E-Paper

ভাঙা আয়না, ফাটা মুখ

এ যেন ভাঙা আয়নায় ফাটা মুখ দেখার শামিল। অত্যাধুনিক, প্রগতিবাদী পরিবারেও গৃহসহায়িকাটি সোফা বা ডাইনিং টেবিলে বসেন না।

স্বাতী ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ২৮ মে ২০২৫ ০৫:৫৭

আমরা যেন আয়নার সামনে দাঁড়াই। এই বৈষম্য যেন প্রত্যাখ্যান করতে পারি।” কথাগুলো বলছিলেন অর্থনীতির অধ্যাপক রুশতী সেন। তাঁর কথায় পড়ন্ত বিকেলের বিষণ্ণ ছায়া যেন আরও ঘন হয়ে এল সভার ঘরটিতে। জানলা দিয়ে ভেসে-আসা ট্রেনের হুইসল শোনাল আর্তনাদের মতো। পিছনের সারির প্লাস্টিকের চেয়ারগুলো একে একে খালি হচ্ছে— চারটে বেজে গেল, বাবুবাড়িতে ঠিক সময়ে কাজে না ঢুকলে মুখনাড়া খেতে হবে। ছাপা শাড়ি-জড়ানো দেহগুলি নেমে যাচ্ছে সিঁড়ি দিয়ে।

একটু আগে এই মেয়েরাই কথা বলছিলেন শতমুখে। “রান্নার জন্য কাজে নেয়, তার পর সব কাজ করায়। মাইনে বাড়াতে বললে ছাড়িয়ে দেয়।” “শরীর খারাপের জন্য তিন দিন যেতে পারিনি, ছাঁটাই করে দিল। বলল, শরীর খারাপ নাকি এক দিনের বেশি হতে পারে না।” “এক বাড়িতে টাকা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। রাত দশটা অবধি গৃহসহায়িকাকে বসিয়ে রেখেছিল থানায়। মেয়েটার সাত মাস চলছিল। আমরা গিয়ে ছাড়িয়ে আনলাম।” মাইকের সামনে আর ক’টা কথা বলা যায়। আরও অনেক কথা ঘুরছিল ঘরের মধ্যে। “একটা সন্দেশ খেতে দিল, কাগজের টুকরোর উপর।” “দুধ উথলে গিয়েছিল বলে টাকা কেটে নিল।” মে দিবসে কল্যাণী পরিচারিকা সমিতির সদস্যরা মিছিল করেছিলেন। স্লোগান ছিল: সপ্তাহে এক দিন ছুটি চাই।

এ যেন ভাঙা আয়নায় ফাটা মুখ দেখার শামিল। অত্যাধুনিক, প্রগতিবাদী পরিবারেও গৃহসহায়িকাটি সোফা বা ডাইনিং টেবিলে বসেন না। মেঝেতে বসেন, আলাদা থালা-বাসনে খান। আবাসনে বাবুদের লিফ্টে তাঁদের ওঠা মানা, বাবুদের সঙ্গে পাশাপাশি বসে ভোগ খেতে দেওয়া হয়নি বিধাননগরের এক পুজোয়। যারা গৃহশ্রমিকদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে, তাদের ‘শিক্ষিত’ বলা চলে না, একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন গৃহশ্রমিক-লেখক বেবি হালদার। কেবল যন্ত্রের মতো গৃহশ্রমিকদের ব্যবহার করার প্রতিবাদ করে তিনি বলেছিলেন, গৃহস্থ আর গৃহশ্রমিক পরস্পরকে সাহায্য করছেন, এ ভাবে চিন্তা করা দরকার। পোস্টারের বয়ান তুলে ধরছে বাস্তব পরিস্থিতি— “মাইনে বাড়ানোর কথা হলে, বোনাস দেওয়ার সময় হলে, চোর বদনাম দিয়ে ছাড়িয়ে দেওয়া হয়। এটা কি ঠিক?” এমন চাঁছাছোলা প্রশ্নে বেসামাল অভ্যাগত সমাজকর্মী, অধ্যাপক, ইউনিয়ন নেতারা।

সভা শেষে সবার মনের কথাটাই যেন বললেন রুশতী, “আমরা যারা আপনাদের উপর নির্ভরশীল, আমরা যেন নিজেদের সংশোধন করতে পারি।” গৃহশ্রমিক মেয়েরা চান, সংশোধন হোক গোটা ব্যবস্থার। “ঝি নই, দাসী নই, ন্যূনতম মজুরির শিডিউলে অন্তর্ভুক্ত করা চাই,” ঘোষণা করছে জানলায় আটকানো পোস্টার। হল ঘরটি ভাড়া দেওয়া হয় বিয়ের জন্য। স্থানীয় কাউন্সিলর সদয় হয়ে ভাড়া মকুব করে বলেছেন, ‘গ্রুপ’-এর মিটিং বলে দেখিয়ে দিতে। স্বনির্ভর গোষ্ঠীর ‘গ্রুপ’ না হোক, পশ্চিমবঙ্গে কর্মরত মেয়েদের বৃহত্তম গোষ্ঠী হল গৃহশ্রমিক মেয়েদের দল। শমিতা সেন এবং নীলাঞ্জনা সেনগুপ্ত তাঁদের বই ডোমেস্টিক ডেজ়: উইমেন, ওয়ার্ক অ্যান্ড পলিটিক্স ইন কনটেম্পোরারি কলকাতা (২০১৬)-তে লিখেছেন, বিশের শতক জুড়ে শিল্প, কৃষি ও খনিতে মেয়েদের নিয়োগ যত কমেছে, তত ভিড় বেড়েছে গৃহশ্রমে।

বিশ শতকের গোড়াতেও পুরুষরাই ছিলেন গৃহশ্রমিকদের সিংহভাগ। তাঁরা দ্রুত সরেছেন অন্য কাজে। নিরাপত্তাহীন, সম্মানহীন, স্বল্প মজুরির গৃহশ্রমে এসেছেন মেয়েরা। একুশ শতকের শুরুতে পাঁচ জন রোজগেরে মহিলার এক জন, এবং কর্মরত নাবালিকাদের অর্ধেকেরও বেশি, নিযুক্ত ছিলেন গৃহশ্রমে। ২০১১ সালের জনগণনা পশ্চিমবঙ্গে সাড়ে পাঁচ লক্ষ গৃহশ্রমিক পেয়েছিল। আজ ই-শ্রম পোর্টালে এ রাজ্যের বাইশ লক্ষ গৃহশ্রমিকের নাম উঠেছে। তবে গৃহশ্রমিকদের দাবি, আসল সংখ্যাটা পঞ্চাশ লক্ষেরও বেশি।

এই বিশাল কর্মী-বাহিনীকে ‘শ্রমিক’ বলে মানতে রাজি হয়নি বামফ্রন্ট বা তৃণমূল, কোনও সরকার। গৃহস্থের মনোভাব, এই মেয়েরা পুরো সময়ের কর্মী নন, কয়েক ঘণ্টা কাজ করেন। তা হলে ন্যূনতম মজুরির প্রশ্ন ওঠে কী করে? একই কারণে মাতৃত্বের ছুটি থেকে পেনশন, কিছুই পাওনা হয় না এঁদের। অধরা থাকে একটা বৈধ ঠিকানাও— বস্তিগুলি অধিকাংশই অবৈধ। যাঁরা শহরের বাড়িগুলো সচল রাখেন, তাঁরা আজীবন গৃহহীন হওয়ার ভয়ে থাকেন, লিখেছেন শমিতা, নীলাঞ্জনা।

শ্রমিকের স্বীকৃতি আদায় করতে কী না করেছেন এই মেয়েরা! ইউনিয়ন-বদ্ধ শ্রমিক না হলে শ্রম দফতর কথা বলে না, তাই বহু চেষ্টায় একটি ইউনিয়ন নথিভুক্ত করেছেন (২০১৮), আরও কিছু সংগঠন সে চেষ্টা চালাচ্ছে। শ্রম কমিশনে দরবার করে ন্যূনতম মজুরি ঠিক করার কমিটি তৈরি করিয়েছেন। বাসনমাজা, কাপড়কাচা, রান্না করা প্রভৃতি কাজের ঘণ্টা-প্রতি মজুরি নির্ধারণ করার একটা ফর্মুলা তৈরিও হয়েছিল। তার পর? প্রায় এক দশকের নিস্তব্ধতা। কেরল, তামিলনাড়ু, ঝাড়খণ্ড, ওড়িশায় গৃহশ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ঘোষণা হয়েছে, কেরল-সহ চারটি রাজ্যে গৃহশ্রমিকদের কল্যাণ পর্ষদ চালু হয়েছে। আর বাংলায়? মেয়েরা গান বেঁধেছেন, “মজুরি আইন চালু হল বিভিন্ন রাজ্যে/ ওয়েলফেয়ার বোর্ডের সঙ্গে পেনশনও আছে/ মোদের কিছুই নাই, এ রাজ্যে কিছুই নাই।”

পশ্চিমবঙ্গ গৃহপরিচারিকা সমিতির কর্ণধার স্বপ্না ত্রিপাঠী জানালেন, দাবি নিয়ে দেখা করলে কখনও শাসক দলের নেতারা ক্ষিপ্ত হয়েছেন, তাঁদের ‘বিরোধী’ বলে হাঁকিয়ে দিয়েছেন। আবার এক মন্ত্রী শুনিয়েছেন, ক’জনই বা গৃহপরিচারিকা রয়েছেন? তাঁদের ছেলেমেয়েরা এখন ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হয়ে গিয়েছে, চাইলেও কাজের লোক পাওয়া যায় না। এই ‘অমৃতবর্ষণ’-এর সঙ্গে মিলেছে লক্ষ্মীর ভান্ডার, বিনামূল্যে সামাজিক সুরক্ষা যোজনায় নাম লেখানোর পরামর্শ।

এগুলিতে নাম লেখালে টাকা পেতে পারেন, তা ঠিক। কিন্তু এতে মেয়েদের, বিশেষত অসংগঠিত ক্ষেত্রের মেয়েদের, শ্রমিক পরিচয়টাই খারিজ হয়ে যায়। তাতে সরকারের ভারী সুবিধা— শ্রম-বাজারের অসম, অন্যায্য ব্যবস্থাকে সংশোধনের দায় থাকে না। অসুবিধা মেয়েদের— তাঁদের দরদস্তুরের ক্ষমতা বাড়ে না। রাজনৈতিক দল, শ্রমিক সংগঠনগুলিও তাঁদের হয়ে কথা বলে না। সক্ষমতার এই অভাব শ্রমজীবী মেয়েদের সামাজিক সম্মানও নষ্ট করছে। কারণ প্রশ্ন তো শুধু মজুরির নয়, শ্রমিক মেয়েদের চাই মাতৃত্বের ছুটি, ক্রেশ, সুলভ পরিবহণ, হয়রানির দ্রুত বিচার, এমন কত ব্যবস্থা। ‘শ্রমিক’ স্বীকৃতি না দিলে সে সব দাবি তোলার জমিটাই তৈরি হয় না। এই অসুরক্ষার বিপুলতার কাছে সামাজিক সুরক্ষার কয়েকশো টাকা কতটুকু? সরকার যদি মেয়েদের সক্ষমতা না বাড়িয়ে কেবল নির্ভরতা বাড়ায়, মেয়েদের শক্তির সঙ্গে সরকারের প্রকল্পের সংযোগ যদি না থাকে, তা হলে কী লাভ?

শ্রমিক অধিকার নিয়ে কর্মরত নব দত্ত বলেন, “সরকার মধ্যবিত্তের সমর্থন হারাতে চায় না, তাই গৃহশ্রমিকের দাবি মানবে না। গরিবের সংখ্যা হয়তো বেশি, কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির উপরে মধ্যবিত্তের প্রভাব ভারতের যে কোনও রাজ্যের চাইতে বেশি।” গরিব মেয়েদের আন্দোলন যখনই এই ফাটল সামনে আনে, তখনই মধ্যবিত্ত পাড়তে থাকে নিজের বদান্যতার গল্প— গৃহসহায়িকাকে কত শাড়ি-জামা দিয়েছে, তাঁর সন্তানদের ইস্কুলের মাইনে দিয়েছে, অসুখে ডাক্তার-ওষুধ, আপদে-বিপদে ঋণ জুগিয়েছে। যদিও ভালই জানে, এ সবে কিছুই বদলায় না, বিপন্নতা বজায় থাকে।

উপরন্তু গৃহস্থ নারী-পুরুষ দাবি করেন যে, গৃহশ্রমিক মেয়েটি ‘নিজের বাড়ি’ ‘নিজের ছেলেমেয়ে’ মনে করে তাঁর পরিবারের পরিচর্যা করবেন। অর্থাৎ কেবল শ্রমসম্পদ নয়, গৃহশ্রমিকের অন্তরের সম্পদটুকুর উপরেও পূর্ণ দাবি কায়েম করে মধ্যবিত্ত। মাইনেতে না পোষালে সেই আন্তরিকতা ঝেড়ে ফেলে এক মিনিটে। গৃহশ্রমিকের সন্তান যখন অসম্পূর্ণ শিক্ষা, অপুষ্ট দেহ নিয়ে এসে দাঁড়ায়, তার হাতেও ধরিয়ে দেয় ঝাঁটা, খুন্তি।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Inequality Maids Labours

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy