রাজপ্রাসাদের নিয়ম-নিগড়ে তৈরি দমবন্ধ পরিবেশ থেকে বাঁচতে রাজপুত্র ও তার প্রিয় সখা সওদাগরপুত্র সমুদ্রে তরী ভাসিয়ে দেয়। তাদের তরণীখানি ঢেউয়ে ভাঙচুর হলে তারা এসে পড়ে এক তাসের দেশে। সেখানে আবার নিয়মই সব। ওঠাপড়া, চলাফেরা নিয়ম মতো হতে হয়। তাদের মন্ত্র— ‘দূরে তাকিয়ো নাকো,/ ঘাড় বাঁকিয়ো নাকো/ চলো সমান পথে/ চলো নিয়ম-মতে...।’ এখানে ‘সমান পথ’ কথাটি লক্ষণীয়। সামাজিক একরৈখিকতা বোঝাতে শব্দ দু’টি প্রযুক্ত হয়েছে যেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই নির্মাণ উৎসর্গ করেছিলেন সুভাষচন্দ্র বসুর উদ্দেশে। তখন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম তীব্র। আর চোদ্দোটা বছর পর দেশ স্বাধীন হবে, রবীন্দ্রনাথ তা দেখে যেতে পারবেন না। তবে ব্যক্তিস্বাধীনতার প্রবক্তা রবীন্দ্রনাথ তাসের দেশ (১৯৩৩) নাটিকায় যেন আগাম সতর্ক করেছিলেন, ভারত তাসের দেশে না পরিণত হয়। স্বাধীন দেশের নাগরিক যেন রাষ্ট্রের নিয়মকানুনে সব একরৈখিক না হয়ে পড়ে। ভারতের স্বাধীনতা মানে নানা জাতি, নানা মত, নানা পরিধান, এবং আরও অগণিত উপায়ে নিজের পরিচয় নিজে নির্মাণ করার স্বাধীনতা। ভারতীয়রা যেন নানা আকাঙ্ক্ষা-চাহিদা-পরিচয় নিয়ে সহাবস্থানে থাকতে পারে, তাসের দেশ সেই বার্তা বহন করেছিল।
ভারত স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছর পেরিয়ে এসেছে। রবীন্দ্রনাথের সেই শিক্ষা যে এ-দেশ গ্রহণ করেনি তা নয়। বিভিন্ন সময় ফ্যাসিস্ট শক্তি ভারতকে এক ধর্ম, এক জাতি, এক ভাষার দেশ হিসাবে নির্মাণ করার চেষ্টা করলেও ভারত ও তার নাগরিক সে-সব ষড়যন্ত্রকে পরাস্ত করে আভ্যন্তরিক বৈচিত্রময়তাকে নষ্ট হতে দেয়নি। পিতৃতন্ত্র, ব্রাহ্মণ্যবাদ ভারতীয় সমাজে আধিপত্য বিস্তার করেছে বার বার, তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। তবু এ দেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘু, দলিত-জনজাতি, নারী, এমনকি বিশেষ ভাবে সক্ষম মানুষরা সংগ্রাম-আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে নিজেদের জায়গা ধরে রেখেছেন। তাঁদের সেই প্রচেষ্টা সম্মানিত, অভিনন্দিতও হচ্ছে সমাজে। তুলনায় ব্রাত্য হয়ে রয়েছে দেশের যৌনসংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী। ভারতের সমকামী-রূপান্তরকামী মানুষ-সহ সমস্ত লিঙ্গযৌনপরিচয়ের মানুষদের বেঁচে থাকার প্রাত্যহিক যুদ্ধ, অকথ্য হেনস্থা-হিংসার শিকার হয়ে পড়া, অকারণ সামাজিক ঘৃণার উদ্দেশ্য হওয়ার বিষয়ে আজ আমরা ওয়াকিবহাল। সংখ্যাগরিষ্ঠ বিসমকামী সমাজ-রাষ্ট্রে এঁরা সংখ্যালঘু। কৈশোরে ভিন্ন যৌনতার উন্মেষের লগ্ন থেকে তাঁদের শুনতে হয়, “চলো সমান পথে, চলো নিয়ম-মতে।” নিজের অন্তর যে পথের দিকে নির্দেশ করে, সে পথ ধরে এগোলে জোটে নির্বাসন, আত্মীয়-পরিজনের পরিমণ্ডল থেকে।
লিঙ্গ যে একটা চলমান পরিচয়, নিজের যৌন-পরিচয় নির্মাণের স্বাধীনতা রয়েছে যে কোনও ব্যক্তির, সমাজ বা রাষ্ট্র তা মানতে পারে না। রূপান্তরের ইচ্ছেকে সমাজ ব্যঙ্গ করে, হেনস্থাও করে। বিসমকামী মানুষদের যৌনতা সন্তানের জন্মের মধ্যে দিয়ে পরিণতি পেতেই পারে, কিন্তু যাঁদের যৌনতার অভিমুখ প্রজনন নয়, তাঁরা ‘অস্বাভাবিক’ বলে পরিগণিত হন। এটা ঠিক যে, গত দু’তিন দশকে বিশ্বের নানা দেশের মতো ভারতেও পরিস্থিতি কিছুটা বদলেছে। ভিন্ন যৌনতার মানুষদের আপন করে নেওয়ার সামাজিক পদক্ষেপও বহু ক্ষেত্রে গৃহীত হয়েছে। তবে অনেক সময়ই তা খুব সানন্দে, স্বচ্ছন্দে নয়। একেবারে বাইরে না রেখে ঘরের ভিতর একটু জায়গা ছেড়ে দিয়ে, নিজে তফাতে থাকার মতো। যাঁরা ‘অদ্ভুত,’ যাঁরা নিয়মের বেড়া ভাঙেন, বন্ধন ছিঁড়ে অগাধ জলে ঝাঁপিয়ে পড়েন কূলের সন্ধানে, গানের সুরে, নাচের ছন্দে তাঁদের উদ্যাপন করে গিয়েছেন চির-আধুনিক রবীন্দ্রনাথ। যাঁরা অদ্ভুত, তাঁরাই সমাজের কাছে নূতন যৌবনের দূত।
রবীন্দ্রনাথের গল্পে, উপন্যাসে, নাটকেও প্রচলিত লিঙ্গযৌনতার বাইরের নানা আকাঙ্ক্ষার কথা আছে। তাঁর ছোট গল্প ‘গিন্নি’তে আমরা পেয়েছি এক ছাত্রকে, নিজের বোনের সঙ্গে খেলনাবাটি খেলার জন্য যে ক্লাসঘরে শিক্ষকের বিদ্রুপের শিকার হয়। চিত্রাঙ্গদা নৃত্যনাট্যে নারীত্ব ও পৌরুষের নতুন ধারাভাষ্য রচিত হয়েছে। ‘কুইয়ার’ তত্ত্বের আলোয় দেখলে রবীন্দ্রনাথ-সৃষ্ট বহু চরিত্রের যাত্রা কিন্তু খুব ‘সমান পথ’ বা ‘স্ট্রেট’ নয়। চতুরঙ্গ উপন্যাসে শচীশ ও শ্রীবিলাসের সম্পর্ক, গোরা উপন্যাসের প্রধান চরিত্র গোরা কিংবা শ্যামা-র উত্তীয়কে নিয়ে নতুন করে চিন্তার অনেক সুযোগ রয়ে গিয়েছে।
কুইয়ার তত্ত্ব লিঙ্গ ও যৌনতা সম্পর্কিত প্রচলিত ধারণাগুলিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। লিঙ্গ ও যৌন পরিচয় যে কেবল জৈবিক নয়, বরং সামাজিক ভাবে গঠিত এবং পরিবর্তনশীল, সে কথাটা কুইয়ার তত্ত্ব নানা পর্যবেক্ষণ, বিশ্লেষণ, বিতর্ক, গবেষণার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। সমসাময়িক লেখালিখি তো বটেই অতীতকালের সাহিত্য-শিল্পেরও নতুন অর্থ অনুসন্ধান, নির্মাণ করে কুইয়ার তত্ত্ব।
রাজপুত্র ও সওদাগরপুত্র তাসের দেশে নবীন ইচ্ছার বন্যা এনেছিল। তাসের মানুষেরা সব একে একে অকারণ শৃঙ্খলার অলঙ্কার খুলতে শুরু করেছিল। রানি তাতে উদ্বুদ্ধ হয়ে বলেছিলেন, “জয়, ইচ্ছার জয়!” মানব সমাজে মানুষের ইচ্ছার যদি সম্মান না থাকে তবে সে তো না মরে বেঁচে থাকা হয়। শেষে রাজা সমস্ত উপলব্ধি করে নিজেই সব বাঁধন ভেঙে দেন। সমকামী-রূপান্তরকামী মানুষদের সমাজে প্রকৃত সম্মানের জায়গা তৈরি করতে হলে শেষ অবধি বিসমকামকে প্রাধান্য দেওয়ার অবস্থান থেকে সমাজকে, রাষ্ট্রকে বেরিয়ে আসতে হবে। সকলকে গলা মিলিয়ে গাইতে হবে, “বন্দী প্রাণমন হোক উধাও।/ শুকনো গাঙে আসুক/ জীবনের বন্যার উদ্দাম কৌতুক/ ভাঙনের জয়গান গাও...”
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)