মন্দারমণির কাঁকড়া বিক্রেতাকে ছুটতে হল রাজস্থানে। ১৩৭ টাকা রোজগারের মাসুল দিতে হল কয়েক হাজার টাকা খরচ করে। সঙ্গে উকিলের পারিশ্রমিক আলাদা। ভদ্রলোকের সবটুকু সঞ্চয় ছিল রাষ্ট্রায়ত্ত একটি ব্যাঙ্কে। হঠাৎই সেই অ্যাকাউন্টে লেনদেন বন্ধ করে দেওয়া হল— যাকে বলে অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ় করা— রাজস্থানের একটি সাইবার ক্রাইমের নোটিসে। তিনি একা নন। কলকাতা ময়দানে লজেন্স বিক্রেতা, উত্তরপ্রদেশের মুদিখানার মালিক, বহু ছোটখাটো ব্যবসায়ীকেই ভুগতে হয়েছে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ় হওয়ার যন্ত্রণায়।
কেন? তাঁদের নামে সাইবার ক্রাইমের মামলাই বা রুজু হল কেন? সাইবার ক্রাইমের আজব আইনের ফলস্বরূপ এই ঘটনাগুলো। ধরুন, কেউ সাইবার প্রতরণা করেছে। তার অ্যাকাউন্টে ঢুকেছে বেশ কিছু টাকা। সে লোকটি এ বার মন্দারমণি গিয়ে কাঁকড়া খেয়ে বিল মিটিয়েছে অনলাইনে। আইন অনুসারে, যে প্রতারণা করেছে সে যেমন দোষী, তেমনই যে যে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে সে পেমেন্ট করেছে, সেই সব অ্যাকাউন্টের মালিককেই অপরাধীর সঙ্গী হিসাবে দেখা হচ্ছে, তাঁদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ় করে আইনি নোটিস পাঠানো হচ্ছে। তার পরে তাঁরা উকিল মারফত এই মামলা মকদ্দমা মেটাতে বাধ্য হচ্ছেন। এই ক্ষেত্রে আরও সমস্যা, ব্যাঙ্ক কোনও রকম সাহায্য করতে পারবে না। শুধু তা-ই নয়, স্থানীয় পুলিশ মারফতও এই সমস্যার সুরাহা হবে না। যে পুলিশ-থানায় অভিযোগ হয়েছে, সেই থানায় গিয়ে সমস্যা মেটাতে হবে। এর পরে কবে অ্যাকাউন্ট থেকে নিষেধাজ্ঞা উঠবে, তারও নিশ্চয়তা নেই। মজার কথা হল, প্রতারকের অ্যাকাউন্ট থেকে কারও অ্যাকাউন্টে ন্যূনতম কত টাকা এলে তাঁকেও অপরাধের দোসর গণ্য করা হবে, তার কোনও নিম্নসীমা নেই— কুড়ি টাকা থেকে কুড়ি হাজার, সব ধরনের লেনদেনের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য এই আইন।
দিল্লি হাই কোর্টে একটি মামলায় দেখা গিয়েছে, মাত্র ২০০ টাকার সন্দেহজনক লেনদেনের কারণে একটি প্রতিষ্ঠানের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট সম্পূর্ণ ভাবে ফ্রিজ় করে দেওয়া হয়েছিল। সেই অ্যাকাউন্টে তখন প্রায় ৯৩ কোটি টাকা ছিল। ফলে ব্যবসার একাধিক চেক বাউন্স করে, কর্মচারীদের বেতন আটকে যায়, জরুরি সরবরাহও বন্ধ হয়ে পড়ে। ব্যবসায়ী অপরাধের সঙ্গে জড়িত ছিলেন না, শুধু এক ক্রেতা প্রতারণার অর্থ দিয়ে পেমেন্ট করেছিলেন। আদালত স্পষ্ট ভাষায় জানায়, এ ভাবে অ্যাকাউন্ট বন্ধ করা মানে কার্যত আর্থিক মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা। এর আগেও একটি মামলায়, মাত্র ১০৫ টাকার সন্দেহে এক ফেরিওয়ালার অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ় করে দেওয়া হয়েছিল, যা আদালতের মতে জীবিকার মৌলিক অধিকারকেও প্রশ্নবিদ্ধ করে।
আইন প্রয়োগে সামঞ্জস্যহীনতা ও অতি-উৎসাহ প্রায়শই নির্দোষ নাগরিকদেরই সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগীতে পরিণত করছে। গত এক বছরে ভারতে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ়ের সংখ্যা উদ্বেগজনক ভাবে বেড়েছে। সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সাইবার জালিয়াতি ও অর্থ পাচারের অভিযোগে প্রায় ৪.৫ লক্ষ অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ় করা হয়েছে। প্রায় ১,৬০০ কোটি টাকা বিভিন্ন ফ্রিজ় হওয়া অ্যাকাউন্টে আটকে আছে, যা ভুক্তভোগীরা সহজে তুলতে পারছেন না। এর ফলে অসংখ্য ব্যবসা ব্যাহত হচ্ছে, শিক্ষার খরচ ও চিকিৎসার বিল মেটানো আটকে যাচ্ছে, এমনকি বহু পরিবার নিত্যপ্রয়োজন মেটাতেও হিমশিম খাচ্ছে। এই পরিসংখ্যান স্পষ্ট করে দেয় আইনের অতিরিক্ত ব্যবহার যেমন অপরাধীদের রুখছে, তেমনই হাজারও নির্দোষ নাগরিককেও অকারণে শাস্তি ভোগ করতে হচ্ছে।
কলকাতার বড় বাজারের বহু ব্যবসায়ী এই সমস্যার মধ্যে পড়েছেন। অনেকেই আদালতের দ্বারস্থ হয়েছেন। এক দিকে যখন ডিজিটাল ইন্ডিয়ার প্রচার চলছে জোরকদমে, সেখানে আইনের এমন তুঘলকি নীতির সমালোচনা করেছেন বিরোধী শিবির থেকে বিশেষজ্ঞরা। এই আইনের প্যাঁচে যে কোনও সময় পড়তে পারেন যে কেউ। প্রয়োজনে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হতে পারে। তবুও এই আইনের সংশোধন নিয়ে কোনও হেলদোল নেই। বিশেষত সমাজের প্রান্তিক স্তরের মানুষরা পড়েছেন ঘোর বিপদে, কেন অ্যাকাউন্ট বন্ধ হচ্ছে সেই কৈফিয়ত দেওয়ার কেউ নেই।
ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ় সংক্রান্ত বর্তমান আইন নানা ত্রুটিতে ভরা, যা আদালতের পর্যবেক্ষণেও উঠে এসেছে। তদন্ত সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই পুরো অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ় করা হয়, ফলে অপরাধী নন এমন ব্যবসায়ী বা সাধারণ গ্রাহকও অসুবিধার সম্মুখীন হচ্ছেন। এই আইন সামঞ্জস্য নীতি মানে না। সন্দেহ যত ক্ষুদ্রই হোক, পুরো অ্যাকাউন্ট অচল হয়ে যায়। এই অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ়ের কোনও নির্দিষ্ট সময়সীমা নেই। নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার প্রক্রিয়া এত জটিল ও দীর্ঘ যে, অনেক সময় মাসের পর মাস ভুক্তভোগীরা নিজস্ব অর্থ ব্যবহার করতে পারেন না। এই সমস্যা থেকে প্রতিকার পাওয়ার জন্য স্বচ্ছ প্রক্রিয়া নেই, যার ফলে মানুষকে অযথা পুলিশ ও ব্যাঙ্কের দোরগোড়ায় ঘুরতে হয়। এই আইনেরকবে সংশোধন হবে? কবে সংসদে কেউ এই আইনের বিরোধিতা করে নতুন বিল পাশ করাতে আবেদন জানাবেন?
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)