E-Paper

চাই ঘরে শুশ্রূষার ব্যবস্থা

বিশ্বের সর্বত্র রোগীর গৃহ-শুশ্রূষা (হোম কেয়ার) স্বাস্থ্য পরিষেবার একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র। চটজলদি লাভের আশায় কিছু অজ্ঞাতকুলশীল ব্যবসায়ীর হাতে গৃহ-শুশ্রূষা ছেড়ে দেওয়া যায় না।

সুব্রতা সরকার

শেষ আপডেট: ২০ মে ২০২৫ ০৭:৪৪

হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফেরার দিনটি আনন্দের। কিন্তু আত্মীয়দের মনে থাকে উদ্বেগ— অসুস্থ, অক্ষম মানুষটাকে অণু-পরিবারে দেখবে কে? তখন ভরসা নার্স-আয়াদের সেন্টার। শহরের নানা দেওয়ালে লেখা থাকে বিজ্ঞাপন, “নার্স, আয়া, রাঁধুনি, কাজের লোক পাওয়া যায়।” সঙ্গে একটা ফোন নম্বর। মোটা টাকায় পেশাদার পরিচর্যাকারী নিযুক্ত করে নিশ্চিন্ত হতে চায় পরিবার। কিন্তু কারা এই নার্স বা আয়া? তাঁদের হাতে রোগী কতটা নিরাপদ?

সরকারি নার্সিং স্কুলে কর্মরত অবস্থায় নানা ঘটনা কানে আসত। যেমন, সেন্টার থেকে যাঁকে পাঠানো হল, তিনি নিজেই শুগার, আর্থ্রাইটিসে আক্রান্ত, ভারী চেহারার মহিলা। পক্ষাঘাতগ্রস্ত রোগীকে পাশ ফেরানোর সময়ে ‘ব্যাক কেয়ার’ দেওয়ার কাজটা তিনি এড়িয়ে গেলেন, ফলে রোগীর বেডসোর হতে বেশি সময় লাগল না। কোথাও বা ‘নার্স’ কবুল করেছেন, তিনি ইনিমা দিতে জানেন না। এমনকি ওষুধের নামও পড়তে পারেন না অনেকে। আইসিইউ-ফেরত রোগীর জন্য এক প্রাইভেট নার্সকে মাসে ষাট হাজার টাকা দিয়ে নিয়োগ করেছিল তাঁর পরিবার। প্রেসক্রিপশনের নির্দেশ না বুঝে হাই ডোজ় স্টেরয়েড আচমকা বন্ধ করে দেন তিনি। রোগীকে আবার আইসিইউ যেতে হয়।

অপ্রশিক্ষিত কর্মী দিয়ে রোগীকে নলের মাধ্যমে খাওয়ানো, অক্সিজেন দেওয়া, ইনজেকশন দেওয়া, ক্যাথিটার পরিচর্যা, সবই বিপজ্জনক। বেআইনি তো বটেই। নানা ধরনের ওষুধ কোনটা কী ডোজ়ে, কত বার খাওয়াতে হবে রোগীকে, নার্স বা আয়া তা না বুঝলে বিপদ হতে পারে। অথচ, প্রবাসী সন্তান অনলাইনে আয়ামাসিকে নিযুক্ত করে নিশ্চিন্ত হন। সেই মহিলা হয়তো দু’দিন আগেও গৃহসহায়িকার কাজে নিযুক্ত ছিলেন। আয়া সেন্টার-এর হাত ধরে রাতারাতি রোগী-পরিচর্যাকারী হয়ে গিয়েছেন। আবার যাঁরা রক্তচাপ মাপা, বা ইনজেকশন দেওয়ার মতো কাজ করতে পারার সুবাদে ‘নার্স’ বলে নিযুক্ত হন, তাঁদের অনেককে বড় জোর বলা যেতে পারে ‘স্বাস্থ্যসহায়িকা’। কারণ, সরকার-স্বীকৃত কোনও নার্সিং পাঠক্রম তাঁরা করেননি।

বিশ্বের সর্বত্র রোগীর গৃহ-শুশ্রূষা (হোম কেয়ার) স্বাস্থ্য পরিষেবার একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র। চটজলদি লাভের আশায় কিছু অজ্ঞাতকুলশীল ব্যবসায়ীর হাতে গৃহ-শুশ্রূষা ছেড়ে দেওয়া যায় না। ডাক্তারি শিক্ষার মতো, নার্সদের শিক্ষারও একটি নির্দিষ্ট পাঠক্রম রয়েছে। তাকে ইচ্ছেমতো ছোট বা বড় করা যায় না। যে কোনও দেশে নার্সিং ডিগ্রি পেতে গেলে দু’বছর থেকে চার বছরের পাঠক্রম করতে হয়, যার ভিত্তিতে নার্সিং কাউন্সিল লাইসেন্স দেয়। নার্সিং কাউন্সিলে নথিভুক্ত না হলে কাউকে ‘নার্স’ বলা যায় না। আরও সংক্ষিপ্ত পাঠক্রম ও প্রশিক্ষণ দিয়ে ‘কেয়ার অ্যাসিস্ট্যান্ট’ বা সহায়িকা তৈরি করা যেতে পারে। বিদেশে যাঁদের বলা হয় ‘নার্সিং এড’। তাঁদের কাজ করতে হয় এক জন নার্সের অধীনে।

নিজের ঘরে রোগীকে স্বাস্থ্য পরিষেবা দেওয়ার আর একটি দিক হল ‘হোম হেলথ কেয়ার’। সেখানে এক জন লাইসেন্সপ্রাপ্ত নার্স বা থেরাপিস্ট স্বল্প মেয়াদে কোনও বিশেষ প্রয়োজনে বাড়িতে আসেন। যেমন আমেরিকায় রয়েছে ‘ভিজ়িটিং নার্স সার্ভিস’। যেমন, কারও হাঁটু প্রতিস্থাপন হলে এক জন ভিজ়িটিং নার্স রোগীর বাড়িতে এসে চলাফেরার সঠিক পদ্ধতি অনুশীলন করান। ড্রেসিং করে দেওয়া, ব্যথা প্রশমনের উপায় বোঝানো, ব্যায়াম করানো, এ সবই পড়ে তাঁর কাজের আওতায়। এই পরিষেবা কিন্তু সম্পূর্ণই রয়েছে স্বাস্থ্য বিমার আওতায়, রোগীকে খরচ করতে হয় না।

এ দেশে কি লাইসেন্সপ্রাপ্ত নার্স বা থেরাপিস্ট দিয়ে এই ধরনের পরিষেবা গড়ে তোলা যায় না? এর চাহিদা যেমন রয়েছে রোগীর তরফে, তেমনই নার্সদের তরফেও। বহু মেয়ে বিপুল অর্থ ব্যয় করে নার্সিং পাশ করে কর্মহীন— সরকারি নিয়োগ প্রায় বন্ধ, আর বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিক গোঁজামিল ‘নার্স’ দিয়ে ভরানো হচ্ছে। প্রয়োজন সমাজেরও। ভারতে মানুষের আয়ু যত বাড়ছে, ততই বৃদ্ধদের স্বাস্থ্য পরিষেবার চাহিদা বাড়ছে। হাসপাতালের বোঝা কমাতে হলে গৃহ-শুশ্রূষা ব্যবস্থার উন্নতি করা চাই। সব ধরনের আর্থ-সামাজিক স্তরের রোগীর চাহিদা পূরণ করতে হলে দরকার সমন্বয়: পরিবার, হাসপাতাল, স্বাস্থ্য পরিষেবা সংস্থা, বিমা সংস্থা ও সরকারকে এক সঙ্গে কাজ করতে হবে।

কারিগরি ও প্রযুক্তি শিক্ষার প্রতিষ্ঠানে নানা ধরনের পেশাদারি পাঠক্রম চালু রয়েছে। তার মধ্যে ‘হোম কেয়ার’ বা গৃহ-শুশ্রূষা প্রশিক্ষণ চালু হবে না কেন? অভিজ্ঞ নার্সদের দিয়ে একটা সংক্ষিপ্ত পাঠক্রম তৈরি করা কঠিন নয়। কর্মরত গৃহ-শুশ্রূষাকারীদের তদারকি, দক্ষতা বাড়ানোর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও করা যায়। অতীতে বিশেষ ভাবে সক্ষম মানুষদের সাহায্যের জন্য সরকার একটি ‘ভলান্টিয়ার ট্রেনিং প্রোগ্রাম’ চালু করেছিল। রোগী ও বৃদ্ধদের গৃহ-শুশ্রূষার পাঠক্রমও তেমনই প্রয়োজন।

স্বাস্থ্য পরিষেবা ক্ষেত্র দ্রুত বদলে যাচ্ছে। শুধু চিকিৎসা নয়, রোগাক্রান্ত মানুষটিকে সক্ষম করে স্বাভাবিক জীবনে তাঁকে ফিরিয়ে দেওয়া (পুনর্বাসন) একটা প্রধান লক্ষ্য হয়ে উঠেছে। পাড়ার আয়া সেন্টার থেকে শুরু করে নামীদামি ব্র্যান্ডের ‘হোম কেয়ার’ সংস্থা কিন্তু তার দায়িত্ব নেয় না। রোগীর তাৎক্ষণিক প্রয়োজন চটজলদি মেটাতে গিয়ে তাঁরা বিপদে ফেলতে পারেন রোগীকে। তাই গৃহ-শুশ্রূষার ক্ষেত্রকে আনতে হবে সরকারি পর্যবেক্ষণে, সরকারি নিয়ন্ত্রণে। এটাও জনস্বাস্থ্যের একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Nanny Nurse

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy