E-Paper

বিরোধিতার পরিসর নেই?

প্যারিসে কোনও দুর্ঘটনা ঘটেনি, উৎসবের সুযোগে এক দল মানুষ আক্রমণ কর্মকাণ্ড চালিয়েছে। কারা তারা? ফুটবল-উৎসবের মিছিলে উড়েছে প্যালেস্টাইনের পতাকা।

মোহিত রায়

শেষ আপডেট: ১৭ জুন ২০২৫ ০৭:৪৭
রাজপথে: প্যারিস সঁ জরমঁ-এর চ্যাম্পিয়নস লিগ জয়ের পর উৎসব। ১ জুন, ২০২৫।

রাজপথে: প্যারিস সঁ জরমঁ-এর চ্যাম্পিয়নস লিগ জয়ের পর উৎসব। ১ জুন, ২০২৫। ছবি: রয়টার্স।

ফরাসি ফুটবল ক্লাব প্যারিস সঁ জরমঁ চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতেছে। গত ১ জুন প্যারিসে সেই উৎসবের রাতে হল ছুরিকাঘাত, মৃত্যু, মেয়েদের নিগ্রহ, একের পর এক গাড়িতে আগুন, দোকান লুটপাট। সেই ‘উৎসব’ গড়াল ২ জুন রাত পর্যন্ত। এর দু’দিন পর, ৪ জুন সন্ধ্যায় বেঙ্গালুরুতে রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরুর আইপিএল জয়ের উৎসবেও মৃত্যু হল অনেকের। সেই মর্মান্তিক দুর্ঘটনা কেবলই জনতার ভিড়ে, প্রশাসনের ব্যর্থতায় পদপিষ্ট হয়ে মৃত্যু। কিন্তু প্যারিসের ঘটনা কোনও দুর্ঘটনা নয়। সমস্যাটা হল, ইউরোপীয় সংবাদমাধ্যম প্যারিসের ঘটনাটিকে অনেকটাই বেঙ্গালুরুর মতো প্রশাসনিক ব্যর্থতার ঘটনা হিসাবেই পরিবেশন করেছে।

প্যারিসে কোনও দুর্ঘটনা ঘটেনি, উৎসবের সুযোগে এক দল মানুষ আক্রমণ কর্মকাণ্ড চালিয়েছে। কারা তারা? ফুটবল-উৎসবের মিছিলে উড়েছে প্যালেস্টাইনের পতাকা। ফ্রান্সের মুক্তি ও স্বাধীনতার প্রতীক মহীয়সী জোয়ান অব আর্ক-এর বিখ্যাত মূর্তিকে ঢেকে দেওয়া হয়েছে প্যালেস্টাইনের পতাকায়। তাদের হাতে ছিল আলজিরিয়া, মরক্কো, টিউনিজ়িয়ার পতাকাও।

সুতরাং অভিবাসী সম্প্রদায়ের বিক্ষোভ হিসাবেই একে দেখা যায়। গত নববর্ষে সরকারি মতে ৯৮৪টি গাড়ি জ্বালিয়েছে এই অভিবাসীরা। এই আক্রমণ নতুন নয়। প্রতি বছর সে দেশে গড়ে হাজারখানেক গাড়ি পোড়ানো হয়, লুটপাট চলে। ফরাসি মানুষ ও সরকার মেনেই নিয়েছেন এ সব হবে। আমেরিকার এক সংবাদপত্রে ২০২৪-এর ১ জানুয়ারি লেখা হয়, নববর্ষের আগমনে ফ্রান্সে গাড়িতে অগ্নিসংযোগ এ বার ১০ শতাংশ কম হয়েছে, পুড়েছে ৭৮৪টি গাড়ি।

ইউরোপের অভিবাসী সম্প্রদায়ের এই সহিংস কর্মকাণ্ড চলছে ক্রমাগত। পাল্লা দিয়ে রাজনীতিও পাল্টাচ্ছে। ইউরোপীয় রাজনীতির গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, বৈচিত্র, অন্তর্ভুক্তি ইত্যাদি ভাবনার বিরোধী কোনও চিন্তা অনুমতিযোগ্য নয় বলেই এত দিন মনে করা হত। এখন দেশে অভিবাসীদের আশ্রয় ও ইউরোপীয় সংস্কৃতি-বিরোধী কর্মকাণ্ডে প্রশ্রয়ের ঘোরতর বিরোধী ফ্রান্সের ন্যাশনাল র‌্যালি পার্টি ও প্রধান বিরোধী নেত্রী জঁ-মারি ল্য পেন। তবে ৩১ মার্চ ফ্রান্সের এক আদালত রায় দিয়েছে, ল্য পেন আগামী ২০২৭-এর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন না, পাঁচ বছর কোনও জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হতে পারবেন না, এবং তাঁর চার বছরের জেল এবং এক লক্ষ ইউরো জরিমানা হবে। ল্য পেনের বিরুদ্ধে অভিযোগ, ব্রাসেলসে ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টে তাঁর পার্টি নিযুক্ত সহকারীরা পার্লামেন্টের তহবিল থেকে বেতন নিয়ে তাঁদের দলের পার্লামেন্ট-সদস্যদের কাজকর্মে সাহায্য না করে পার্লামেন্টের বাইরে রাজনৈতিক কাজে ব্যস্ত থেকেছেন। গত দশ বছরে ল্য পেনের পার্টির কর্মীরা পার্লামেন্টের কাজ না করে পার্লামেন্ট থেকে নিয়েছেন ৪৫ লক্ষ ইউরো। একই অভিযোগে অতি সম্প্রতি, ৪ জুন থেকে ল্য পেন আর উত্তর ফ্রান্সের একটি প্রদেশের প্রতিনিধি থাকতে পারবেন না।

পঞ্চাশ বছর আগের ভারতের কথা মনে পড়ে। জনতার বিপুল ভোটে বিজয়ী ইন্দিরা গান্ধীর রায়বরেলী লোকসভা আসনের নির্বাচন বাতিল-সহ ছয় বছরের জন্য তিনি কোনও নির্বাচনের অযোগ্য বলে রায় দিয়েছিল ইলাহাবাদ হাই কোর্ট। শ্রীমতী গান্ধী ওই আসনে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী রাজ নারায়ণকে এক লক্ষেরও বেশি ভোটে পরাজিত করেছিলেন। ইন্দিরা গান্ধীর বিরুদ্ধে ছিল টাকা বিলানো, শাড়ি-ধুতি ঘুষ দেওয়া, গাড়ি করে বুথে ভোটার আনা, নির্ধারিত টাকার চেয়ে বেশি খরচ ইত্যাদি অভিযোগ। অপরাধ সাব্যস্ত হয়েছিল দু’টি, অবশ্য যদি সেগুলিকে গুরুতর অপরাধ বলে গণ্য করা যায়। প্রথমটি হল, ইন্দিরা গান্ধীর জনসভায় আলো, মাইক ইত্যাদির ব্যবস্থাপনায় স্থানীয় সরকার সাহায্য করেছিল। দ্বিতীয় অভিযোগ: এক জন সরকারি কর্মচারীকে তাঁর রাজনৈতিক এজেন্ট হিসাবে নিযুক্ত করা হয়েছিল। ওই দু’টি অপরাধের জন্য ছয় বছরের রাজনৈতিক নির্বাসনের রায় শুনে একটি ইংরেজি সংবাদপত্র মন্তব্য করেছিল, এ যেন ট্র্যাফিক আইন ভঙ্গ করার অপরাধে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সমান। পরে সুপ্রিম কোর্ট অন্তর্বর্তী রায় একটু সংশোধন করে ইন্দিরা গান্ধীর সাংসদ অধিকার কেড়ে নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাজ চালিয়ে যেতে অনুমতি দেয়। মাস কয়েক পরেই নির্বাচন, আদালতের এই ‘অবিমৃশ্যকারিতা’ বন্ধ করতে, নিজের আসন পাকা রাখতে ইন্দিরা গান্ধী সংবিধানের সাহায্যেই ঘোষণা করে দেন জরুরি অবস্থা।

ল্য পেন ও ইন্দিরা গান্ধীর কথা একত্রে এল কেন? কেননা, দু’টি ক্ষেত্রেই জনপ্রিয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে লঘু পাপে গুরু দণ্ড দিয়ে তাঁদের রাজনৈতিক জীবন ধ্বংস করার চেষ্টা আছে। ল্য পেনের ক্ষেত্রে পার্টি-নিযুক্ত সহকারীরা কী কাজ করবেন, সে রকম কিছু ঠিক নেই। সেটা বক্তৃতা লেখা, আইনি সাহায্য, দেহরক্ষী, দারোয়ান, যে কোনও কিছুই হতে পারে। তা ছাড়া, এঁরা পার্লামেন্টের বাইরে কোনও রাজনৈতিক কাজে অংশগ্রহণ করতে পারবেন না, এমন কোনও নিষেধাজ্ঞা নেই। যদি তর্কের খাতিরে ধরে নেওয়া যায় এঁরা অন্যায় করেছেন, পার্লামেন্টের আর্থিক ক্ষতি করেছেন, তা হলে তার জন্য জরিমানা হতে পারে, ভবিষ্যতে এ জাতীয় কাজ না করার জন্য সতর্ক করা যেতে পারে। কিন্তু তার বদলে যা হচ্ছে সেটা গুরু দণ্ডই।

ইউরোপে এ-হেন ঘটনা দেখা যায় অনেক। রোমানিয়ায় ২০২৪-এর নভেম্বরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রথম দফায় এগিয়ে থাকেন দক্ষিণপন্থী প্রার্থী কেলিন জর্জেস্কু। ভোট পুনর্গণনার পর ২ ডিসেম্বর আদালত জানাল সব ঠিক আছে, জর্জেস্কুই এগিয়ে। দ্বিতীয় দফা ভোট ঘোষণা হতে পারে। কিন্তু বিধি বাম। এ বার অভিযোগ এল নির্বাচনে আরও গন্ডগোল আছে, রাশিয়ার হস্তক্ষেপ রয়েছে। ইন্টেলিজেন্স দফতর নথিপত্র জমা দিল। তার যথার্থতা বা সত্যতা নিয়ে ওঠা প্রশ্ন খারিজ করে ৬ ডিসেম্বর আদালত বলল, প্রথম দফার পুরো নির্বাচনই খারিজ। শুধু তা-ই নয়, নতুন নির্বাচনে রোমানিয়ার জনপ্রিয় নেতা জর্জেস্কু অংশগ্রহণ করতে পারবেন না। যদিও রোমানিয়ার নির্বাচন সংক্রান্ত সিদ্ধান্তগুলি রোমানিয়ান আদালতের, তবে এর পিছনে ব্রাসেলসের ইউরোপিয়ান কমিশন ও পার্লামেন্টের প্রভাব দেখেন অনেকেই। প্রাক্তন ইউরোপিয়ান কমিশনার নিজেই রোমানিয়ান টেলিভিশনে গর্ব করে বলেছেন, রোমানিয়ার নির্বাচন খারিজে মদত দিয়েছে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন। এবং দরকার পড়লে জার্মানি বা অন্য ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন-ভুক্ত দেশেও একই কাজ করবে।

ইউরোপে এই ধরনের হস্তক্ষেপ বেশ নিয়মিত। এ বিষয়ে গত ১৪ ফেব্রুয়ারি জার্মানিতে মিউনিখ সিকিয়োরিটি কনফারেন্সে আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন আমেরিকার ভাইস-প্রেসিডেন্ট জে ডি ভান্স। বলেছেন, ইউরোপের বিপদের কারণ রাশিয়া বা চিন নয় বা বাইরের শক্তি নয়, ইউরোপের বিপদ তার অন্দরে। কথাটি আক্ষরিক ভাবে সত্য প্রমাণ করতেই, যে শহরে নিরাপত্তা নিয়ে আলোচনায় মিলিত হচ্ছেন ইউরোপ-আমেরিকার রাষ্ট্রপ্রধানরা, তার আগের দিন মিউনিখেই ঘটল সন্ত্রাসী হানা। জানা গিয়েছে, এই সন্ত্রাসীরা বহিরাগত নয়, আশ্রিত আফগান উদ্বাস্তু, উচ্চ নিরাপত্তার বলয়ে ঢাকা মিউনিখ শহরে গাড়ি চালিয়ে ২৮ জনকে গুরুতর আহত করেছে। এর এক মাস আগে জার্মানির আর এক শহরে আর এক আফগান উদ্বাস্তু ছুরি নিয়ে শিশুদের উপর আক্রমণ চালিয়ে এক জনকে হত্যা করে, বেশ কয়েক জন আহত হয়। তার আগে ডিসেম্বরে জার্মানির ম্যাগডেবুর্গ শহরে এক অভিবাসী আরব জনতার মাঝে গাড়ি চালিয়ে ছয় জনকে হত্যা এবং প্রায় ৩০০ জনকে আহত করে।

সুতরাং বাম ও লিবারাল মতাবলম্বীদের কতকগুলি প্রশ্নের উত্তর দিতেই হবে: ইউরোপে কি আজ মুক্তচিন্তা আক্রান্ত? কোথায় তার মৌলিক মূল্যবোধ? কেন দক্ষিণপন্থী হলে বিরোধীদের বাক্‌স্বাধীনতা হরণ করা হয়? এই অভিবাসী ও অনুপ্রবেশকারীরা আসছেন এমন দেশ থেকে যেখানে ন্যূনতম গণতন্ত্র, নারী-স্বাধীনতা, ধর্মীয় উদারতা সহ্য করা হয় না, অথচ ইউরোপীয় উদার গণতন্ত্রের সুযোগ নিয়ে তার পর সেখানেও এমন আক্রমণের পরিবেশ তৈরি করা হচ্ছে। এই ভাবে কি কোনও মুক্ত গণতন্ত্রের দেশে সামাজিক ভারসাম্য রক্ষা করা সম্ভব?

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Paris Paris Saint-Germain PSG Champions League

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy