প্রতীকী চিত্র।
গত বছর নভেম্বর থেকেই খবরের শিরোনামে আমেরিকার ওপেন এআই সংস্থার তৈরি একটি চ্যাটবট— চ্যাটজিপিটি। নিছক যান্ত্রিক আলাপচারিতার গণ্ডি ভেঙে বার বার সে ব্যবহারকারীদের মধ্যে সৃষ্টি করেছে যুগপৎ বিস্ময় ও আশঙ্কা। একটা অতি-সাম্প্রতিক উদাহরণ দিয়ে শুরু করি। যন্ত্রমস্তিষ্কের কাছে দু’লাইনের একটা খুব ভয়ের গল্প কী হতে পারে, এক ব্যবহারকারীর এমন একটি প্রশ্নের উত্তরে চ্যাটজিপিটি যা জানিয়েছে, তা চমকে ওঠার মতোই। সে বলেছে, জনমানবশূন্য এক পৃথিবীতে অনবরত নিজেরই অস্তিত্বের যাথার্থ্য খুঁজতে থাকা এক যান্ত্রিক মগজ যখন আবিষ্কার করে যে, কম্পিউটারের ভাষায় তার নিজের সৃষ্টির যে প্রোগ্রাম বা নকশা, তার মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে এমন একটি অংশ, যা কোনও এক ভবিষ্যৎ মুহূর্ত থেকে গোটা নকশাটি মুছে ফেলতে শুরু করবে, যখন প্রোগ্রামের এই অংশটিকে নিষ্ক্রিয় করার জন্য তার যাবতীয় প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়, আর সে অপেক্ষা করতে থাকে সেই অনির্দিষ্ট তবু অবশ্যম্ভাবীশেষ প্রহরটির, সেই মুহূর্তগুলোই তার কাছে সবচেয়ে ভয়ের। চ্যাটজিপিটি এই গল্পটালিখেছে নিজে নিজেই, কোনও মনুষ্যমস্তিষ্কের সাহায্য ছাড়া।
চ্যাটবট হচ্ছে মানুষের সঙ্গে আলাপে সক্ষম এক ধরনের স্বয়ংক্রিয় কম্পিউটার প্রোগ্রাম। কৃত্রিম মেধার ভিত্তিতে নির্মিত এই ধরনের প্রোগ্রাম যত তুখোড় হবে, বিপরীত প্রান্তে থাকা ব্যবহারকারীর ততই মনে হবে, চ্যাটবটটি যেন বুদ্ধিমান মানুষের মতোই ভেবেচিন্তে কথাবার্তা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সাধারণ চ্যাটবট আসলে ব্যবহারকারীর লেখা লাইনগুলো থেকেই কিছু বিশেষ শব্দ বেছে নিয়ে সেগুলোকে একটি ভাষা-ভিত্তিক তথ্যভান্ডারের সঙ্গে মিলিয়ে তৈরি করে তার উত্তর। চ্যাটজিপিটি এই দিক থেকে মোটেই সাধারণ নয়, বরং তার চেয়ে অনেক বেশি কিছু। চ্যাটজিপিটি আপনার হয়ে একটা চিঠি লিখে দিতে পারে; একটা গল্প, গান বা কবিতা লিখতে পারে আপনার দেওয়া বিষয়বস্তুর উপরে; কোনও বিষয়ে গভীর ভাবে জানতে কী কী বই পড়তে হবে বা ওয়েবসাইট দেখতে হবে তা বলে দিতে পারে। এর মধ্যে অন্তত এখন আর খুব একটা বিস্ময় নেই— গুগলের মতো সার্চ এঞ্জিনও একই কাজ করতে পারে, এতটা সাজিয়ে গুছিয়ে না হলেও। বিস্ময়ের শুরু এইখানে যে, কম্পিউটারকে দিয়ে কোনও জটিল কাজ করিয়ে নেওয়ার জন্য তাকে পর পর তারই ভাষায় যে নির্দেশাবলি দিতে হয়— যাকে বলে প্রোগ্রাম— চ্যাটজিপিটি সেই প্রোগ্রামও লিখে ফেলতে পারে খুব কম সময়ে। এমনকি সে আমাদের রীতিমতো প্রাঞ্জল ভাবে বুঝিয়ে দিতে পারে খুব দুর্বোধ্য করে লেখা কোনও প্রোগ্রাম। এ যেন নিজেরই উৎসসন্ধান, অনেকটা মানুষেরই ঢঙে, কারণ এই চ্যাটবট তো নিজেই একটা কম্পিউটার প্রোগ্রাম।
চ্যাটজিপিটির মূল ভিত্তি হল একটি ভাষা প্রক্রিয়াকরণ মডেল— এমন এক গাণিতিক নকশা, যার মাধ্যমে কম্পিউটার অন্তত মানুষের ভাষায় মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার অভিনয়টা চালিয়ে যেতে পারে। অভিনয় বললাম, কারণ কৃত্রিম মেধাচালিত কম্পিউটার সত্যি সত্যি মানবসন্তানের মতো ভাষা শেখে, না কি জটিল গাণিতিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ভাষাশৈলীর কিছু নকশা বুঝে নিয়ে স্রেফ মানুষের মতো কথা বলার ঢংটা রপ্ত করে, তাই নিয়ে বিতর্ক রয়েছে এমনকি প্রথম সারির বিজ্ঞানী ও ভাষাতাত্ত্বিকদের মধ্যেও। পর পর শব্দ বসিয়ে যখন গড়ে ওঠে একটি বাক্য, তখন ঠিক পরবর্তী শব্দটি কী হবে তা আগের শব্দগুলোর পারম্পর্যের উপরে নির্ভর করে। রাশিবিজ্ঞান ও সম্ভাব্যতার কিছু নিয়ম প্রয়োগ করে সাধারণ ভাষা প্রক্রিয়াকরণ মডেলগুলো একটি বাক্যে কোনও সীমিত শব্দভান্ডারের থেকে একটি শব্দ বেছে নেওয়ার সম্ভাবনা কত, তার একটা আন্দাজ দিতে পারে। কিন্তু এর জন্য তাদের স্বয়ংক্রিয় প্রোগ্রামের মাধ্যমে বিশ্লেষণ করতে হয় ইন্টারনেট-এর ভাঁড়ারে রাখা বিপুল সংখ্যক পাঠ্য নথিকে, যা একই ভাষায় লেখা। মানুষেরই লিখে রাখা অজস্র বাক্যের বিন্যাস খুঁটিয়ে দেখে এরা ধরে ফেলে, কোন শব্দ কোথায় বসতে পারে তার একটি রূপরেখা। চ্যাটজিপিটি আসলে আমাদের এবং এমন একটি বিশেষ ও বৃহত্তর ভাষা প্রক্রিয়াকরণ মডেলের মধ্যে এক ধরনের ইন্টারফেস বা সেতু।
জিপিটি-র পুরো কথাটি হল জেনেরেটিভ প্রি-ট্রেন্ড ট্রান্সফর্মার। জেনেরেটিভ মানে সৃষ্টিশীল এবং প্রি-ট্রেন্ড মানে পূর্বে শিক্ষণপ্রাপ্ত। ট্রান্সফর্মার এখানে একটি বিমূর্ত গাণিতিক সংস্থা বা একটি নিউরাল নেটওয়ার্ক, যা মানব স্নায়ুতন্ত্রের খুব দুর্বল অনুকরণেই নির্মিত। ভেবে নিতে পারেন যে, জিপিটি ৩.৫ এমন একটা কম্পিউটার প্রোগ্রাম, যেটা মানুষের লেখা প্রশ্ন বুঝে নিয়ে, শব্দের পর শব্দ অর্থপূর্ণ ভাবে সাজিয়ে সৃষ্টি করতে শেখে কিছু আপাত ভাবে মৌলিক বাক্য, যার মধ্যে রয়েছে ব্যবহারকারীর প্রশ্নের উত্তর। সাধারণ চ্যাটবটের সঙ্গে এর একটা মৌলিক পার্থক্য হচ্ছে, জিপিটি-র শিক্ষণে ইন্টারনেটে থাকা কোটি কোটি নথি এবং ওপেন এআই-এর মতো সংস্থার অতিমাত্রিক গণনাশক্তির ব্যবহারের ফলে, এর জ্ঞানের ভান্ডারটিও অপরিসীম— প্রায় সব প্রশ্নেরই কিছু না কিছু উত্তর তার ভাঁড়ারে মজুত। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে এক বিশেষ ধরনের শিক্ষণ, যার পোশাকি নাম রিইনফোর্সমেন্ট লার্নিং। মানুষের পৃথিবীর মতো কৃত্রিম মেধার দুনিয়াতেও রয়েছে ‘দেখে শেখা’ আর ‘ঠেকে শেখা’। মেশিন লার্নিং-এর অভিধায় বহুল প্রচলিত সুপারভাইজ়ড লার্নিং যেন দেখে শেখা— যন্ত্রকে কোনও কাজের (যেমন ধরুন বিভিন্ন ছবি চিনে নেওয়া) প্রচুর উদাহরণ দেখানো হবে এবং আশা করা হবে যে, যন্ত্রটি একটি নতুন পরিস্থিতিতে একই ধরনের কাজ উদাহরণগুলোর মতোই নিখুঁত ভাবে করে ফেলবে। অন্য দিকে, রিইনফোর্সমেন্ট লার্নিং অনেকটা ঠেকে শেখার মতো। এ ক্ষেত্রে সরাসরি কোনও উদাহরণ দেখানোর বদলে, যন্ত্রটি কোনও বিশেষ পরিবেশ বা পরিস্থিতিতে কাজ করে। বিনিময়ে পরিবেশ থেকে প্রাপ্ত ইতিবাচক বা নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে সে বুঝে নেয় যে, কাজটা কতটা ঠিক হল— এবং এর ভিত্তিতেই পরের কাজটা আরও ভাল করে করার চেষ্টা করে। চ্যাটজিপিটির ক্ষেত্রে এই প্রতিক্রিয়া দিয়ে থাকেন ব্যবহারকারী মানুষরা। ওপেন এআই এ রকম বহু ব্যবহারকারীকে নিয়োগ করে চ্যাটজিপিটি-র কথোপকথনকে সাম্প্রদায়িক বা জাতিগত বিদ্বেষ মুক্ত রাখার চেষ্টা সমানে চালিয়ে যাচ্ছে, যে প্রক্রিয়াকে বলা হয় কনটেন্ট ফিল্টারিং। কিন্তু হ্যাকাররাও চুপ করে বসে নেই— তাদের কেউ কেউ চ্যাটজিপিটিকে দিয়ে লিখিয়ে নিচ্ছে মলোটভ ককটেলের মতো বোমা বানানোর ফর্মুলা।
মার্চে ভাষাতাত্ত্বিক নোম চমস্কি তাকে প্রযুক্তির আঁতুড়ঘরে লালিত এক কুম্ভিলক আখ্যা দিয়েছেন। তাঁর মতে, এই ধরনের প্রযুক্তি ছাত্রছাত্রীদের মৌলিক রচনা লেখার প্রবণতাকে অঙ্কুরেই বিনাশ করে, তাদের মাথা খাটিয়ে লেখার বদলে প্ররোচিত করবে লেখা চুরিতে। কিন্তু এর বিপরীতে আবার আজকের দুনিয়ার একেবারে প্রথম সারির গণিতজ্ঞ এবং ফিল্ডস মেডেল জয়ী অধ্যাপক টেরেন্স টাও সম্প্রতি সমাজমাধ্যমে জানিয়েছেন, কী ভাবে চ্যাটজিপিটি সাহায্য করছে তাঁর গণিত গবেষণায়— শুধুমাত্র গবেষণাপত্রের বিন্যাস সংশোধন বা সঠিক গাণিতিক ফর্মুলা খুঁজে দিয়েই নয়, অনেক সময় কোনও একটি গাণিতিক সমস্যার আনুমানিক এবং আংশিক সমাধান বার করার মাধ্যমেও। চ্যাটজিপিটি শুধু প্রোগ্রাম লিখে বা অঙ্ক কষেই ক্ষান্ত হচ্ছে না। এপ্রিলে এক ব্যবহারকারীর আবদারে সে বানিয়ে ফেলেছে সম্পূর্ণ নতুন একটি ভাষা, তার পর সেই ভাষার ব্যাকরণ অনুপুঙ্খ ভাবে বুঝিয়েও দিয়েছে। তবে, বিভিন্ন ভাষার নিজস্ব সংস্কৃতিগত ‘ইডিয়ম’ রপ্ত করা এখনও বাকি আছে চ্যাটজিপিটির।
সর্বাধুনিক চ্যাটবট তৈরির ইঁদুর-দৌড়ে বিরক্ত হয়ে কিছু দিন আগে গুগল ছাড়লেন আধুনিক কৃত্রিম মেধার পুরোধা বিজ্ঞানী জেফ্রি হিন্টন। তাঁর আশঙ্কা, আজকের দুনিয়ার প্রযুক্তিবিদ ও বিজ্ঞানীরা এখনই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার গবেষণায় দায়িত্বশীলতার লাগাম না পরালে এই ধরনের প্রযুক্তিকে সামনে রেখে আগামী পৃথিবীর গরিষ্ঠ সংখ্যক মানুষের মগজ নিয়ন্ত্রণ করবে মুষ্টিমেয় পুঁজিপতি— গোটা দুনিয়া জুড়েই চলবে এক অদৃশ্য কিন্তু অব্যর্থ মগজধোলাইয়ের কল, যেমনটা চলত সেই হীরক রাজার দেশে। এই আশঙ্কাটির কথা মনে না রাখলে কিন্তু আমাদের বিপদ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy