পুজোর গান মানে কি শুধুই আধুনিক বাংলা গান? স্মৃতিতে আজও জেগে সদ্য ছাপাখানা থেকে বেরোনো সুগন্ধি ‘শারদঅর্ঘ্য’, যার পাতার পর পাতায় থাকত সাদা-কালো সব ছবি। ছবি বন্দ্যোপাধ্যায়ের কীর্তন, কৃষ্ণা চট্টোপাধ্যায়ের তিন কবির গান, চণ্ডীদাস মালের আগমনী, নির্মল মুখোপাধ্যায়ের শ্যামাসঙ্গীত, নির্মলেন্দু চৌধুরী পূর্ণদাস বাউল অমর পাল স্বপ্না চক্রবর্তীদের বাউল-পল্লিগানের কথা ছাপানো সেখানে। গান শোনার আগে পড়ে ফেলা, পরে রেকর্ড, রেডিয়োর সঙ্গে মিলিয়ে মিলিয়ে শোনা। আধুনিক গানের অনুরোধের আসরে এই সব ‘স্পেশালাইজ়ড’ শারদ-উপচার না শোনা গেলেও সে গানের ইপি বা এসপি রেকর্ড কেনার মানুষ কম ছিলেন না। নইলে বছরের পর বছর সে গান পুজোর মুখে বেরোত কী ভাবে?
এ ছাড়াও ‘রামী চণ্ডীদাস’, ‘শ্রীরাধার মানভঞ্জন’ আর ছোটদের জন্য ‘হিংসুটে দৈত্য’ ধাঁচের হরেক স্বাদের পুরাতনী লং-প্লেয়িং রেকর্ড বা ক্যাসেট তো হটকেকের মতো বিকিয়েছে এক সময়। ছিল রুমা গুহঠাকুরতার নেতৃত্বে বৃন্দগান। নার্সারি রাইমে উৎপলা সেন রানু মুখোপাধ্যায় বনশ্রী সেনগুপ্ত, ছড়ার গানে শুধু আলপনা বন্দ্যোপাধ্যায় বা সনৎ সিংহ নন, জপমালা ঘোষকেও পাওয়া যেত সজীব কণ্ঠমাধুরীতে। শেষ পাতে বা জলসার শেষ রাতে মিন্টু দাশগুপ্ত হাজির ঘুমতাড়ুয়া গানে। সে গানের অমলিন ব্যঙ্গও জীবন থেকে নেওয়া যা বাঙালি আজও ভোলেনি। ভোলেনি, ‘গুল সবই গুল, তোমার চিঠির পাতায় পাতায় যা লেখা, সে গুল’। কিন্তু সেই শ্রোতারা গেলেন কোথায়?
আসলে মধ্যবিত্তের পাওয়া না-পাওয়া, আবেগ আহ্লাদের সঙ্গে যুক্ত এই গান শোনা, যাঁর প্রধান আর অন্যতম মাধ্যম ছিল রেডিয়ো। মহালয়ার ভোর থেকে ডিসি-পাখার বিশ্রী আওয়াজ সহযোগে সেই যে রেডিয়ো বা ট্রানজ়িস্টরে কান পেতে গান শোনা শুরু হল, তা চলল পাখার আওয়াজ বন্ধ হওয়া ডিসেম্বর-জানুয়ারি পার করে। জলসা ছিল, বিজয়া সম্মিলনী ছিল, হাততালি ছিল, সমঝদারি তো ছিলই। কিন্তু শ্রোতার শোনার যখের ধন নির্জন একাকিত্বে ভরা ওই রেডিয়ো-সেটই। না, আজকের ইলেকট্রনিক মিডিয়ার প্রায় স্বঘোষিত নবরত্ন সভার মেকি জৌলুস রেডিয়োর সে দিনের আভিজাত্যকে স্পর্শ করা তো দূরস্থান, তার নাগালের মধ্যেই যেতে পারবে না। বাংলা গানের শ্রোতা সব সময় নির্জনতা চেয়েছেন। গান শুনে মনের মধ্যে ভিডিয়ো-রূপ তিনিই তৈরি করবেন। একটাইমাত্র লাইক পড়বে সেখানে। সেই রেডিয়ো হয়ে গেছে এফএম, রেকর্ড-ক্যাসেটের জায়গায় চলে এসেছে নানা ইলেকট্রনিক চ্যানেলে গানের ভিডিয়ো-বিপণন। কিন্তু বিজ্ঞানের জয়রথ কি গান শোনার হৃদয়কে ডিজিটাল করে দিতে পেরেছে? এক চুলও নয়। তাই সে দিনের শ্রোতারা এই বাজারে না ঢুকে শোনার আকাঙ্ক্ষাকে গিলে খেয়ে ফেলেছেন।
প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে বাংলা গানে হাত ধরাধরি করে চলে এল ‘রিমেক’। বেসিক, নবতর ভাবনার গানের জায়গা নিল নকলনবিশি। গানে গড়া যে মূল্যবোধ জীবন ছুঁত, সুমন-নচিকেতা-মৌসুমী ভৌমিক-লোপামুদ্রা পর্যন্ত যা ছিল অগ্রগামী, শ্রোতার কানে যা ছিল বলভরসা, আমূল বিপ্রতীপ হয়ে গেল সে ছবি। নতুন গান নিয়ে কেউ বড় একটা ভাবলেন না।
এই সময়ের মান্যগণ্য শিল্পীদের গলায় যা শোনা যায়, তার মধ্যে নতুন গান সংখ্যায় এতই কম যে শ্রোতার নজরে আসে না তা। নজরে এলেও দোকানে গিয়ে তা কেনার উপায় নেই। কোথায় দোকান? কোম্পানিগুলিই তো উঠে গেছে। ওয়েলিংটন মোড়ের পুরনো রেকর্ডের দোকানগুলিও কবেই না ব্যবসা গুটিয়েছে। রেকর্ড, সিডি, ক্যাসেট নেই, তার বাজানোর যন্ত্রও অন্তর্হিত। তবু একদা মেট্রো সিনেমার তলায় টিমটিম করে জেগে থাকা বিপণিতে আজও শ্রোতার অবাধ অধিকার আছে সব কিছু ছুঁয়ে দেখার, কিনুন বা না কিনুন। এই গানপাগলদের গৃহে সযত্নে বাঁচিয়ে রাখা আছে নানা ধাঁচের পুরাতন সব প্লেয়ার। সে সব বাড়ির রোজের পুজোয় ঠাকুরের আসনে ঝাড়ন না পড়ুক, রেকর্ড-ক্যাসেটের গায়ে পড়বেই। পুজো থেকে সূচনা যার, বছরভর সেই গানই বাঙালির অভিমান, প্রাণের পুজো। ছিল— এখন আর নেই।
অনুরোধের আসরে এ বারের গানটির জন্য অনুরোধ জানিয়েছেন বর্ধমান থেকে হাসি ও খোকন, মেদিনীপুর থেকে অপূর্ব মাঝি, মধ্যমগ্রাম থেকে সুনন্দা জয়শ্রী বিপাশা আর সুপ্রিয়া, গড়িয়া থেকে স্বপন ও তপন বণিক। শিল্পী সবিতা চৌধুরী— গৌরী ঘোষ বা অমিয় চট্টোপাধ্যায়ের গলার স্নিগ্ধ ঘোষণার পর পরই বেজে উঠত সমাজ পুনর্গঠনের জনপ্রিয় আধুনিক, ‘ও বৌ কথা কও বলে পাখি আর ডাকিস না’। রবিবাসরীয় মাংস-ভাতের পরে গোটা পরিবার কান পেতে শুনছে অনুরোধের আসর— আজকের এআই বা কোনও টাইম-মেশিনের সাহায্যে সে দিনের সেই দুপুরে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা হলে রবীন্দ্রনাথের গানের কলিই বাস্তব শিক্ষা দিয়ে ফিরিয়ে দেবে তাকে। শোনা যাবে, ‘হায় রে সে কাল হায় রে, কখন চলে যায় রে/ আজ এ কালের মরীচিকায় নতুন মায়ায় ভাসিতে’।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)