E-Paper

অনুসরণ নয়, প্রেরণা

স্বরাজের রূপায়ণের জন্য গান্ধী প্রাথমিক ভাবে চেয়েছিলেন ব্যক্তিক স্তরে জীবনযাপনে স্বনির্ভরতা। তবে যে-হেতু মানবসমাজে পারস্পরিক নির্ভরতা অপরিহার্য, তাঁর প্রস্তাব ছিল এক বা একাধিক গ্রাম নিয়ে স্বেচ্ছায় সংগঠিত সমবায়মূলক ব্যবস্থা।

অনুরাধা রায়

শেষ আপডেট: ০৬ অক্টোবর ২০২৫ ০৬:১৯
সমাজকর্ম: শ্রীনিকেতনে গ্রামোন্নয়নমূলক কাজকর্ম পর্যবেক্ষণে মহাত্মা গান্ধী। ফেব্রুয়ারি, ১৯৪০

সমাজকর্ম: শ্রীনিকেতনে গ্রামোন্নয়নমূলক কাজকর্ম পর্যবেক্ষণে মহাত্মা গান্ধী। ফেব্রুয়ারি, ১৯৪০

কমিউনিস্ট রাজনীতির সমান্তরাল অন্য এক বামপন্থা বাংলায় বরাবরই লালিত হয়েছে। বহু উত্তেজক আন্দোলন, তার পর তিন দশকের উপর ক্ষমতাভোগের বিপ্রতীপে নিভৃত নীরব সেই বামপন্থা বিস্মৃতপ্রায়। তবু আজ কমিউনিস্ট বামপন্থা যখন সম্পূর্ণ ধ্বস্ত, গান্ধীয় গ্রাম পুনর্গঠনের সেই বিকল্প বামপন্থা নিয়ে একটু চিন্তাভাবনা করা যেতে পারে। গ্রামপ্রধান দেশে গ্রামকে পার্থিব ও মানসিক ভাবে সক্ষম স্বচ্ছন্দ করে তোলার বেশ কিছু উদ্যোগ অবশ্য গান্ধীর আগেই হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথের প্রয়াস সুবিদিত।

অনেকটা রবীন্দ্রনাথের ‘আত্মশক্তি’রই সদৃশ গান্ধীর ‘স্বরাজ’, যার অর্থ প্রতিটি ব্যক্তির নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ— যে কোনও কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা, বিশেষত রাষ্ট্র, আরও বিশেষ করে ব্রিটিশ রাজের মতো দমনমূলক রাষ্ট্র, যে আদর্শের প্রতিকূল। স্বরাজের রূপায়ণের জন্য গান্ধী প্রাথমিক ভাবে চেয়েছিলেন ব্যক্তিক স্তরে জীবনযাপনে স্বনির্ভরতা। তবে যে-হেতু মানবসমাজে পারস্পরিক নির্ভরতা অপরিহার্য, তাঁর প্রস্তাব ছিল এক বা একাধিক গ্রাম নিয়ে স্বেচ্ছায় সংগঠিত সমবায়মূলক ব্যবস্থা। সহযোগিতার পথে মানসিক বিকাশের এবং ধর্মীয় বা জাতিভেদের মতো সমস্যাগুলি দূরীকরণেরও প্রত্যাশা ছিল।

স্বাধীনতার পূর্ব-মুহূর্তে গান্ধী কংগ্রেস ভেঙে দিয়ে দলীয় কর্মীদের গ্রামে গিয়ে কাজ করতে বলেছিলেন। স্বাধীন ভারতকে দেখতে চেয়েছিলেন লক্ষ লক্ষ গ্রামের এক ‘মহাসামুদ্রিক বৃত্ত’ হিসেবে, যার কেন্দ্র হবে ব্যক্তি, যে ব্যক্তি গ্রামের জন্য নিবেদিত, যে গ্রাম আবার গ্রামসমষ্টির জন্য নিবেদিত। ক্ষমতার দুর্বার হাতছানিতে কংগ্রেস অবশ্য গান্ধীকে ব্যর্থ নমস্কারে ফিরিয়ে দেয়। তবু স্বাধীনতার পরেও বাংলায় ইতস্তত গান্ধীয় আদর্শের অনুশীলন হতে থাকে পান্নালাল দাশগুপ্তের মতো গান্ধীবাদী সমাজকর্মীদের সক্রিয়তায়, বিনোবা ভাবের ভূদান আন্দোলনেও। তবে শেষ পর্যন্ত এখানে কমিউনিস্ট আধিপত্যই প্রতিষ্ঠিত হল, শাসনক্ষমতা তাতে সাহায্য করল।

গান্ধীবাদ ও কমিউনিজ়ম— দু’টি দু’রকমের সমাজবাদ। মূলগত ভাবে সাম্য ও ন্যায়ের আকাঙ্ক্ষায় মিল থাকলেও (কংগ্রেসি অনুগামীদের থেকে কমিউনিস্টদের সঙ্গেই গান্ধীর আদর্শগত মিল বেশি), পদ্ধতি এবং সমাজকল্পনার দিক থেকে দুইয়ের পার্থক্যটাই বড় হয়ে রইল। হিংসা/অহিংসা অথবা শ্রেণিসংঘাত/শ্রেণিসমন্বয়ের থেকেও বড় পার্থক্য— কমিউনিজ়মের ঝোঁক রাজনীতিতে, গান্ধীবাদের সমাজকর্মে। এটা ঠিকই, অনেক কমিউনিস্ট নিষ্ঠাভরে চাষিমজুরদের মধ্যে সমাজকর্ম করেছেন। অন্য দিকে, জাতীয় রাজনীতিতে গান্ধীর সর্বাধিনায়কত্ব তাঁর সমাজকর্মের দিকটি জনমানসে গৌণ করে তুলেছে। তবু আদর্শের স্তরে ঝোঁকের পার্থক্যটা গুরুত্বপূর্ণ। সমাজমানস তথা ব্যক্তিমানসের পরিবর্তন কমিউনিস্টদের কাছে তুচ্ছ (বিশেষত বাংলায় তাঁরা যে-হেতু মার্ক্সবাদের এক সঙ্কীর্ণ ও যান্ত্রিক ভাষ্যে বিশ্বাসী); গান্ধীবাদের কিন্তু সেটাই প্রাণ। কমিউনিস্টরা ভাবেন, উপর থেকে একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা তৈরি হয়ে গেলেই সমাজকাঠামো বদলে যাবে। বস্তুত সমাজের থেকে অর্থনীতি নিয়েই তাঁরা বেশি চিন্তিত। সমতামূলক অর্থনীতির লক্ষ্যে তাঁরা চান কমিউনিস্ট রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা; অর্থাৎ এক ধরনের কেন্দ্রীভূত ক্ষমতার বদলে আর এক ধরনের কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা। গান্ধী কিন্তু রবীন্দ্রনাথের মতোই রাষ্ট্র নিয়ে সন্দিহান।

আদর্শের বাস্তবিক প্রয়োগ ধরলে, বাম শাসনের গোড়ার দিকে ভূমিসংস্কার এবং পঞ্চায়েতের আওতায় গণতান্ত্রিক বিকেন্দ্রীকরণ কিছুটা হয়েছিল বটে, কিন্তু সমাজে শ্রেণি ও জাতির বিভাজন অটুট থাকল। কমিউনিস্টদের নিজেদেরই ‘বিশ্রেণিকরণ’ হল না। পঞ্চায়েতের মাধ্যমে গ্রামসমাজে সরকারের প্রবল হস্তক্ষেপের ফলে গ্রামের ‘সরকারিকরণ’ হল, কিন্তু সরকারের ‘গ্রামায়ণ’ হল না। শহুরে নেতারা সরকারি প্রযুক্তি ব্যবহার করে গ্রামের মানুষদের নিয়ন্ত্রণ করতে লাগলেন। বিশেষত পঞ্চায়েত যখন আইআরডিপি ও অন্যান্য সরকারি প্রকল্পের আওতায় সাধারণ মানুষের মধ্যে অর্থ বিতরণ শুরু করল, সেটা শাসক-শাসিতের এমন একটা লেনদেনের সম্পর্ক তৈরি করল যার রন্ধ্রে রন্ধ্রে স্বজনপোষণ ও দুর্নীতি। ক্ষমতার বিশাল কাঠামো তৈরি হয়ে উঠে নির্বাচনী সাফল্য অবশ্য সুনিশ্চিত হল। ক্রমে দুর্নীতি রীতিমতো লুটপাটের চেহারা নিল। এর বিপরীতে গান্ধীয় সমাজকর্মের পদ্ধতি ছিল গ্রামস্তরেই সমবায়ের ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় সম্পদের উৎপাদন, সরল সৎ সুচারু জীবনের লক্ষ্যে।

কিন্তু গান্ধীয় পন্থাটিও মোটেই মসৃণ নয়। রবীন্দ্রনাথ বা গান্ধীর গ্রাম পুনর্গঠন নিয়ে নির্বিচারে আপ্লুত না হয়ে, তাঁদের প্রকল্পগুলি যে সব প্রায়োগিক সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে, সেগুলি আমাদের বিবেচ্য হওয়া উচিত। বিরাট সমস্যা সমাজের দৃঢ়মূল বিভাজন ও সাংস্কৃতিক ধ্যানধারণাগুলি। রবীন্দ্রনাথের গ্রামগঠন প্রকল্পে কাজ করতে গিয়ে কালীমোহন ঘোষদের বড় বাধা হয়ে উঠেছিল গ্রামে ধর্মীয়, জাতভিত্তিক ও ধনী-দরিদ্রের দ্বন্দ্ব (সাঁওতাল গ্রামগুলি ব্যতিক্রম)। গান্ধীর ‘হৃদয় পরিবর্তন’-এর আশাও ছলনাময়ী। দেশভাগের অব্যবহিত পরে সীমান্তবর্তী গ্রামে হিন্দু-মুসলমানের মিলনপ্রচেষ্টায় রত বিজয়লাল চট্টোপাধ্যায়ের বিলাপোক্তি— আমরা গঠনকর্মীরা ‘ফুটা পাত্রে জল ঢালছি’। ক্রমে গঠনকর্মেও অর্থ আর স্বেচ্ছাসেবকের অভাব হল। ঘরের খেয়ে বনের মোষ ক’জন তাড়াবে? চার পাশের স্বার্থপর, ক্ষমতালোভী ও ভোগবাদী সমাজ-সংস্কৃতি এবং মাথার উপর রাষ্ট্রের চাপ উপেক্ষা করা কঠিন— সাধারণ মানুষ ও গঠনকর্মী উভয়ের পক্ষেই।

ব্যক্তির মর্যাদা ও স্বয়ংক্রিয়তাকে সমষ্টির সঙ্গে সুসঙ্গত ভাবাও নানাবিধ স্বার্থে দীর্ণ পল্লিসমাজের প্রেক্ষিতে নিতান্ত অবাস্তব মনে হয়। অবশ্য সমাধান হিসেবে রবীন্দ্রনাথের ‘ছোট আমি’ থেকে ‘বড় আমি’তে উত্তরণের প্রস্তাব স্মরণীয়। গান্ধীও ব্যক্তি ও সমাজ দুটোকেই বদলে নিতে চেয়েছিলেন, মানবিকতা ও পারস্পরিকতা নিশ্চিত করার জন্য। ১৯৪৫-এ নেহরুকে লিখেছিলেন, ‘আমার আদর্শ গ্রাম আছে আমার কল্পনাতে’। কিন্তু এই প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ও গান্ধীর মতপার্থক্যও প্রণিধানযোগ্য। নৈতিক উদ্দেশ্য অনেকটা এক হলেও ব্যক্তিস্বাধীনতার মূল্যবোধে দৃঢ়বিশ্বাসী রবীন্দ্রনাথ গান্ধীয় আদর্শে ব্যষ্টির উপর সমষ্টির কর্তৃত্ব বিস্তারের অন্তর্লীন প্রবণতা পছন্দ করেননি।

