে। আর বর্ষায়? প্লাস্টিক মাথায় দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা। এই তো জীবন আরোগ্য নিকেতনের পদতলে। কুয়াশার সকালে ভেজা ঠান্ডায় কম্বলে মোড়া তিনটি প্রাণী ঘেরা জায়গায় এসে বসে। বাবা, মা, শিশু। মা খাওয়ান। শিশু খেলে। রোদ ওঠে। মরা রোদ। আউটডোরের ঘোষণার ফাঁকে রবীন্দ্রসঙ্গীতের সুর। কে শোনে।
কেন মানুষই শোনেন।
মানুষই তো এই ভাবে সহ্য করেন। মানিয়ে নিতে বাধ্য হন। বাঁচেন। বাঁচান প্রিয়জনকে। গণ্ডূষ থেকে গড়িয়ে পড়া জলের মতো জীবন চেটে খান।
সেখানেই ২৫ ডিসেম্বর সকালে ঘুরে ঘুরে ডাবের জল খাইয়ে যান এক জন, সাইকেল ঠেলে ঠেলে। প্লাস্টিক পেতে বসে বা শুয়ে থাকা অসংখ্য শরীরকে।
কে তিনি?
জীবনই হবেন।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)