১৮৫৮ সালের ২ সেপ্টেম্বর আমেরিকার ইলিনয়-এ প্রখ্যাত লিঙ্কন-ডগলাস বিতর্ক চলাকালীন আব্রাহাম লিঙ্কন বলেছিলেন, “কিছু সময়ের জন্য তুমি সবাইকে বোকা বানাতে পারো। কিছু লোককে সব সময়ের জন্য বোকা বানাতে পারো। কিন্তু সবাইকে সব সময়ের জন্য বোকা বানাতে পারো না।”
অতলান্তিক টপকে এটি প্রসিদ্ধ হয়ে যায় আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে ‘বিশ্বগুরু’র ভাবমূর্তি দেওয়ার যে প্রকল্প নিয়েছিল শাসক দল বিজেপি এবং কেন্দ্রীয় সরকার, তাতে লিঙ্কনের প্রবাদপ্রতিম বাক্যগুলি আবার ফিরে আসছে। ওই তৈরি করা ভাবমূর্তি কখনওই দীর্ঘমেয়াদি ভাবে টেকসই হতে যে পারে না, তা আজ স্পষ্ট। আমরা কে না জানি আন্তর্জাতিক সম্পর্কে বিশ্বগুরু বলে কিছু হয় না, সেটি নিছকই সোনার পাথরবাটি।
টেক্সাসে ‘অব কি বার ট্রাম্প সরকার’ স্লোগান এবং ‘হাউডি মোদী’র সেই অলীক নাট্যের বছর ছয়েক হতে চলল। অত দূর দরকার নেই, পাঠক, মাত্র এক বছর আগে ফিরে যাই বরং। পেনসিলভেনিয়ায় ট্রাম্পের সভায় বক্তৃতার সময় তাঁর কান ছুঁয়ে বেরিয়ে গেল আততায়ীর গুলি। সে দিনই সহমর্মিতার বন্যা বইয়ে গেরুয়া ব্রিগেডের উদিত সূর্য হিমন্তবিশ্ব শর্মা বিষয়টিকে উগ্র বামেদের নিশানা হিসাবে উল্লেখ করলেন দক্ষিণপন্থী নেতাদের উপর। ট্রাম্প এবং মোদীকে একাত্ম করে তাঁদের জাতীয়তাবাদী আদর্শের সমীকরণে দাঁড় করিয়েছিলেন অসমের মুখ্যমন্ত্রী। তিনি একলা নন, তখন বিজেপি নেতাদের সেটাই ছিল রাজনৈতিক ভাষ্য।
হিমন্তবিশ্ব শর্মার আন্তর্জাতিক বীক্ষা নিয়ে বেশি কথা বলার প্রয়োজন নেই, তিনি আসলে পোঁ ধরেছিলেন। কিন্তু সম্প্রতি সংসদের বাদল অধিবশনে ‘অপারেশন সিঁদুর’ নিয়ে আলোচনায় নিজের বায়োডেটা সগর্বে প্রচার করা বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর? গত নভেম্বরে কমলা হ্যারিসকে পরাস্ত করে ট্রাম্প আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ভোটে জেতার পর প্রথম প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেছিলেন, “আমি জানি অনেক দেশই আমেরিকাকে নিয়ে নার্ভাস হয়ে পড়েছে। এটাই বলার যে আমরা সেই তালিকায় পড়ি না।” মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে ছবিটা যে ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে যাবে, এমনটা বুঝতে পারেননি এই বিদগ্ধ কূটনীতিক। এ দিকে গত কয়েক মাসে ‘ফেলো কড়ি মাখো তেল’ নীতি নেওয়া মস্কো, (প্যালেস্টাইন এবং ইরানের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ভারতকে পাশে পাওয়ার পর) ইজ়রায়েল, সংযুক্ত আরব আমিরশাহি ছাড়া ভারতের শক্তিশালী বন্ধু রাষ্ট্র আর কে?
ভারতকে গত দেড়-দুই দশকে আন্তর্জাতিক ভাবে এতখানি একঘরে, বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে আর কখনও দেখা গিয়েছে কি? দুর্ভাগ্য, অপারেশন সিঁদুর-পরবর্তী পর্যায়ে যখন ভারতের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সঙ্ঘের, ঐক্যবদ্ধ জোটের, তখনই তাকে দেখাচ্ছে ‘নিবন্ত নির্জন’। মোদী সরকারের ‘দৃশ্য তৈরির রাজনীতি’ও আর তাকে ঢাকতে পারছে না। গত কয়েক বছরে বিদেশমন্ত্রীর বহুল প্রচারিত ভারসাম্যের রাজনীতির কৌশলও পারছে না। দুই নৌকায় পা দিতে গিয়ে (রাশিয়া ও ইউক্রেন, ইরান ও ইজ়রায়েল, ইজ়রায়েল ও প্যালেস্টাইন, আমেরিকা ও চিন, আওয়ামী লীগ ও বিএনপি) পা প্রোথিত হচ্ছে না কোনও নৌকাতেই। ভারত, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া এবং জাপানের চতুর্দেশীয় অক্ষ ‘কোয়াড’-এর শীর্ষ সম্মেলনটি কবে হবে তা অনিশ্চিত হয়ে রয়েছে। ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে ট্রাম্পের শান্তি দৌত্য আলাস্কায় অমীমাংসিত। তা কোন পথে এগোয়, তার উপরে নির্ভর করছে ভারতীয় পণ্যের শুল্ক পরিস্থিতি, অর্থনীতি, কূটনীতির ভবিষ্যৎ। আবার একই ভাবে চিনের সঙ্গে আমেরিকার বাণিজ্য-সম্পর্ক ও আসন্ন বৈঠক কোন ধাপে পৌঁছয় তার উপরেও ভারত-চিন সম্পর্ক নির্ভরশীল।
২০২০-র ডিসেম্বর থেকে ২০২৫ পর্যন্ত বেজিং তার ৪৭ শতাংশ অশোধিত তেল এবং ৪৪ শতাংশ কয়লা আমদানি করেছে রাশিয়া থেকে। হ্যাঁ, বাইডেন এবং ট্রাম্পের নিষেধাজ্ঞাকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়েই। অথচ এই সময়ের মধ্যে ভারতের মস্কো থেকে আমদানি এই দুই ক্ষেত্রে যথাক্রমে ৩৮ শতাংশ এবং ২০ শতাংশ। অথচ ২৫ শতাংশ বাড়তি জরিমানা ভারতের জন্য বরাদ্দ হলেও চিনের কেশাগ্র স্পর্শ করার সাহস হয়নি ডোনাল্ড ট্রাম্পের, তিনি পাকড়ালেন বিশ্বগুরুকেই।
চিন যে শুধুমাত্র এই শাস্তি এড়িয়ে গেল তা-ই নয়, মে মাস থেকে তাদের রফতানি করা পণ্যে শুল্ক বহুলাংশে কমিয়ে দিলেন ট্রাম্প। বেজিংয়ের সঙ্গে বাণিজ্য-সন্ধির সময়সীমা আরও তিন মাস বাড়ানো হল। অথচ ভারতের সঙ্গে আমেরিকার বাণিজ্য-চুক্তি এখনও অথৈ জলে। সহজ কথাটা সাউথ ব্লকের স্বীকার করে নেওয়াই ভাল। ট্রাম্পের হুঙ্কারে তালা লাগানোর মতো চাবি বেজিংয়ের কাছে রয়েছে, নয়া দিল্লির নেই। আমেরিকার অটো, বিবিধ উৎপাদন শিল্প, সেমিকন্ডাক্টর, এরোস্পেসের মতো শিল্পক্ষেত্রে হাহাকার পড়ে গিয়েছিল গত এপ্রিলের গোড়ায় যখন চিন তাদের দুর্লভ খনিজ, চুম্বকের মতো পণ্যে রফতানিতে তালা দেয়। পাশাপাশি আমেরিকার বিপুল পরিমাণ সয়াবিন, বিফ, পর্ক পোলট্রি পণ্যের আমদানি করে চিন। শি জিনপিং সেগুলিও কমিয়ে দিয়ে ‘ট্রাম্প কার্ড’ খেলেছিলেন তখন। নড়ে বসেছিল ট্রাম্প প্রশাসন।
ভারতের হাতে অনুরূপ এমন কী রয়েছে, যাতে হোয়াইট হাউসকে নাড়িয়ে দেওয়া যায়? ভারত থেকে রফতানি হওয়া একমাত্র ওষুধপত্র ছাড়া, গয়না, দামি পাথর, তৈরি পোশাক, বাসমতী চাল, এমনকি ইস্পাত ও অ্যালুমিনিয়ামেরও বিকল্প আমদানির সুযোগ রয়েছে ওয়াশিংটনের। চিন যে হারে আমেরিকার সয়াবিন কেনে তার ধারে কাছেও ক্যালিফোর্নিয়ার কাঠবাদাম কেনে না ভারত।
বেজিংয়ের সঙ্গে নয়া দিল্লির সম্পর্কে উন্নতির যে ভাষ্য আপাতত প্রচারিত হচ্ছে, তাতেও বহু ছিদ্র। চলতি মাসের শেষে তিয়ানজিন যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এসসিও সম্মেলনে যোগ দিতে। সেই সফরে সবচেয়ে বেশি কোন বিষয় বিজ্ঞাপিত হবে? না, দীর্ঘ দিন বন্ধ থাকার পর ভারত-চিন সরাসরি উড়ান চালু হওয়া! এ যেন এক মহাঠাট্টা! দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের অগ্রগতির তালিকায় যদি শীর্ষস্থানে (সম্ভবত একমাত্র) থাকে বন্ধ হওয়া উড়ান চালু হওয়া, তা হলে সেই সম্পর্কের দশা খুবই করুণ। এখনও প্রায় ১ লাখ লাল ফৌজ দাঁড়িয়ে রয়েছে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখায়, তার কী হবে? ভারত যেখানে টহলদারির অধিকার হারিয়েছে, তা কবে ফেরত আসবে? ডোকলাম সংঘাতের আগে ভারত-চিন সীমান্তে যে স্থিতাবস্থা ছিল, তা কবে ফিরবে? গত জানুয়ারি মাসে বিদেশসচিব বিক্রম মিস্রী বেজিং সফরে গিয়ে দু’দেশের মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া ব্রহ্মপুত্র (ইয়ার্লুং সাংপো) এবং শতদ্রু (লাংগেন সাংপো)-র জল সংক্রান্ত তথ্য নিয়ে দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মেকানিজ়ম চালু করার জন্য আবেদন করেছিলেন, উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন, ইয়ার্লুং সাংপোতে বেজিংয়ের তৈরি করা বড় মাপের জলবিদ্যুৎ প্রকল্প নিয়ে। ভারতের আশঙ্কা, ওই প্রকল্পের কারণে ভারতে প্রবাহিত জলের পরিমাণ কমবে। এ সবের কোনও কিছুই মোদীর আসন্ন চিন সফরে পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না।
প্রতিবেশী বলয় তথৈবচ। বাংলাদেশের পরিস্থিতি আলাদা করে বলার অপেক্ষা রাখে না, সম্পর্কের ‘সোনালি অধ্যায়’ থেকে ছাই উড়ছে প্রতি দিন। সার্ক বন্ধ করে রাখার পর চিনের পক্ষে সহজতর হয়ে উঠছে নেপালকে সঙ্গে নেওয়া। বাংলাদেশ, পাকিস্তানকে সঙ্গে নিয়ে চিন যে সমান্তরাল সার্ক তৈরির হুমকি দিচ্ছে, সহজ হবে না তার মোকাবিলা করা। আফগানিস্তানে তালিবানের সঙ্গে দীর্ঘ দিন ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’ গোছের সম্পর্কের পর, নৈতিকতা শিকেয় তুলে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়েছিল সাউথ ব্লক। উদ্দেশ্য চাবাহার বন্দরকে জাগিয়ে তোলা, পাকিস্তানের সঙ্গে আফগানিস্তানের সাম্প্রতিক বৈরিতার ফাটলে নিজেদের চারাগাছ রোপণ করা। এখন সেই মাটিতেও বালি ঢেলে দিয়েছে চিন। পাক বিদেশমন্ত্রী ইশাক দার ও কাবুলের ভারপ্রাপ্ত বিদেশমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকিকে নিজের দেশে ডেকে বৈঠক করিয়ে, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানকে মিটমাট করানোর জন্য উদ্যোগ করে চিনা বিদেশমন্ত্রী ওয়াং ই এখন সফল।
মায়ানমারে নির্বাচন আসন্ন। সেখানে আরাকান আর্মি-সহ বেশ কিছু বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সংঘাত, জুন্টা সরকারে চিনের প্রভাব— সব মিলিয়ে পরিস্থিতি জটিল। প্রতিবেশী বলয়ে রইল বাকি শ্রীলঙ্কা এবং মলদ্বীপ। বিপুল অর্থ পেয়ে তারা আপাতত ভারতের সুরে সুর মেলাচ্ছে। কিন্তু বড় কোনও হোম বা যজ্ঞে তারা কোনও কাজে লাগবে কি?
লাল কেল্লা থেকে বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন ‘অর্থনৈতিক স্বার্থপরতা’ বাড়ছে বিভিন্ন রাষ্ট্রে। কূটনীতিতে নিজ স্বার্থ বিনা গীত নেই, কোনও দিনই ছিল না। অনেক ঠেকে সাউথ ব্লক তা শিখছে।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)