ধুলিয়ান জ্বলছে। ধুলিয়ান মুর্শিদাবাদে। মুর্শিদাবাদ মানে মুসলমান। অতএব পশ্চিমবঙ্গে “হিন্দু খতরে মেঁ”। সমীকরণ সরল। কিন্তু কেউ কেউ থাকেন যাঁরা, সমীকরণের অঙ্কগুলো মিলিয়ে নিতেচান। দিল্লি আইআইটি-র অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক বিপিন কুমার ত্রিপাঠী, বিশিষ্ট সাংবাদিক ও লেখিকা মণিমালা সেই দলেই পড়েন। ওয়াকফ আইন সংশোধন-পরবর্তী ধুলিয়ানে যে হিংসা, প্রাণহানি ও লুটতরাজ ঘটেছে, সেটা অ-মুসলমানদের জন্য ঠিক কতখানি বিপজ্জনক, সেটা বোঝার জন্য তাঁরা ধুলিয়ান যেতে চান। সঙ্গী হয়ে পড়লাম, সঙ্গী হলেন আরও দুই শিক্ষক, মে মাসের গোড়ায়।
আজিমগঞ্জ থেকে শমসেরগঞ্জ পৌঁছনোর পথে সর্বত্র জনজীবন স্বাভাবিক। যেখানে ঘটনা ঘটেছে সেই অঞ্চলেও তিন সপ্তাহে জীবন স্বাভাবিক ছন্দে ফিরে এসেছে। সব জায়গায় দৈনন্দিন জীবনের স্বাভাবিক চঞ্চলতা। ঘটনার ভরকেন্দ্র ঘোষপাড়া শিবমন্দির এলাকা। সেখানে হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের লোকেরা যে যাঁর কাজ করছেন। সামনে একটি শপিং মল, ভাঙচুর হওয়ার পর সেটি এখন বন্ধ, জানা গেল মালিক মুসলমান। চায়ের দোকানে কথা বলতে বলতেই লোকেরা আমাদের নিয়ে গেলেন তাঁদের ঘর, দোকান দেখাতে। ঘোষপাড়ার হিন্দুদের দোকানগুলির বেশির ভাগেরই সাইনবোর্ড ভাঙা। দরজা ভেঙে ভিতরের জিনিসপত্র লুট করা হয়েছে। কিছু কিছু মেরামত হয়েছে। অনেকেই পারেননি। ক্ষতিপূরণের আশায় আছেন, কিন্তু আশার উপর ভরসা পাচ্ছেন না।
ঠিক কী ঘটেছিল? এপ্রিলের ১১ তারিখ শুক্রবার নমাজের পর ওয়াকফ সংশোধনী বিলের বিরুদ্ধে একটি প্রতিবাদ মিছিলের কথা হয়। তাতে যোগদানের জন্য ঘোষপাড়ার উপর দিয়ে একটি মিছিল যাচ্ছিল, যাতে ইট পাথর ছোড়া হয়েছে বলে অভিযোগ। এর পরে মিছিলের একটি অংশ নির্বিচারে লুটপাট ও ভাঙচুর চালাতে শুরু করে। যারা করছিল তারা নেহাতই নাবালক, বয়স ১০ থেকে ১৪-র মধ্যে। এদের একটি অংশ পরিযায়ী শ্রমিক। স্কুলে নাম লেখানো থাকলেও এরা একটা বড় সময় পশ্চিমবঙ্গের বাইরে অন্য কোনও রাজ্যে কাজ করতে চলে যায়। স্থানীয় এলাকার সঙ্গে এদের কোনও যোগাযোগ নেই। মাঝে মাঝে বাড়ি ফেরে এবং নানান ভাবে নিজেদের ‘হিরো’ করে তোলার চেষ্টা করে। বহিরাগতের প্রসঙ্গও এসেছে বিশেষ করে লাগোয়া ঝাড়খণ্ড থেকে। অন্য দিকে, হিন্দুদের তরফেও প্রতি আক্রমণ শুরু হয় এবং ১১ এপ্রিল রাত থেকে পর দিন সকাল পর্যন্ত ভাঙচুর চলে। এই দীর্ঘ সময় ধরে কয়েক মিনিট দূরত্বের থানা থেকে কোনও রকম সাহায্য আসেনি।
থানা ৩০০ মিটার দূরে। চার ঘণ্টার উপর হাঙ্গামা চলে। কোনও রকম প্রশাসনিক ব্যবস্থা কেন করা হয়নি, প্রশাসনের সর্বোচ্চ ব্যক্তিটিকে ফোন করেও কেন কোনও উপায় হয়নি, গোটা এলাকা জুড়ে এটাই প্রশ্ন। এই দেশে দাঙ্গার সময় পুলিশের এই অদ্ভুত নিষ্ক্রিয়তার বিষয়টি নিয়ে আজ পর্যন্ত কোনও তদন্ত হয়েছে কি না জানা নেই। স্বাধীনতা-উত্তর ভারতে বড় বড় যে সাম্প্রদায়িক তাণ্ডব হয়েছে, ভাগলপুর, গুজরাত, মুজ়ফ্ফরনগর— সব জায়গাতেই একই ছবি। এর আগে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জায়গায় অন্যান্য ধর্মীয় অনুষঙ্গে উত্তেজনা বৃদ্ধির ঘটনা ঘটলেই কিন্তু প্রশাসন উদ্যোগ নিয়ে তা সমূলে বিনষ্ট করেছে। এখানে এমনটা ঘটল কেন? ঘোষপাড়া শিবমন্দির এলাকা ধরে এগিয়ে গেলে দেখা যাচ্ছে, দুই সম্প্রদায়ই ক্ষতিগ্রস্ত, যদিও হিন্দুর ক্ষতির কথাই সংবাদে প্রচারিত। একতরফা খবর হওয়ার কারণে মুর্শিদাবাদ হয়ে গিয়েছে পাকিস্তান!
এই অঞ্চলে হিন্দু-মুসলমান পরস্পরের সঙ্গে এতটাই মিলে আছে যে, একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন করা কঠিন। যেমন, একটি আক্রান্ত বাড়ির কর্তা বলছিলেন, ঘটনার দিন স্কুলফেরত পাঁচ জন ছাত্রী এই ঝামেলার মধ্যে পড়লে তিনি তাদের নিজের ঘরে আশ্রয় দেন। সন্ধ্যা পর্যন্ত তাদের বাড়ির লোকদের ডেকে এনে তাঁদের সঙ্গে মেয়েদের বাড়ি পাঠান। বাড়িটি হিন্দু বাড়ি, মেয়েগুলি মুসলমান। এর পরেও তাঁদের বাড়ি আক্রান্ত হয়েছে। যেমন হয়েছে, একটু এগিয়ে সংহতি উদ্যানের কাছে হুমায়ুন মোমিনের তিন তলা জনপ্রিয় মিষ্টির দোকান। পর পর দু’দিন আক্রমণে ভাঙচুরের পাশাপাশি দামি যন্ত্রপাতি লুট হয়েছে। দোকানে হিন্দু-কর্মচারী যেমন যথেষ্ট আছে, তেমনই হিন্দুরাই প্রধান ক্রেতা। ক’দিন পরেই নববর্ষের হালখাতার জন্য বিভিন্ন অর্ডারের কারণে প্রচুর মিষ্টি এবং অন্যান্য জিনিস দোকানে মজুত ছিল। সাত-আট লক্ষ টাকার ক্ষতি হয়েছে তাঁর। হুমায়ুন এক আশ্চর্য মানুষ, এই উন্মাদনার মধ্যে এক ব্যতিক্রমী সম্প্রীতির আলো। গোটা এলাকার বেদনাকে ধারণ করে রেখেছেন। বার বার বলছেন যত ক্ষমা করা যায় তত তাড়াতাড়ি ভোলা যায়।
ঘোষপাড়ায় এক দিকে যেমন হিন্দুদের ঘরবাড়ি দোকান ক্ষতিগ্রস্ত, একটু দূরে শিবমন্দির আনাজ বাজার ও মাছ বাজারে মুসলমানদের বিরাট ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। হিন্দুদের বিপন্নতা প্রমাণের চাপে সে খবর হারিয়ে যায়। ঘটনার পর ব্যাপক ভাবে মুসলমান ছেলেদের ধরপাকড় চলছে, মৌলবাদী, জঙ্গি ইত্যাদি বিশেষণে অভিযুক্ত করা হচ্ছে। বিভেদ বেড়েই চলেছে, ভাঙা মন জোড়ার চেষ্টা নেই। অভিযোগ, বিএসএফ-এর পোশাকে মুখোশধারীরা মুসলিমদের ভয় দেখিয়েছে, লুটে সাহায্যও করেছে।
ওই দিন শুক্রবারেই সাজুর মোড়ে ১২ নম্বর জাতীয় সড়কে অবরোধ করা হয়। এই অবরোধের সময় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়। অভিযোগ, অল্পবয়সি ছেলে ইজাজ আহমেদ গুলিতে মারা যায়, আরও এক জন গুলিবিদ্ধ। ইজাজ আহমদের বাড়িতে শোকসন্তপ্ত পরিবার কারও সঙ্গে দেখা করতে চাননি। ঘটনার পরবর্তী রাজনৈতিক মেরুকরণের উত্তাপে কেউ এ বিষয় নিয়ে কথা বলতে চাইছেন না।
মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছে জাফরাবাদে। ধর্ম পরিচয়ে হিন্দু বাবা ও ছেলের হত্যা। ওই বাড়িটিকে ঘিরে সে দিন এক ধরনের উত্তেজনা চলছিল। আমরাও কিছু জিজ্ঞাসাবাদের সামনে পড়লাম। বাড়ির বাসিন্দারা তখন কলকাতায়। হেঁটে হেঁটেই খানিকটা দেখা হল। এই অঞ্চলে মুখ্য ভূমিকায় এখন বিএসএফ। টহলদারি চলছে। ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হতে থাকা এলাকায় বিএসএফ-এর টহলদারি অন্য রকম বার্তা দেয়। ভয়াবহ কাণ্ড ঘটে যাওয়ার পর আক্রান্ত বাড়ির গায়ে সরকারি আধিকারিকদের যোগাযোগের নম্বর লাগানো হয়েছে সরকারের তরফে। অন্য দিকে পোস্টার ঝুলছে ‘আমরা হিন্দু, আমরা আক্রান্ত। আমাদের বাঁচান’। কে বাঁচাবে? বিএসএফ! বিএসএফ-এর উপস্থিতি যেন সকলকে ভরসা দিতে নয়, শুধু বিশেষ একটি পক্ষের জন্যই যেন তাদের আগমন। ভাগলপুর দাঙ্গার পর ১৯৯০ সালে গৌরকিশোর ঘোষের সঙ্গী হয়ে গিয়েছিলাম আক্রান্ত এলাকায়। স্পষ্ট মনে আছে, সেনাবাহিনী নেমেছিল, আক্রান্ত মুসলমানেরা তাদের পরিত্রাতা ভেবেছিলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাদের চলে যেতে হয়। মানুষকে শেষ পর্যন্ত প্রতিবেশীর সঙ্গেই থাকতে হবে আবহমানকাল।
গোটা দেশ জুড়ে মুসলমান সম্প্রদায়ের প্রতি ভয়াবহ বিদ্বেষ। এর মধ্যে ঘটে যাওয়া পহেলগাম ঘটনার পর পাকিস্তান-বিরোধিতার নামে মুসলমান-বিদ্বেষী জতুসামগ্রী সরবরাহ করে চলেছে। মুসলমান পরিচয়ের মানুষ পথেঘাটে আক্রান্ত, তাঁদের খাওয়া-পরা নিয়ে ঘৃণা, তাঁদের কেনা-বেচা নিয়ে বিদ্বেষ, যে কোনও সময় তাঁরা গণপিটুনির শিকার, যে কোনও উৎসবে তাঁদের ধর্মীয় স্থলের সামনে গিয়ে কুৎসিততম ভাষায় নাচানাচি করা এটাই এখন ‘যুগের ডাক’। যে দেশে সম্প্রীতির কথা বললে সদ্য স্বামীহারাকে অশালীন ইঙ্গিত দেওয়া হয়, ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে দেশের জন্য যুদ্ধরত কর্নেলকে জঙ্গির বোন বলা হয়, সেই দেশে হিন্দু আক্রান্ত হওয়ার ঘটনাকে, (যেটি ঘটেছে রাজ্যের একটি জেলার দুইটি ব্লকের অল্প কিছু অংশে), তাকে প্রবল করে তোলার পিছনে ঠিক কী সমীকরণ কাজ করে তা বুঝতে অঙ্কের টপার হতে হয় না। পাশাপাশি ওয়াকফ সংশোধনী নিয়ে আন্দোলনটিও এক রকম নিস্তেজ করা যায়।
কিন্তু সেটাই শেষ কথা নয়। ভরসাও সমান ভাবে উপস্থিত। এলাকার গরিষ্ঠ সংখ্যক মানুষ তথা গোটা মুর্শিদাবাদ জুড়েই মানুষ এই মর্মান্তিক ঘটনায় মর্মাহত। শান্তি ও সম্প্রীতি স্থাপনে ছোট বড় উদ্যোগ করা হয়েছে। কিন্তু মানুষ জানে, তাকে ফিরতেই হবে আপন ছন্দে, দু’দিনের ক্ষতি সারা জীবনের বেদনা হয়ে রইবে, কিন্তু তারই মধ্যে বাঁচতে হবে, ভালবাসা ও ক্ষমায়।
ফিরে আসার পথ জুড়ে শুনলাম সেই আশার কথা। মানুষ জানে।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)