E-Paper

তথ্য, বিপণন, জনপ্রিয়তা

প্রথম ভোটকৌশলী সংস্থা হল হুইটেকার অ্যান্ড ব্যাক্সটার, যা কাজ করত ক্যালিফোর্নিয়ায়, ১৯৩০ থেকে ১৯৫০-এর মধ্যবর্তী সময়ে। তবে ‘পলিটিক্যাল কনসালট্যান্ট’ বা ‘রাজনৈতিক পরামর্শদাতা’— এই শব্দবন্ধটির স্রষ্টা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় জোসেফ নাপোলিটান-কে।

অতনু বিশ্বাস

শেষ আপডেট: ২৫ নভেম্বর ২০২৫ ০৭:০২
পরাজিত: সাংবাদিক সম্মেলনে উপস্থিত প্রশান্ত কিশোর। পটনা, ১৮ নভেম্বর।

পরাজিত: সাংবাদিক সম্মেলনে উপস্থিত প্রশান্ত কিশোর। পটনা, ১৮ নভেম্বর। ছবি: পিটিআই।

জন সুরাজ পার্টি একেবারে মুখ থুবড়ে পড়ল বিহারের নির্বাচনে। সেই বিপর্যয় সত্ত্বেও, রাজনৈতিক পরামর্শদাতা হিসাবে পরিচিত এবং সফল প্রশান্ত কিশোরের এ বারের ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে নেমে পড়া একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা— কারণ, রাজনীতিকরা ভোট জেতান, না কি ভোটকৌশলীরা, এই প্রশ্ন অনেক পুরনো।

১৮৯৭ থেকে ১৯০১ অবধি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ছিলেন উইলিয়াম ম্যাকিনলে। তাঁর ঘনিষ্ঠতম রাজনৈতিক উপদেষ্টা মার্ক হান্নাকে অনেকে বলেন প্রথম রাজনৈতিক পরামর্শদাতা। প্রথম ভোটকৌশলী সংস্থা হল হুইটেকার অ্যান্ড ব্যাক্সটার, যা কাজ করত ক্যালিফোর্নিয়ায়, ১৯৩০ থেকে ১৯৫০-এর মধ্যবর্তী সময়ে। তবে ‘পলিটিক্যাল কনসালট্যান্ট’ বা ‘রাজনৈতিক পরামর্শদাতা’— এই শব্দবন্ধটির স্রষ্টা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় জোসেফ নাপোলিটান-কে। আমেরিকায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জন এফ কেনেডি আর লিন্ডন জনসনের প্রচারের মাথা ছিলেন নাপোলিটান। আমেরিকান রাজনীতিতে ১৯৬৮ সালে হুবার্ট হামফ্রে-র নাটকীয় উত্থানেরও কারিগর তিনি। তাঁর ১৯৭২ সালের বই দি ইলেকশন গেম অ্যান্ড হাউ টু উইন ইট-এ নেপোলিটান বলছেন, ভোটের প্রচারের ‘খেলা’য় জিততে প্রয়োজন উপযুক্ত কৌশল আর তার বাস্তবায়ন। যে কৌশল সুপারমার্কেট বা টুথপেস্টের বিপণনের থেকে অনেকটাই আলাদা।

কার্যকর রাজনৈতিক প্রচারে টেলিভিশনের প্রভাবের উপরে জোর দিয়েছিলেন নেপোলিটান। সে সময়কার মানদণ্ডে যা ছিল সুপ্রযুক্ত। আজ যখন আমরা সোশ্যাল মিডিয়ার জগতে হাবুডুবু খেতে খেতে হঠাৎই জেনারেটিভ এআই বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দুনিয়ায় ঢুকে পড়েছি, তখন রাজনৈতিক পরামর্শের এই ‘গেম’টার গতিশীলতাও বদলে যাচ্ছে নাটকীয় ভাবে। এ ছাড়াও এই সহস্রাব্দের শুরুতে ঘটে গিয়েছে একটা সাংস্কৃতিক বিপ্লব— ‘বিগ ডেটা’র ব্যবহার। মাইকেল ল্যুইস-এর ২০০৩ সালের বই মানিবল দেখিয়েছে, কী ভাবে আমেরিকান বেসবল দল ওকল্যান্ড অ্যাথলেটিক্স-এর ম্যানেজার বিলি বিন অল্প বাজেট সত্ত্বেও মেজর লিগ বেসবলে সাফল্য পাওয়ার মতো দল গড়তে পেরেছিলেন শুধু পুরনো তথ্য বিশ্লেষণ করে। ‘বিগ ডেটা’ বা প্রচুর পরিমাণ তথ্যকে কাটাছেঁড়া করে স্ট্র্যাটেজি তৈরির এই ‘মানিবল’ সংস্কৃতি এখন ছড়িয়ে পড়েছে জীবনের প্রতিটা ক্ষেত্রেই। রাজনীতি কি আর তার বাইরে থাকতে পারে?

মানতেই হবে, ভোটকৌশলীরা আজ নির্বাচনী প্রচারের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। কিন্তু নির্বাচনে জয়ের প্রধান উপাদান কী? নেতাদের ক্যারিশমা এবং দলগুলির সংগঠন? না কি, এই ভোটকৌশলীরা পরশপাথরের মতো— যা ছোঁন, তাতেই সোনা ফলে? না কি, এটা উভয়ের সুষম সমন্বয়ের ফসল?

২০০৮ এবং ২০১২-র আমেরিকার ভোটে বারাক ওবামার নির্বাচন দুনিয়ার প্রথম দিকের ‘মানিবল’ নির্বাচনগুলির অন্যতম। ওবামা-র প্রচার-দল দেশব্যাপী প্রচার চালিয়েছিল একটা স্থানীয় নির্বাচনের স্টাইলে— প্রতিটি সম্ভাব্য ভোটারের অজস্র ব্যক্তিগত তথ্যকে তথ্যভান্ডারে ঢুকিয়ে ভোটারের চাহিদা বোঝার চেষ্টা চলে। চেষ্টা করা হয় সমাধানের। প্রচুর তথ্য নিংড়ে কৌশল তৈরির এই সংস্কৃতি শিগগিরই যে নির্বাচনী সংস্কৃতির অচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে উঠবে দুনিয়ার সর্বত্র, তাতে আর আশ্চর্য কী! ২০১৬-র প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী হিলারি ক্লিন্টনের প্রচারে ব্যবহৃত হয় সফটওয়্যার ‘আডা’— যার সাহায্যে করা হয় প্রচুর তথ্যের বিশ্লেষণ এবং সিমুলেশন। কিন্তু ট্রাম্পের কাছে তো হারলেন ক্লিন্টন। বোঝা গেল, ভোটকৌশলীর তথ্য-নিংড়ানো কৌশল আদৌ প্রফেসর শঙ্কুর ‘মিরাকিউরল’ বড়ি নয়।

আজকের রাজনৈতিক পরামর্শদাতারা প্রচুর সমীক্ষা চালান ভোটারদের চাহিদা বুঝতে। সঙ্গে থাকে প্রতিটি নির্বাচনী এলাকার পোল-বুথ ডেটা এবং ভোটের ধরন পরিবর্তনের তথ্যও। ব্যবহার করা হয় ডেটা মাইনিং আর রাশিবিজ্ঞানের বেশ কিছু বিশ্লেষণ-কৌশল। সমীক্ষাগুলির এবং বিশ্লেষণের গুণমান অবশ্যই সমান নয়, এবং প্রায়শই অজানা।

ভারতের জনগণ অবশ্যই জাতি, ধর্ম, স্থানীয় ও বিভিন্ন আঞ্চলিক কারণ, এবং কিছু নেতার ক্যারিশমার ভিত্তিতে ভোট দেন। কিন্তু আমাদের জটিল সমাজে ভোটের ধরনের কোনও নির্দিষ্ট ‘টেমপ্লেট’ নেই— প্রতিটি নির্বাচনী এলাকার গল্পই আলাদা। অনেক ভোটকৌশলী প্রায়শই তৈরি করেন প্রচুর চার্ট আর ডায়াগ্রাম, এবং বার করেন কিছু মৌলিক পরিসংখ্যানগত বৈশিষ্ট্য, মাইক্রো-টার্গেটিংকে কেন্দ্র করে। ২০১৯-এর বই হাউ টু উইন অ্যান ইন্ডিয়ান ইলেকশন-এ আই-প্যাক’এর ভূতপূর্ব কর্মী শিবম শঙ্কর সিংহ লিখছেন যে, গ্রাফিক্স তৈরি এবং ইভেন্ট আয়োজন সৃষ্টি করে একটা ‘বাজ়’ বা ‘গুঞ্জন’— নির্বাচনের জন্য একটা ভিন্নতর পরিবেশ।

তবে, ভোটকৌশলীরা কি সত্যিই রাজনৈতিক দল বা রাজনীতিবিদদের ‘বিক্রি’ করতে পারেন ভোটারদের কাছে, ঠিক যেমন ভাবে বিপণন হয় টুথপেস্টের? কিছুটা হয়তো পারেন। ডোনাল্ড ট্রাম্প তো তাই ভেবেছেন। নেপোলিটান কিন্তু বিশ্বাস করতেন, ভোটপ্রার্থীদের ‘বিক্রি’ করার ধারণাটিই ভুল। তাঁর মতে, যে সব প্রার্থীর ব্যক্তিত্ব এবং দৃষ্টিভঙ্গি দর্শক আর শ্রোতাদের সঙ্গে মুহূর্তে একাত্মতা তৈরি করতে পারে, জয়ী হন তাঁরাই।

তথ্য ও তার বিশ্লেষণ-ভিত্তিক কৌশল হয়তো কখনও কয়েক শতাংশ ভোট বাড়িয়ে দিতে পারে— অবশ্যই যদি প্রতিপক্ষেরও কোনও দক্ষ তথ্য-বিশ্লেষক ভোটকৌশলী দল না থাকে। কিন্তু, আজ তো প্রতিটি প্রধান রাজনৈতিক দলই ডেটা সায়েন্স আর ভোটকৌশলীদের উপরে নির্ভরশীল। আজকের দুনিয়ায় কোনও রাজনৈতিক দল যদি তাদের নির্বাচনী পরিকল্পনা তৈরিতে ভোটকৌশলীদের ব্যবহার না করে, সেটাই আশ্চর্যের। ঠিক যেমন কোনও বড় ফুটবল কিংবা ক্রিকেট দলে ডেটা সায়েন্টিস্ট না থাকাটাই আজ অবাস্তব। অবশ্য প্রশান্ত কিশোরের মতো ডাকসাইটে ভোটকৌশলীরও ব্যর্থতার গল্প রয়েছে— ২০১৭-য় উত্তরপ্রদেশে কংগ্রেসের হয়ে কাজ করেছিল তাঁর সংস্থা, এবং কংগ্রেস হেরেছিল। তাই ভোটকৌশলীদের নিয়োগ করলে বড়সড় লাভ নাও হতে পারে আজ— কিন্তু নিয়োগ না করলে বড় ক্ষতির সম্ভাবনা। দুই প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বীর মধ্যে এক জনকে তো হারতেই হবে, জবরদস্ত ভোটকৌশলীর সাহায্য নেওয়া সত্ত্বেও। তা হলে কি এটা আংশিক ভাবে দু’দল ভোটকৌশলীর লড়াই? না কি, লড়াইটা মূলত রাজনৈতিক নেতাদের মনমোহিনী ক্ষমতার?

‘মানিবল’-এর প্রেক্ষাপটে তৈরি হয়েছিল ‘সাবারমেট্রিক্স’ শব্দটি, যা নির্দেশ করে বস্তুনিষ্ঠ পরিসংখ্যানগত পরিমাপের উপর ভিত্তি করে খেলোয়াড়দের পারফরম্যান্সের অভিজ্ঞতালব্ধ বিশ্লেষণ। শেলডন এবং অ্যালান হির্শ কিন্তু তাঁদের ২০১১-র বই দ্য বিউটি অব শর্ট হপস-এ যুক্তি দিয়েছেন যে, বেসবলের অসাধারণ, অপরিমেয়, তাৎক্ষণিক উদ্ভাবনী গুণমানের সঙ্গে ‘সাবারমেট্রিক্স’-এর কোনও সম্পর্ক নেই। তথ্য ও তার বিশ্লেষণ নিঃসন্দেহে প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা অর্জনের একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হতে পারে, কিন্তু তা হতে পারে না জাদুদণ্ড। ভুললে চলবে না, তথ্য-নিংড়ানো কৌশলকে অর্থহীন করে দিতে পারেন এক জন লিয়োনেল মেসি বা বিরাট কোহলি।

সেই সঙ্গে নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ কৌশল হয়ে উঠতে পারে বিচক্ষণ বিচার এবং কার্যকর ব্যবস্থাপনা। এরই অঙ্গ হল ‘অব কি বার মোদী সরকার’, ‘পঞ্জাব দা ক্যাপ্টেন’ বা ‘বাংলা নিজের মেয়েকে চায়’-এর মতো দুর্দান্ত রাজনৈতিক স্লোগান, কিংবা বিরোধী কোনও নেতার কোনও অগোছালো কাজ বা আলগা মন্তব্যের সুযোগ নেওয়া। আমার বিশ্বাস, বেশির ভাগ নির্বাচনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কৌশলই পরিচালিত হয় ‘প্রজ্ঞা’ এবং এর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত দক্ষ ব্যবস্থাপনা দ্বারা। এ ক্ষেত্রে তথ্যের ভূমিকা তুলনায় কম গুরুত্বপূর্ণ। ‘সুদক্ষ’ তথ্য-বিশ্লেষণের ভূমিকা হয়তো আরও কম।

আসলে যে কোনও ‘কন্যা’ বা ‘ক্যাপ্টেন’ই তো আর বিজয়-সূচক ট্যাগলাইনের কেন্দ্রবিন্দু হতে পারেন না— স্লোগানটা যতই চটকদার হোক না কেন। ভোটে ম্যাজিক দেখানোর জন্য, এবং হয়তো বা ভোটকৌশলীদের জয়সূচক কৌশল তৈরির জন্যও, প্রয়োজন কোনও এক নরেন্দ্র মোদী, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, অথবা এম কে স্ট্যালিনকে— এবং সেটাও অনুকূল রাজনৈতিক পরিবেশে। বিহার দেখাল, তেমন কোনও নেতার জাদু-স্পর্শ না থাকলে ভোটকৌশলীদের কৌশল ফেল করতেই পারে।

রাশিবিজ্ঞান বিভাগ, ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট, কলকাতা

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Bihar Assembly Election 2025 Prashant Kishor Jan Suraaj Party election strategies

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy