Advertisement
১১ মে ২০২৪
Manipur Violence

একের মধ্যে অনেক লড়াই

কাদের স্বার্থে, কাদের মদতে এই লড়াই? অভিজ্ঞরা বলেন যে, উত্তর-পূর্বে লাভজনক সন্ত্রাসবাদের ‘দোকান’ মণিপুরেই, সন্ত্রাসের নতুন সংজ্ঞা পাহাড় দখল।

people of Manipur in distress

অশান্ত মণিপুরে ভয়ে দিন কাটাচ্ছে সাধারণ মানুষ। Sourced by the ABP

রাজীবাক্ষ রক্ষিত
শেষ আপডেট: ১৯ মে ২০২৩ ০৭:০৭
Share: Save:

এখন অবিশ্বাস্য মনে হয়। মণিপুরের বিষ্ণুপুর জেলার মৈরাঙে ভারতের মূল ভূখণ্ডে প্রথম তেরঙা উত্তোলন করেন সুভাষচন্দ্র বসু। এখন সেখানে চলছে ‘স্বাধীনতা’র লড়াই। মণিপুরি নৃত্যকে সাদরে শান্তিনিকেতনে বরণ করে এনেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, তাঁর রচিত ‘জনগণমন’ বয়কটের ডাক দেওয়া হচ্ছে চিত্রাঙ্গদার রাজ্যে। মণিপুরি বৈষ্ণবরা শ্রীচৈতন্যের ভাবশিষ্য, প্রেমধর্মের পীঠস্থান এখন বিদ্বেষভূমি। ‘ক্রীড়া রাজধানী’র পরে দেশের ‘ফ্যাশন ও স্টার্ট-আপ রাজধানী’র তকমা পাওয়া মণিপুর ফের হিংসার খবরে শিরোনামে। হরেক যুদ্ধ: নিজের সঙ্গে, রাজ্যের সঙ্গে, দেশের সঙ্গে।

কাদের স্বার্থে, কাদের মদতে এই লড়াই? অভিজ্ঞরা বলেন যে, উত্তর-পূর্বে লাভজনক সন্ত্রাসবাদের ‘দোকান’ মণিপুরেই, সন্ত্রাসের নতুন সংজ্ঞা পাহাড় দখল। মায়ানমারের মাফিয়া গোষ্ঠীর মদতে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে আফিম ও গাঁজার চাষ। দেশের হেরোইন রাজধানী হয়ে উঠেছে মণিপুর। সীমান্তবর্তী গ্রামগুলি মাদক তৈরির কারখানা, মানুষ ফসলের চাষবাস বন্ধ করে আফিম চাষ করছেন। মায়ানমার-চট্টগ্রাম সীমান্ত জুড়ে মাদক তৈরি সংগঠিত ‘শিল্প’, মণিপুরে কুকিদের ব্যবহার করে তা ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। মায়ানমার ও মিজ়োরাম থেকে কুকিরা নাগাড়ে মণিপুরে ঢুকছেন। আফিম চাষের পাশাপাশি উন্নত আগ্নেয়াস্ত্র দিয়েও মদত দিচ্ছে মায়ানমারের ও-পারের চিনা এজেন্টরা।

এক হেক্টর জমিতে ধান চাষে বড়জোর ১ লক্ষ টাকা মেলে, সেখানে পপি চাষে ৬-৭ লক্ষ। কুকি গ্রামবাসীদের বিকল্প রোজগারের সরকারি ব্যবস্থা এর ধারেকাছে আসে না। আফিমের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে মৃত, নিখোঁজ পুলিশকর্মী, গ্রামরক্ষী, সাংবাদিকও। জেএনইউ-এর ইনস্টিটিউট অব অ্যাডভান্সড স্টাডিজ়-এর অধিকর্তা ভগৎ ওইনামের মতে, যে ভাবে বহিরাগত কুকিরা মণিপুরে ঢুকে ভারতীয় প্রমাণপত্র বানিয়ে ফেলছেন তা চিন্তার কথা।

মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রী বীরেন সিংহ গদি বাঁচাতে ও বিদ্রোহী কুকি বিধায়কদের দমন করতে আফিম-গাঁজা চাষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। নিন্দুকের মত, আসলে নাগা-ঘনিষ্ঠ সরকার মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ হাতে নিতে চাইছে। কেন্দ্র মণিপুরে ইনার লাইন পারমিটও চালু করেছে। পুলিশ কুকি জেলাগুলিতে হানা দিয়ে আফিম খেত ধ্বংস করেছে, চলছে নাগরিকত্ব যাচাই। বহিরাগত কুকিরা কোণঠাসা। কুকিদের উপরে হাত তুললে কুকি জঙ্গি সংগঠনগুলি হাতে অস্ত্র নেবে। তাই আগেই সেগুলির সঙ্গে সংঘর্ষ বিরতি প্রত্যাহারের সুপারিশ করে রাজ্য সরকার। ঘোষিত হয়, কুকি এলাকাগুলিতে বহিরাগতরা সংরক্ষিত বন, পাহাড়, সরকারি জমি দখল করেছেন, সেখানে উচ্ছেদ চলবে। ইস্টারের পর কুকি এলাকায় তিনটি গির্জা ভেঙে ফেলা হয়, ঢুকে পড়ে ধর্মের লড়াইও। সরকারের বক্তব্য, হিংসায় সামনের সারিতে ছিল কুকি জঙ্গিরা।

মেধাতে কিন্তু কুকিরা কম যান না। আইএএস, আইপিএস, সেনা কর্তাদের মতো অনেক পদস্থ ও বিখ্যাত মানুষই কুকি। উচ্চপদে সংরক্ষণেরও সুবিধা পেতেন কুকিরা। এর মধ্যে মেইতেইদের জনজাতিকরণ সম্পর্কে মণিপুর হাই কোর্টের নির্দেশে অশান্তি বাড়ে। সংখ্যাগুরু মেইতেইরা জনজাতি হলে কুকি-নাগাদের জমি, চাকরির অধিকারে কোপ পড়বে। কুকিরা প্রশ্ন তোলেন, বংশানুক্রমে যাঁরা রাজার জাত, রাজ্যে সংখ্যাগুরু, রাজনীতি-সমাজ-অর্থনীতির নির্ণায়ক, তাঁরা কোন যুক্তিতে তফসিল জাতিভুক্ত হতে পারেন?

মেইতেই নেতারাও বলছেন, সামান্য একটি অংশ বাদে তাঁদের কেউ জনজাতি হতে চান না। কারণ, তাতে বংশগৌরব হারাবেন। মুখ্যমন্ত্রী-ঘনিষ্ঠ এক আমলা বলছিলেন, “মেইতেইদের জনজাতিকরণের বিষয়টি পাশ হলে সবচেয়ে বড় প্রতিবাদ তাঁদের মধ্যে থেকেই উঠবে। মেইতেইদের মধ্যে ব্রাহ্মণ, বৈষ্ণব, মুসলিমরা আছেন, তাঁরা এসটি হতে চাইবেন না। এসসি হিসাবে কেন্দ্রে মেইতেইরা ১৫ শতাংশ সংরক্ষণের সুবিধা পান, এসটি হলে তা কমে অর্ধেক হবে।” তাঁর আক্ষেপ, হাই কোর্টের রায়ের ভুল ব্যাখ্যা তুলে ধরে বিজেপি নেতাদের একাংশ স্বার্থসিদ্ধিতে নামেন, মন্ত্রিত্ব না পেয়ে আগুন নিয়ে খেলা শুরু করেন। পরে সামলাতে পারেননি, রাশ চলে যায় সশস্ত্র জঙ্গি ও ক্ষিপ্ত জনতার হাতে।

অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগে ইংরেজরা কুকিদের মালবাহী ও ভাড়াটে সেনা হিসাবে নিয়ে এসে মণিপুরে বসতি গড়ে দেয়। মূল কারণ ছিল নাগা-মেইতেইদের মধ্যে দেওয়াল তোলা। জমি-জঙ্গলের দখল নিয়ে গত শতকের নব্বই দশকে নাগা ও কুকিদের মধ্যে শুরু হয় সংঘর্ষ। ১৯৯৩-এ নাগা-কুকি লড়াইয়ে প্রাণ হারান দু’শোরও বেশি মানুষ। এ বারের জমির লড়াইতে নাগাদের পাশে পেতে চাইছিল দুই পক্ষই। গির্জা ভাঙা শুরু হতে বিক্ষোভে কুকিদের সঙ্গে পা মেলান নাগারাও। অবশ্য পরে নাগা বিধায়কেরা মুখ্যমন্ত্রীর শিবিরে ফিরেছেন। এ লড়াই যে হিন্দু বনাম খ্রিস্টান লড়াই নয়, জমি ও স্বার্থের লড়াই, সবাই জানেন।

মণিপুরের দুই মন্ত্রী-সহ দশ কুকি বিধায়ক পৃথক রাজ্যের দাবি তুলেছেন। পার্বত্য এলাকায় পৃথক রাজ্য ও প্রশাসনের ব্যানার-পোস্টার, দেওয়াল লিখনে ‘চিন-কুকি-মিজ়ো এক হোক’, ‘সেভ কুকিল্যান্ড’, ‘নিজের জমির জন্য লড়াই চলবে’, এমনকি ‘বৃহত্তর মিজ়োরাম’ লেখা। পাহাড়ি জেলাগুলিতে সরকারি দফতর, হাসপাতাল, দোকান, থানার বোর্ডে মুছে দেওয়া হয়েছে মণিপুরের নাম। এর মধ্যেও রুপোলি রেখা মণিপুরের ছাত্রীরা। কুকি এলাকায় আটকে পড়া মেইতেইদের উদ্ধার করতে সেনা এসেছে, খবর পেয়ে অজস্র কুকি ছুটে আসেন ঝাঁপিয়ে পড়তে। রাজপথ জুড়ে কুকি ছাত্রী ও মহিলারা মানবশৃঙ্খল তৈরি করেন। জানান, প্রাণ থাকতে মেইতেইদের উপরে হামলা হতে দেবেন না। তর্জন-গর্জনের পরে ফিরে যায় হামলাকারীরা। আবার মণিপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসে কুকি ছাত্রীদের খোঁজে এলে, রুখে দাঁড়ান মেইতেই ছাত্রীরা। আরও বড় লজ্জার হাত থেকে বেঁচেছে মণিপুর।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE