তিস্তাপারে যাঁদের ভিটেবসত, বছরে অন্তত এক বার বন্যার জলে সংসার ভেসে যাওয়া তাঁদের কাছে অনিবার্য। কোনও বছর বড় বন্যা হয়, কোনও বছর ছোট। ছোট বন্যা বেশি নেয় না, কিন্তু বড় বন্যা নেয় অনেক বেশি। সেই বন্যার জল নেমে গেলে আবার নতুন করে শুরু করতে হয় সংসার। এ ভাবেই জীবনটা অভ্যাস করে নিয়েছেন তিস্তাপারের বহু মানুষ। এ ভাবেই তিস্তাপারের বহু মানুষকে জীবন অভ্যাস করতে বাধ্য করা হয়েছে।
কারা বাধ্য করল এমন জীবন অভ্যাস করাতে? কেন? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে উত্তরবঙ্গবাসী কতটা পিছনে ছুটবেন— স্বাধীনতা-উত্তর কালের সূচনালগ্নে, বামফ্রন্টের চৌত্রিশ বছরে, না কি ‘পরিবর্তন’-এর জমানার শুরু থেকে এখনও পর্যন্ত সময়ে? উত্তরবঙ্গ বন্যা এবং ম্যালেরিয়া প্রবণ, সে কথা পাঠ্যবইয়েও লেখা আছে। স্বাস্থ্যবিজ্ঞানের উন্নতির নিয়মে ম্যালেরিয়ার সংক্রমণ কমানো গিয়েছে। কিন্তু বন্যাপ্রবণ জেনেও উত্তরবঙ্গের জন্য স্বাধীনতার এতগুলো বছর পরে কোনও দাওয়াইয়ের কথা ভাবা হল না কেন?
২০২৩ সালে সিকিমের লোনাক হ্রদ ভেঙে তিস্তায় বিপর্যয় হল। জলের তোড়ে পাহাড় ভাঙল, সমতল ভেসে গেল। সেনাবাহিনীর ছাউনিও ভাসল। সেই বিপর্যয়ের পরে সেচ দফতর, কেন্দ্রীয় আবহাওয়া দফতর, কেন্দ্রীয় জল আয়োগ, সকলে নেমে পড়ল তিস্তা নিয়ে সমীক্ষা করতে। সব দফতরের সমীক্ষাই জানাল, তিস্তার নদীখাত পলি জমে অনেকটাই উঁচু হয়ে গিয়েছে। যার ফলে নদীতে জলবহন ক্ষমতাও কমে গিয়েছে অনেকটাই। যার ফলে এর পর কোনও মাঝারি বিপর্যয় হলেও ক্ষতির পরিমাণ কয়েক গুণ বেশি হবে।
হয়েছেও তা-ই। এ বছর লক্ষ্মীপুজোর আগের দিনের বন্যা তো সিকিম থেকে নামেনি। শুধু পাহাড়-সমতলে ভারী বৃষ্টি হয়েছিল। তার ফলে এক দিন গজলডোবা ব্যারাজ থেকে বেশি পরিমাণ জল ছাড়া হয়েছিল। তাতেই তিস্তা উপচে ভাসিয়ে দিল হাজার হাজার পরিবার। কারণ বলা ছিল দু’বছর আগের সমীক্ষা রিপোর্টেই— নদীতে পলি জমে জলধারণ ক্ষমতা কমেছে। সমীক্ষার পরে তিস্তায় ড্রেজিং অর্থাৎ নদীর বুকে জমা মাটি সরানোর পরিকল্পনা হয়। প্রায় ছ’শো কোটি টাকা খরচ ধরা হয়। আবার এমনও পরিকল্পনা হয় যে, নদী থেকে পলি তুলে নেবে বিভিন্ন সংস্থা, সরকারের কোনও খরচ হবে না। শুধু তিস্তা নয়, মহানন্দা, জলঢাকা, তোর্সা, রায়ডাক, ডায়না-সহ উত্তরবঙ্গের পাহাড় থেকে নেমে আসা সব বড় এবং মাঝারি নদীর বুক পলি জমে জমে ভরাট হয়েছে, সে কথা দশক দশক ধরে সরকারি রিপোর্টে উল্লেখ হয়েছে। তিস্তার সঙ্গে এই নদীদেরও ড্রেজিং করার তালিকায় নাম রাখা হয়। তার পরেও সেই কাজ এগোয়নি। অর্থাৎ সমস্যা জানা, সমাধানের উপায়ও কষে রাখা, কিন্তু কাজ হয়নি।
গত শতকের ষাটের দশকের শেষ এবং সত্তরের দশকের শুরুতে উত্তরবঙ্গের জন্য একটি প্রকল্প পরিকল্পনা হয়— তিস্তা সেচ প্রকল্প। তিস্তা নদী থেকে খাল কেটে চাষের জমিতে সেচের জল দেওয়া অতি প্রাথমিক উদ্দেশ্য হলেও প্রকল্পের মূল লক্ষ্য ছিল নদী সংযুক্তকরণ। খালের মাধ্যমে উত্তরবঙ্গের প্রধান নদীগুলি অর্থাৎ তিস্তা থেকে আত্রেয়ী যুক্ত করা হবে। যার ফলে এক দিকে যেমন গোটা উত্তরবঙ্গের কৃষিজমি সেচের জল পাবে, তেমনই উত্তরবঙ্গের বন্যার সমস্যা চিরতরে সমাধান হবে। প্রকল্প শুরু হল। প্রকল্পটিকে তিনটি পর্যায়ে ভাগ করা হয়েছিল। এক-একটি পর্যায় তিনটি উপপর্যায়ে ভাগ করা হল। প্রতিটি উপপর্যায় আবার তিনটি করে উপভাগে বিভক্ত। দীর্ঘ অপেক্ষা, রাজ্য-কেন্দ্রের টানাটানির পরে প্রকল্প তামাদি ঘোষণা হয়েছে। বন্যাও ভরপুর চলছে।
এ বার শুধু বন্যা হয়নি। পাহাড়ে ধসও নেমেছে। প্রবল বৃষ্টিতে পাহাড় ধসে লন্ডভন্ড করে দিয়েছে মিরিকের ছোট একটা গ্রাম তাবাকোশি। সুখিয়াপোখরি, বিজনবাড়ির জনপদ বিপর্যস্ত। সেতু ভেঙেছে, বড় বড় গাড়ি পাথরের ধাক্কায় খাদে পড়েছে। বহু প্রাণ কেড়েছে ধস। যে ভাবে পাহাড় কেটে অনিয়ন্ত্রিত ভাবে বাড়ি তৈরি হয়েছে, ঝোরা বোজানো হয়েছে, নদীর মুখ জোর করে ঘুরিয়ে দেওয়া হয়েছে, তাতে এমন বিপর্যয় হওয়ারই ছিল, বলছেন পরিবেশবিদরা। প্রতিটি বিপর্যয়ের পরেই উচ্চারিত হয় কথাগুলি, শুধু ক্ষমতার কেন্দ্রে তা পৌঁছয় না।
কেউ প্রশ্ন করতে পারেন, উত্তরবঙ্গে ঘটে যাওয়া এই বিপর্যয় যদি ঘটত রাজ্যের অন্য প্রান্তে— রাজধানী কলকাতা বা তার সংলগ্ন এলাকায়? তখনও কি এমনই নির্বিকার থাকত প্রশাসন? বছরের পর বছর বিপর্যয়ের অনিবার্যতা বয়ে যেতে হত সেই অঞ্চলকে? না কি, বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য আরও সুসংহত পরিকল্পনা হত এবং তা বাস্তবায়িত হত? সমীক্ষার পরে সব নদীখাত থেকে পলি তোলা হত? পাহাড় কাটায় এবং পাহাড়ে নির্মাণে, ঝোরা দখলে কঠিন শাস্তি হত?
প্রশ্নগুলো সহজ, আর উত্তরও তো জানা।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)