একেবারে তত্ত্বকাঠামোর মধ্যেই সমস্যা। গান্ধীর ‘মহাসামুদ্রিক বৃত্ত’সদৃশ দেশকল্পনার সঙ্গে ‘রাষ্ট্র’ ধারণাটির অসঙ্গতি। রাষ্ট্র নিয়ে সংশয়ী হয়েও গান্ধী কিন্তু তাকে বাদ দিতে পারেননি, জাতিরাষ্ট্রের মুক্তির জন্যই লড়াই করেছেন, সে জন্যই তো তাঁর ‘জাতির জনক’ অভিধা। ক্রমে গান্ধীয় প্রকল্পগুলি রাষ্ট্রীয় সাহায্যের উপর খুবই নির্ভরশীল হয়ে পড়ল। ভূদানও তলার দিকে অন্তরের আন্দোলন নয়, উপর থেকে চালিত একটা আমলাতান্ত্রিক ব্যাপার হয়ে গেল। আদতে কংগ্রেসের সঙ্গে সম্পর্কিত গান্ধীবাদীরা খুব কম ক্ষেত্রেই কংগ্রেসি জমানার অসংবেদনা ও দুর্নীতির বিরোধিতা করতে পেরেছিলেন। মোটের উপর তাঁরা রাজনীতি পরিহার করে ‘কোয়ায়েটিজ়ম’-এরই আশ্রয় নেন (ডেভিড হার্ডিম্যান-এর ভাষায়)। সর্বশক্তিমান পুঁজিবাদের জোরালো মোকাবিলা করার মতো তাত্ত্বিক ভিত্তি এবং যথোচিত উদ্যোগই বা তৈরি হল কোথায়! যেটুকু তৈরি হয়, পুঁজিবাদ ও রাষ্ট্র স্বভাবতই তাকে নিজেদের স্বার্থে আত্মসাৎ করে নিতে চায়।

তবু মনে হয়, স্থানীয় স্তরে সমবায়িক সমাজ ব্যবস্থাপনার আদর্শটা পুরোপুরি নাকচ করার মতো নয়। বিজ্ঞানও তো আজ বলছে, পারস্পরিকতা-ভিত্তিক জীবনকুশলতা ছোট ছোট গোষ্ঠীতেই (ন্যূনাধিক ১৫০, ‘ডানবার নাম্বার’) সর্বাধিক প্রত্যাশিত। ইউরোপের ইতিহাসে ‘কমন’-এর ধারণাও অনুরূপ, যা নিয়ে বিদ্যায়তনিক স্তরে অনেক আলোচনা হচ্ছে, ২০০৯ সালে এলিনর অস্ট্রম অর্থনীতিতে নোবেলও পেয়েছেন। ‘কমন’ কি একটি সামাজিক উৎপাদন ব্যবস্থা, না কি রাজনৈতিক আদর্শ— তর্ক চলছে। যে-হেতু রাষ্ট্র ও ধনতন্ত্রের বিকল্প হিসেবে ‘কমন’-এর ইঙ্গিত মার্ক্সের মধ্যেও ছিল (শেষ পর্যন্ত তো রাজনৈতিক নয়, সমাজ-বিপ্লবই চেয়েছিলেন তিনি), কেউ কেউ মার্ক্স থেকে প্রেরণা নিয়ে দু’টি ধারণা মিলিয়ে ‘কমন’কে বুঝতে চাইছেন। বলছেন, রাজনীতি করতে করতেই সমাজ বদলাবে (অগভীর নির্বাচনী রাজনীতি নয়, র‌্যাডিক্যাল রাজনীতি), আবার সমাজ বদলাতে বদলাতে আসবে রাজনীতির সাফল্য। দু’টিই ধারাবাহিক প্রক্রিয়া, যাদের সুসমন্বয় মানবসত্তা ও মানবসভ্যতাকে নতুন করে সংজ্ঞায়িত করবে। ভারতে এই উদ্দেশ্য সাধনে মার্ক্স ও গান্ধীর সম্মিলিত প্রেরণা কার্যকর হতে পারে।

১৯২৭ সালে ব্রিটিশ কমিউনিস্ট নেতা সাকলাতওয়ালা ভারতে এলে, গান্ধী তাঁকে ‘কমরেড’ সম্বোধন করে আশা প্রকাশ করেছিলেন, তাঁদের দু’জনের আপাত-বিপরীত পথ দু’টি এক দিন মিলে যাবে। আশা পূর্ণ হয়নি। কোনও দিন হবে কি? হতে গেলে কিন্তু মার্ক্স ও গান্ধীকে প্রেরণা হিসেবেই নিতে হবে, অন্ধ অনুসরণ চলবে না। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নিজেদের চিন্তা নিজেদেরই করতে হবে, বাস্তবানুগতা ও নমনীয়তার সঙ্গে।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Left Congress

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy