২০১৩ সাল। এই দেশে (যেখানে সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে) এক সামন্তরাজা (যদিও জনপ্রতিনিধি, কিন্তু হাবভাব রাজার মতো, কারণ তখন তিনি জনগণের ভোটে নির্বাচিত রাজা হবেন বলে আকাশ-বাতাস কম্পিত) বলেছিলেন, “ধরুন অন্য কেউ গাড়ি চালাচ্ছেন, আর আপনি পিছনে বসে। একটা কুকুরছানা গাড়ির সামনে পড়ল ও চাপা পড়ল, আপনার কি দুঃখ হবে না? নিশ্চয় হবে। আমার রাজ্যে যা হয়েছে, তার জন্য নিশ্চয় আমার দুঃখ হয়েছে।” প্রশ্নের পরিপ্রেক্ষিতটি ছিল অঙ্গরাজ্যে প্রায় দু’দশক পূর্বে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় সংখ্যালঘু মুসলিমদের হত্যালীলা। যেখানে ট্রেনে আগুনে করসেবকদের পুড়ে মৃত্যুর পর পরিকল্পিত ভাবে আক্রমণ চালানো হয়েছিল সংখ্যালঘুদের উপরে। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিও পুড়ে মরার থেকে রেহাই পাননি। সরকারি দফতরে ফোন করে তিনি সাহায্য পাননি বলেই অভিযোগ।
এই ঘটনায় দেশ ও বিশ্ব তোলপাড় হয়ে গেলেও তা যে অঙ্গরাজ্যের সামন্তরাজার হৃদয়ে কুকুর-শাবকের মৃত্যুর তুল্য, তা স্পষ্ট হয়ে ওঠায় ধিক্কার-ছিছিক্কার কম হয়নি। কিন্তু তাতে বৃহত্তর মনুষ্যসমাজের কিছুই আসে যায়নি, কারণ সামন্তরাজা বিপুল ভোটে রাজা নির্বাচিত হন। পরবর্তী কালে আর কুকুর-মন্তব্য শোনা না গেলেও কৃষকের মৃত্যু, পরিযায়ী মৃত্যুতে তাঁর নীরবতা, কখনও বা মৃত্যুর হিসাব না রাখারই মানসিকতা পরিস্ফুট হয়েছে।
মনে পড়ছে, কুকুর-শাবকের মৃত্যু সংক্রান্ত উদাহরণ যে ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে করা হয়েছিল, সেই সময়ে দেশের সর্বোচ্চ জনপ্রতিনিধি ওই সামন্তরাজাকে নিয়ে একটি সাংবাদিক বৈঠক করেন। ওই সামন্তরাজাকে তিনি কী পরামর্শ দেবেন, সেই প্রশ্নের উত্তরে শীর্ষ নেতা বলেছিলেন, “আমি স্মরণ করিয়ে দিতে চাই রাজধর্মের কথা। আমরা যেন রাজধর্ম (দুর্বলকে রক্ষা করা, সকলের প্রতি সমান ব্যবহার ইত্যাদি) পালন করি।” পাশ থেকে মাইক্রোফোনের সামনে মুখ নিয়ে সামন্তরাজা বলেছিলেন, “আমি তো রাজধর্মই পালন করছি, স্যর।” কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর মুখে লেগেছিল এক ভয়ঙ্কর হাসি।
এ সব কথাই মনে করিয়ে দেওয়া দরকার। কারণ, দিন কয়েক আগেই এ রাজ্যের সর্বোচ্চ নেত্রী (যিনি ওই সামন্তরাজার সাম্প্রদায়িক মনোভাবের এবং কু-মন্তব্যের কট্টর বিরোধী) বলেছেন, “আমার বাড়ির সামনে দিয়ে মৃতদেহ নিয়ে যাচ্ছ? তোমার বাড়ির সামনে মরা কুকুর ফেলে দিলে ভাল হবে? গন্ধে দশ দিন খেতে পারবে না।” পরিপ্রেক্ষিতটি কী? বিপক্ষ দলের এক নেতার মৃতদেহ নিয়ে মিছিল। কুকুরের সঙ্গে তুলনা সম্ভবত জননেত্রীর খুবই পছন্দের, কারণ বছর কয়েক আগে সরকারি কর্মচারীদের ডিএ সংক্রান্ত দাবির উল্লেখ করতে গিয়েও তিনি ঘেউ-ঘেউ, কেউ-কেউ জাতীয় শব্দবন্ধ ব্যবহার করেছিলেন। এক কালে দাপুটে কর্মী ইউনিয়ন কার্যত নীরবে তা হজম করে। নাগরিক সমাজ থেকেও কোনও প্রতিবাদবাক্য শোনা যায়নি। যা প্রতিবাদ, পুরোটাই বিপক্ষ রাজনৈতিক দলের। এ বারও কুকুর-সংক্রান্ত মন্তব্যের তেমন প্রতিবাদ শোনাই যায়নি, বিপক্ষ রাজনৈতিক দলের কিছু প্রতিবাদ ছাড়া।
দু’টি উদাহরণ থেকেই বোঝা যায় যে, একটি গণতন্ত্রেও জনপ্রতিনিধিরা নিজেদের রাজা-রানি, সোজা কথায় শাসক বলে ভাবতে শুরু করেন। ফলে মানুষকে মনুষ্যেতর প্রাণী বলে দাগিয়ে দেওয়াটা তাঁদের কণ্ঠ থেকে অনায়াসে নিঃসৃত হয়। যা নিখাদ এবং অমার্জনীয় স্পর্ধা। জনপ্রতিনিধির তা সাজে না। বরং বলা ভাল, মানুষকে অসম্মানের এই স্পর্ধা মানুষেরই ভোটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির আসে কোথা থেকে? তাঁরা প্রশাসক মাত্র, শাসক নন। এই কথাটা কি তাঁরা ভুলে গিয়েছেন।
এই তথাকথিত শাসককুলের হয়তো ভরসা এই যে, জনতার স্মৃতি স্বল্প ক্ষণের। তাঁদের ভরসা হয়তো এটাও যে, জনতার একাংশও রাস্তায় বসে থাকা কুকুরকে ঢিল মারতে, লাথি মারতে, গায়ে গরম জল ঢেলে দিয়ে মজা পেতে অভ্যস্ত। অভ্যস্ত অপছন্দের লোককে কুকুর বলে গালি পাড়তে। তাঁরাও তো ভোটার। ফলে জনপ্রতিনিধিরা হয়তো ধরেই নেন, বিপক্ষের লোকের সঙ্গে বা সংখ্যালঘুর সঙ্গে কুকুরের তুলনা পরোক্ষে বা সরাসরি করলে সংখ্যাগুরু বা তাঁদের ভোটারকুলের কিছুই যাবে আসবে না। বরং তাঁরা উল্লসিত হবেন।
ছোটবেলা থেকেই আমরা পড়ে এসেছি, কুকুর মানুষের বন্ধু। বাস্তবেও তা আমরা জানি। তার উদাহরণ দিতে গেলে পাতার পর পাতা ফুরোবে না। এই ক্ষুদ্র নিবন্ধে সেই প্রশ্নে যাচ্ছিই না। শুধু স্পর্ধার সঙ্গে মনে করিয়ে দিতে চাওয়া, ভারত একটি গণতন্ত্র। সেখানে জনগণ প্রতিনিধিদের নির্বাচন করেন। সেই জনমত, তা সাফল্য হোক বা ব্যর্থতা, মাথা নত করে বিনয়ের সঙ্গে গ্রহণ করা গণতন্ত্রের আবশ্যিক শর্ত। এ দেশ রাজা-রানির নয়, যদিও ‘হুজুর আমার মা-বাপ’ গোত্রের মনোভাব সাধারণ মানুষ এবং জনপ্রতিনিধিদের অনেকের মধ্যেই বহাল। সেটা যত তাড়াতাড়ি তাঁরা ভুলতে পারবেন, ততই মঙ্গল। ক্ষমতার দম্ভ মাথায় চড়ে বসলে (রাজারানির ভাষায় বললে, কুকুরকে লাই দিলে মাথায় চড়ে) বিপদ অবশ্যম্ভাবী। আর গণতন্ত্র শ্বাপদের হয়ে গেলে দেবালয় তো বটেই, ভোটে অর্জিত আসন, যা তাঁরা সিংহাসন ভাবছেন, তা-ও বাঁচে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy