E-Paper

যেখানে দেখেছ বেদনা

অতঃপর হিন্দু-মুসলমান রাজনীতি দুই আলাদা প্রবাহে বইতে শুরু করে। দেশবন্ধুর পর আর কোনও কংগ্রেস নেতা বাংলার হিন্দু-মুসলমান দুইয়ের অবিসংবাদিত নেতা হয়ে উঠতে পারেননি।

অনিকেত দে

শেষ আপডেট: ১৫ জুন ২০২৫ ০৫:৩৫
মৃত্যুহীন: দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ ও বাসন্তী দেবী

মৃত্যুহীন: দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ ও বাসন্তী দেবী

বার্ষিকী পালন করা একটা আধুনিক আচার, যার মূল সুর হয়ে উঠেছে উদ্‌যাপনের ছবি এবং মূর্তিতে মালা, কিছু স্মরণসভা, গান-কবিতা ইত্যাদি। দেশবন্ধুর মৃত্যুর তাৎপর্য কিন্তু অন্য রকম। ১৬ জুন, ১৯২৫ কেবল এক মনীষীর মৃত্যুদিন নয়, বাংলার রাজনীতিতে, বিশেষ করে হিন্দু-মুসলমানের রাজনৈতিক সম্পর্কে একটি সন্ধিক্ষণ, যে মুহূর্তের পরে বাংলার ভাগ্য ভিন্ন খাতে বইতে শুরু করে। আজ একশো বছর পরের খণ্ডিত বঙ্গদেশে, দেশবন্ধুর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা এবং দূরদৃষ্টির অভাব কষ্ট দেয়।

দেশবন্ধুর জীবন চুয়ান্ন বছরের, তার মধ্যে প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে ছিলেন কেবল শেষ আট বছর। স্বদেশি আন্দোলন তাঁকে উদ্বুদ্ধ করেছিল, কিন্তু সেই সময় তাঁর নাম ছিল মূলত আইনজীবী হিসাবে। ১৯০৮-০৯ সালে অরবিন্দের হয়ে আলিপুর বোমা মামলায় সওয়াল করার পর তাঁর খ্যাতি বাড়তে থাকে। কিন্তু তার পরেও প্রায় আট বছর তিনি মামলা-মকদ্দমা, কাব্যরচনা, এবং নারায়ণ পত্রিকা সম্পাদনা নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। ১৯১৭ সালে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেসে তাঁর রাজনৈতিক যাত্রা শুরু। তখন থেকেই ধর্মপরিচয়-নির্বিশেষে বাংলার অখণ্ডতায় তাঁর অটল বিশ্বাস: “বাঙ্গালী হিন্দু হউক, মুসলমান হউক, খৃষ্টান হউক, বাঙ্গালী বাঙ্গালী।”

যে সময় চিত্তরঞ্জন রাজনীতিতে প্রবেশ করলেন, তা তাৎপর্যপূর্ণ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষের মুখে, ইংরেজ যে ভারতীয়দের অন্তত আংশিক স্বরাজ দেবে তা পরিষ্কার। প্রশ্ন রইল দুটো: কতটা ক্ষমতা ভারতীয়রা পাবে, এবং সেই ক্ষমতা ভারতীয়দের মধ্যে ভাগ কী ভাবে হবে। প্রথম প্রশ্নের উত্তর সহজেই পাওয়া গেল ১৯১৯ সালে— খুবই অল্প, প্রদেশ-স্তরে কিছু ভারতীয় মন্ত্রীকে বিভাগ দেওয়া মাত্র।

দ্বিতীয় প্রশ্নটি ঢের বেশি জটিল, এবং দেশভাগ পর্যন্ত সেই সমস্যার সমাধান হয়ে ওঠেনি। দেশবন্ধুর রাজনীতি আমৃত্যু এই দুই খাতে বইল: এক দিকে তিনি নিজের রাজনৈতিক দল তৈরি করে, কর্পোরেশন-বিধানসভায় যেটুকু ক্ষমতা পাওয়া গিয়েছিল সেটুকু ধরেই ইংরেজের দ্বিচারিতা স্পষ্ট করে দিলেন; এই কাজে তাঁর প্রধান সহযোগী ছিলেন যুবক সুভাষচন্দ্র। অন্য দিকে, ভাগাভাগির প্রশ্নে, বাংলার হিন্দু এবং মুসলমানের মধ্যে ক্ষমতা এবং সম্পদ বণ্টনের একটা চুক্তির ব্যবস্থা করলেন।

এই ১৯২৩ সালের বাংলার হিন্দু-মুসলমান চুক্তি বা ‘বেঙ্গল প্যাক্ট’ দেশবন্ধুর শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক অবদান। ১৯১৯-২০ সালে মহাত্মা গান্ধী দেশ জুড়ে কংগ্রেসের অসহযোগ আন্দোলনের সঙ্গে ভারতীয় মুসলমানদের খিলাফত আন্দোলনকে জুড়ে দেন, তাতে হিন্দু এবং মুসলমানের ব্রিটিশ-বিরোধী রাজনীতি একত্রিত হয়। বাংলায় এই আন্দোলনের নেতা ছিলেন চিত্তরঞ্জন, এই আন্দোলনের প্রেক্ষাপটেই তাঁর এবং তাঁর সহধর্মিণী বাসন্তী দেবীর ত্যাগস্বীকার ও নেতৃত্ব কিংবদন্তি হয়ে ওঠে। চিত্তরঞ্জন হিন্দু-মুসলমান দুইয়ের কাছেই দেশবন্ধু হিসাবে স্বীকৃত হন। কিন্তু দেশবন্ধু বাংলার নেতা, বাংলার স্বার্থ তাঁর কাছে সবার উপরে। তিনি বুঝেছিলেন, সর্বভারতীয় হিন্দু-মুসলমানের হিসাব— অর্থাৎ হিন্দুরা সংখ্যায় বেশি, মুসলমানরা অল্প— বাংলায় চলবে না, কারণ বাংলায় মুসলমানরা সংখ্যাগুরু, এবং আর্থ-সামাজিক ভাবে পিছিয়ে। তাঁদের সঙ্গে সৎ, সযত্ন বোঝাপড়ায় না আসতে পারলে হিন্দু-মুসলমান রাজনৈতিক শত্রু হয়ে উঠবে, বাংলার জন্য সেই শত্রুতার ফল হবে ভয়ঙ্কর। দেশবন্ধুর মৃত্যুর বাইশ বছর পর, ১৯৪৭ সালেই সেই ভয়াবহতা আমরা টের পাই।

বেঙ্গল প্যাক্ট-এর মূল কথা ছিল সরকারি চাকরি এবং নির্বাচিত বিভিন্ন সভায় আসন বণ্টন, সমাজবিশারদ বিনয়কুমার সরকারের ভাষায়, ‘ডাল-ভাতের সমস্যা’। দেশবন্ধু বুঝেছিলেন যে একটা মুসলমান মধ্যবিত্ত শ্রেণি তৈরি হয়েছে, এবং তাঁদের চাকরি না পাওয়ায় একটা ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। তিনি নিয়ম করেন, ৫৫ শতাংশ সরকারি চাকরি মুসলমানরা পাবেন, এবং সেই শতাংশ না পৌঁছনো পর্যন্ত ৮০ শতাংশ নতুন নিয়োগ হবে মুসলমানদের। এতে হিন্দুরা ক্ষুব্ধ হন— দেশবন্ধু তাঁদের বারংবার বিরাট ‘স্বার্থত্যাগ’ করার আবেদন করেন, কারণ তিনি জানতেন ক্ষুদ্র স্বার্থের বিনিময়ে বাংলার ঐক্য একটা বড় লাভ। দাঙ্গা আটকানোর জন্য দু’পক্ষ মসজিদের বাইরে বাজনা না বাজানোর এবং প্রকাশ্য গোহত্যা না করার সিদ্ধান্ত নেয়। হিন্দু এবং মুসলমান উভয় সমাজের কিছু গোঁড়া অংশ এই চুক্তির বিরুদ্ধে ছিল; কিন্তু দেশবন্ধুর পাশে ছিলেন আবুল মনসুর আহমদ, শরৎচন্দ্র এবং সুভাষচন্দ্র বসু, কাজী নজরুল ইসলাম, বীরেন্দ্রনাথ শাসমল, এবং অবশ্যই বৃহত্তর বাঙালি মুসলমান সমাজ। সবচেয়ে বড় কথা, বাংলায় হিন্দু-মুসলমানের সমস্যা যে মারামারি না করে চুক্তির মাধ্যমে নিষ্পত্তি করা যায়, তার একটা নতুন এবং আশ্চর্য রূপরেখা তৈরি হল।

বেঙ্গল প্যাক্ট বেশি দিন টেকেনি; দেশবন্ধুর প্রচণ্ড চেষ্টা সত্ত্বেও, ১৯২৩ সালের সর্বভারতীয় কংগ্রেস কোকনড় সম্মেলনে সেই চুক্তি প্রত্যাখ্যান করে: তারা সারা ভারতে এক রকম, বাংলায় আর এক রকম নিয়মে প্রস্তুত ছিল না। সর্বভারতীয় রাজনীতি এবং প্রদেশের রাজনীতির পার্থক্য না করার মূর্খামি এর পর কংগ্রেস বারংবার করে, সেই মূল্য শেষ পর্যন্ত দেশভাগ দিয়ে চোকাতে হয়। বলা যায়, ১৯২৩ সালে বেঙ্গল প্যাক্ট প্রত্যাখ্যান তার প্রথম দিকের ধাপ ছিল। এতে মুসলমানদের আস্থা কমে যায়। আরও দেড় বছর দেশবন্ধু বাংলায় খানিকটা টিকিয়ে রাখেন এই চুক্তি; কিন্তু তিনি তখন জেল খেটে খেটে অসুস্থ, সুভাষচন্দ্র বর্মায় বন্দি। ১৬ জুন ১৯২৫-এ তাঁর মৃত্যুর পর বাংলার কংগ্রেসের নেতারা নিজেদের আখের গোছাতে এবং হিন্দু স্বার্থ দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। সেই বছরগুলিতে উত্তর ভারত এবং পঞ্জাবেও হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কের অবনতি হয়। আর্য সমাজের স্বামী শ্রদ্ধানন্দ দিল্লিতে এক গোঁড়া মুসলমানের হাতে খুন হন। বাংলা কংগ্রেস দ্রুত বেঙ্গল প্যাক্ট ত্যাগ করে। অতঃপর হিন্দু-মুসলমান রাজনীতি দুই আলাদা প্রবাহে বইতে শুরু করে। দেশবন্ধুর পর আর কোনও কংগ্রেস নেতা বাংলার হিন্দু-মুসলমান দুইয়ের অবিসংবাদিত নেতা হয়ে উঠতে পারেননি।

হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে রাজনৈতিক সেতুবন্ধনের পথ যে কতটা দুর্গম, তা দেশবন্ধুর অজানা ছিল না। তাঁর যৌবনের স্বদেশি আন্দোলন ক্ষুদ্র হিন্দু-মুসলমান স্বার্থের প্রশ্নেই বিফল হয়েছিল; ১৯২০-র দশকে, ইংরেজের থেকে ক্ষমতা নেওয়ার লোভে, সেই স্বার্থ আরও বড় আকারে প্রকট হত। তাই তিনি সর্বস্ব বাজি রেখে বেঙ্গল প্যাক্ট করতে চেয়েছিলেন। এবং বাংলার মানুষ তাঁকে যা সমর্থন দিয়েছিল, তা তাঁর শবযাত্রায় ঐতিহাসিক জনসমাগম থেকেই স্পষ্ট। বিনয়কুমার দেশবন্ধুকে তুলনা করেছিলেন বিশ্বের দুই বিরাট নেতার সঙ্গে: চিনের সুন-ইয়াৎ সেন এবং মিশরের জ়গলুল পাশা। দেশবন্ধু যেমন বাংলার হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে ঐক্য রচনা করেন, সুন করেন চিনের জাতীয়তাবাদী এবং কমিউনিস্টদের মধ্যে; জ়গলুল মিশরের মুসলমান এবং খ্রিস্টানদের মধ্যে। সুন মারা যান দেশবন্ধুর তিন মাস আগে; জ়গলুল দু’বছর পর। বাংলা, চিন এবং মিশর, তিন দেশেই বোঝাপড়ার রাজনীতির শেষ হয় মোটামুটি একই সময়ে। তার পর আস্তে আস্তে জায়গা নিতে থাকে জাতিরাষ্ট্রের এক রকম ধারণা, যেখানে একটি রাষ্ট্রে একটি বিশেষ পরিচিতির— ধর্ম বা রাজনৈতিক আদর্শের ভিত্তিতে— আধিপত্যকে স্বীকার করে নেওয়া হয়। দেশবন্ধুর রাজনীতি এই জাতিরাষ্ট্রের ধারণার বিপরীত: ১৯২২ সালেই তিনি এশীয় দেশগুলির ‘ফেডারেশন’-এর কথা বলেন; জীবনের শেষ বড় বক্তৃতায় ‘জাতিতে জাতিতে মিলন’কে রাষ্ট্রের ভিত্তি হিসাবে দেখেন।

বেঙ্গল প্যাক্ট প্রত্যাখ্যান এবং দেশবন্ধুর মৃত্যুর পরেও এই বোঝাপড়ার রাজনীতি একেবারে শেষ হয়ে যায়নি। ১৯৪৭ সালের মে মাসে, দেশভাগের মুহূর্তে বাংলাকে অখণ্ড রাখার জন্য শরৎচন্দ্র বসু, আবুল হাশিম এবং হোসেন শহিদ সুরাবর্দি, ‘ইউনাইটেড সভরেন বেঙ্গল’-এর কথা ভাবেন, যাতে বাংলার খানিকটা সার্বভৌমত্ব বজায় রাখা যায়। গান্ধী এবং জিন্না দু’জনেই সেই পরিকল্পনায় সায় দেন, কিন্তু নেহরু-পটেলের কেন্দ্রীয় কংগ্রেস এবং হিন্দু মহাসভা তীব্র প্রতিবাদ করে। শরৎচন্দ্র এবং সুরাবর্দি দু’জনেই দেশবন্ধুর শিষ্য এবং বেঙ্গল প্যাক্ট থেকে শিক্ষা নিয়েছিলেন, কিন্তু কেন্দ্রীয় রাজনীতির জাঁতাকলে তা নষ্ট হয়, বাংলা ভাগ হয়।

সেই ভাগের উত্তরাধিকার, এবং সর্বোপরি হিন্দু-মুসলমানকে ঐক্যবদ্ধ না করে পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়িয়ে দেওয়ার পরম্পরা, খণ্ডিত বাংলার দু’পারেই আজ নির্মম ইতিহাস। তাই দেশবন্ধুর শততম মৃত্যুদিনে, শত ব্যর্থতা, ভুল এবং প্রতিকূলতা সত্ত্বেও, বাংলার হিন্দু-মুসলমানের ঐক্যের রাজনীতির ঐতিহ্য যেন আমরা না ভুলি। যেন না ভুলি যে আজ থেকে একশো বছর আগেও অবিভক্ত বাংলার মানুষ দেশবন্ধু এবং তাঁর রাজনীতিকে প্রাণভরে সমর্থন করেছিলেন আর ভালবেসেছিলেন: “হিন্দুর ছিলে আকবর তুমি মুসলিমের আরংজিব,” নজরুল লেখেন দেশবন্ধুর মৃত্যুর পর, “যেখানে দেখেছ জীবের বেদনা, সেখানে দেখেছ শিব।”

ইতিহাস বিভাগ, ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া সান ডিয়েগো

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Chittaranjan Das Harmony Communal harmony

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy