মাঝ সন্ধেবেলা। রাত হয়ে গেছে, এমনও নয়। মদনপুরার দিকে যাবে না কোনও অটো বা রিকশা। বারাণসীর বিখ্যাত গঙ্গা আরতি দেখার ভিড় হয়েছে দশাশ্বমেধ ও অসি ঘাটে, অটো বা রিকশাও অগুনতি। কিন্তু সমীক্ষার কাজে যেতে গিয়ে দেখি, মদনপুরা যাবে না কেউ। গোধূলিয়া গির্জাঘর পর্যন্ত ছেড়ে দিতে প্রস্তুত, বা সোনারপুরা। বাকিটা হেঁটে চলে যাওয়ার উপদেশ। বারাণসীর মতো জমজমাট শহরে, ভোর চারটে বা রাত বারোটা— যানবাহনের যাতায়াত সব সময়ই তুঙ্গে। কোনও বিশেষ অঞ্চলে, একটিও অটো বা টোটোর না যেতে চাওয়া বিশেষ প্রশ্ন বা উদ্বেগের কারণ।
মদনপুরা অঞ্চলটি ঠিক কোথায়? ভৌগোলিক ভাবে বারাণসীর বাঙালি টোলার একদম গা-ঘেঁষে মদনপুরা। তবে ভৌগোলিক ছাড়া আরও কিছু বৈশিষ্ট্য আছে মদনপুরার। মদনপুরা মূলত বুনকর বা তাঁতিপাড়া। এই মদনপুরায় অটো থামে না কেন?
কোনও ক্রমে একটি অটো যখন ধরতে পারা গেল, ঠিক তখন এক জন এসে পথ আটকালেন। তাঁর বেশভূষা, তিলকরঞ্জিত মস্তক, গলায় ঝুলন্ত বিশেষ সমিতির পরিচয়পত্র তাঁর সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মপরিচয়ের দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করে। শুদ্ধ হিন্দিতে তিনি প্রশ্ন করলেন যে, উনি শুনতে পেয়েছেন অটোটি মদনপুরা যাচ্ছে। ছেলে দু’টি রুখে জবাব দিল, কেন, তারা কি মদনপুরা যেতে পারবে না? তিনি শুধু ঠান্ডা গলায় নির্দেশ দিলেন, অটোচালকরা যেন পরে এসে দেখা করে।
বাঙালিটোলা আলোয় ঝলমল করছে। পাশেই মদনপুরায় কোনও আলো নেই। ইদানীং খুব কম সমীক্ষা হয়েছে এই বিষয়ে। যেটুকু জানা যায়, তা কিছু পুরনো সমীক্ষা, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, আলোচনার ভিত্তিতে। ২০১৯ সালের ইউনিয়ন মিনিস্ট্রি অব টেক্সটাইলস-এর সমীক্ষা বলে, বারাণসী শহরে আছে ১ লক্ষেরও বেশি ওস্তাদ বুনকর, এবং ৮০০০০-এর বেশি তাঁত। ওস্তাদ, শ্রমিক, গদ্দিদার মিলিয়ে সংখ্যাটা প্রায় ৩ লক্ষের কাছাকাছি। কিন্তু এই বুনকর গোষ্ঠীর জনসংখ্যা কমছে দিনে দিনে। ‘চিনিয়া সিল্ক’-এর সমস্যা তো আছেই। হ্যান্ডলুম উঠে গিয়ে পাওয়ারলুমের আধিপত্যের সমস্যাও অজানা নয়। আইডব্লিউএমএফ-এর সমীক্ষা বলে, এখন ৭৫% তাঁতি কাজ করেন পাওয়ারলুমে, আর ২৫% হ্যান্ডলুমে।
মদনপুরার ক্ষেত্রে সমস্যাটির এক অদ্ভুত চেহারা সামনে আসে। বারাণসীর পুরনো বুনকরদের ৯০% সংখ্যালঘু ধর্মাবলম্বী, এ কথা বলে ২০০৭ সালের ইউনিয়ন টেক্সটাইল রিপোর্ট। বিশেষত, সেই সময় অধিকাংশ ‘গৃহস্থ’ বা ওস্তাদ বুনকর, যাঁদের নিজস্ব তাঁত ও পারিবারিক নকশা আছে, তাঁরা ছিলেন সংখ্যালঘু। এখন, বারাণসীর অন্য কেন্দ্রীয় জায়গা, যেমন গোধূলিয়া, চেতগঞ্জ বা লাক্সারোড, গুরুবাগের শাড়ির দোকানে অনেক ক্রেতা ভিড় করলেও, বুনকরদের ঘর ফাঁকা। সমীক্ষা করে ফিরতে বেশ সন্ধে হয়ে গেছে, এমন সময় বৃদ্ধ তাঁতি ওস্তাদ কারও কাছে স্বল্প সময়ের ঋণের জন্য কাকুতিমিনতি করছেন দেখলাম। আমরা বুনকর পরিবারদের এখানে নিয়ে এলাম কী করে? দেশের উন্নতি, দেশজ বস্ত্র উৎপাদনের উন্নতির কথা বুক ফুলিয়ে বলা হয়। বুনকর পরিবাররা এই উন্নতির অংশ নয়?
কোনও কারণে প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি হলে বা যুদ্ধজাতীয় পরিস্থিতির উৎপত্তি হলে, সচরাচর প্রথমেই যাঁদের শত্রু ভেবে নেওয়া হয়, তাঁরা পাড়ার সংখ্যালঘু মানুষগুলি। সেই মুহূর্তে সংখ্যালঘু দর্জিকে ছেড়ে অন্য দোকানে চলে যাওয়া যায় অনায়াসে। সগর্বে ঘোষণা করা যায়, অমুক দোকানের তমুক খাবার বয়কট করলাম। দেশপ্রেমের শ্লাঘা ঝরে পড়ে সেই ঘোষণা থেকে।
পরিণতিতে পুরনো অতিপরিচিত পোশাক প্রস্তুতকারক মানুষটির ব্যবসা কমে যায়। অতি প্রিয় খাবারের বিরুদ্ধে বয়কট বেশি দিন চলে না, তবু এই সুযোগে হঠাৎ ধর্মীয় সংখ্যাগুরু দোকানের রমরমা হয়। এই অন্যায্য ব্যবহার উপেক্ষার পাহাড় গড়ে তোলে। প্রস্তুতকারকের নাম বা অঞ্চল দেখে আমরা সেখানে যাই না, তাঁর দোকান থেকে কিনি না। সরকার বন্ধ করে তাঁদের প্রয়োজনের ‘বহুডি’ ফান্ড স্কিম, বুনকর আইডি কার্ড। ‘উস্তাদ যোজনা’র মতো প্রকল্প বাস্তবায়িত হয় না। তাঁদের তাঁতে ব্যবহার্য বিদ্যুতের খরচ থেকে তুলে নেওয়া হয় ভর্তুকি (আইডব্লিউএমএফ রিপোর্ট, ২০২৪)।
বুনকর হিন্দু যুববাহিনীর মতো সংখ্যাগরিষ্ঠ, সরকার-ঘনিষ্ঠ সংগঠনরা দল বাঁধে বড় গদ্দিদারদের সঙ্গে, যাঁদের হাতে আছে অসংখ্য পাওয়ারলুমের কারখানা। বুনকরদের ছেলেমেয়েরা কাজের খোঁজে ক্রমশ চলে যাচ্ছে সুরাত বা বেঙ্গালুরু। বাকি বুনকররা মদনপুরা বা পিলি কোঠীর মতো পুরনো এলাকা ছেড়ে নতুন কলোনি তৈরির চেষ্টা করছে শহরের উপকণ্ঠে।
ঘটনাক্রমে মদনপুরার বুনকর পাড়া যেখানে শেষ, তার গা-ঘেঁষেই বারাণসীর পুরাতন দুর্গাবাড়ি। চৌষট্টি যোগিনীর মন্দিরের ভিড় সেখানে, অনবরত দু’চাকার যান চলছে।
সপ্তমীর সকাল। অভ্যাসবশে দুর্গাবাড়ির সামনে চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়েছি। চোখ খুলে দেখি এক সংখ্যালঘু পরিবার, তাঁদের দু’চাকার যানটির সম্পূর্ণ আওয়াজ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছেন। আমার নমস্কার করা শেষ হলে তাঁরা হাসিমুখে অভিবাদন জানালেন।
মদনপুরার দুর্গাবাড়ির সামনে একটু আশার সকাল হল তখনই।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)