Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪
সাম্যের ধারণাটি উল্টে গেল
Reservation

আর্থিক ভাবে দুর্বল হলেই কি সংরক্ষণের সুবিধা পাওয়া যায়?

২০২২ সালের ৭ নভেম্বর, সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ সদস্যের সাংবিধানিক বোর্ড ৩:২ সংখ্যাগরিষ্ঠ রায়ে সংবিধানের ১০৩তম সংশোধনীকে বজায় রাখার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করল।

শমীক সেন
শেষ আপডেট: ১৪ নভেম্বর ২০২২ ০৬:৫৩
Share: Save:

গঙ্গাচরণ চক্রবর্তীর কথা মনে পড়ে? অশনি সংকেত (১৯৭৩) ছবিতে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় অভিনীত এই দরিদ্র ব্রাহ্মণ চরিত্রের আঁকড়ে ধরার মতো খড়কুটো ছিল মাত্র দুটো— এক, তার শিক্ষা ও দেশদুনিয়া সম্বন্ধে খানিক ভাসাভাসা ধারণা; এবং দুই, তার জাতিপরিচয়। জাগতিক যন্ত্রণা ও সমস্যাকে অতিক্রম করে যেতে পারে যে পরিচিতির জোর।

২০২২ সালের ৭ নভেম্বর, সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ সদস্যের সাংবিধানিক বোর্ড ৩:২ সংখ্যাগরিষ্ঠ রায়ে সংবিধানের ১০৩তম সংশোধনীকে বজায় রাখার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করল। বর্তমান সংরক্ষণ ব্যবস্থার আওতায় আসেন না, এমন জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে পড়া অংশের জন্য (ইকনমিক্যালি উইকার সেকশনস অব দ্য সোসাইটি, সংক্ষেপে ইডব্লিউএস) এই সংশোধনীর মাধ্যমে ১০ শতাংশ সংরক্ষণের ব্যবস্থা হয়েছে। অর্থাৎ, এই ১০% সংরক্ষণ সেই দরিদ্রদের জন্য, যাঁরা তথাকথিত ‘জেনারেল ক্যাটেগরি’র অন্তর্ভুক্ত, কারণ তফসিলি জাতি, জনজাতি ও অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির ‘নন ক্রিমি লেয়ার’-ভুক্ত জনগোষ্ঠীর মানুষ ইতিমধ্যেই সংরক্ষণ নীতির অন্তর্ভুক্ত। বিচারপতি মাহেশ্বরী, ত্রিবেদী ও পারদিওয়ালা তাঁদের পৃথক সহমত রায়ে জানিয়েছেন যে, এই সংশোধনী সাংবিধানিক ভাবে বৈধ। অন্য দিকে, বিচারপতি ভট্ট ও সদ্যপ্রাক্তন প্রধান বিচারপতি ললিত এই সংশোধনীকে অসাংবিধানিক মনে করেছেন— তাঁরা জানিয়েছেন যে, এই সংশোধনীটি বাতিল করা উচিত, কারণ তা সংবিধানের মৌলিক কাঠামোকে লঙ্ঘন করে।

যদিও সংবিধানের সূচনালগ্নেই ১৬(৪) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছিল, সরকারি কর্মক্ষেত্রে যে জাতিভিত্তিক জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব ঐতিহাসিক ভাবে কম, তাদের জন্য সংরক্ষণের মাধ্যমে প্রতিনিধিত্ব বাড়ানো যেতে পারে, কিন্তু গোড়ায় শিক্ষার মতো অন্যান্য ক্ষেত্রে তেমন কোনও সংরক্ষণের ব্যবস্থা ছিল না। সরকারি চাকরি এবং স্কুলে জাতিভিত্তিক সংরক্ষণের বিষয়ে মাদ্রাজ প্রদেশের একটি সরকারি নির্দেশ সুপ্রিম কোর্ট নাকচ করে দেওয়ার প্রতিক্রিয়াতেই সংবিধানে ১৫(৪) অনুচ্ছেদটি যোগ করা হয়। সেই স্টেট অব মাদ্রাজ বনাম চম্পকম দোরাইরাজন মামলায় সুপ্রিম কোর্ট সংবিধানের ৪৬ অনুচ্ছেদকে বিবেচনা করতে অস্বীকার করে। সেই অনুচ্ছেদটি ‘ডাইরেক্টিভ প্রিন্সিপলস অব স্টেট পলিসি’-র অন্তর্গত, যাতে বলা হয়েছিল যে, রাষ্ট্র “বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে সমাজের দুর্বলতর অংশের শিক্ষাগত ও আর্থিক স্বার্থ রক্ষা করবে, এবং বিশেষত তফসিলি জাতি ও জনজাতিভুক্ত মানুষকে... সামাজিক অন্যায় ও যাবতীয় বঞ্চনা থেকে রক্ষা করবে।” অতঃপর, ১৯৫১ সালে ১৫(৪) অনুচ্ছেদটি সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত হয়, যা রাষ্ট্রকে বিশেষ ব্যবস্থা করার (তার মধ্যে অবশ্যই সামাজিক ও শিক্ষাগত ভাবে পিছিয়ে পড়া শ্রেণির নাগরিকদের— সোশ্যালি অ্যান্ড এডুকেশনালি ব্যাকওয়ার্ড ক্লাসেস বা সংক্ষেত্রে এসইবিসি— এবং তফসিলি জাতি ও জনজাতিভুক্ত মানুষদের জন্য সংরক্ষণও পড়ে) অনুমতি দেয়।

অর্থাৎ, সংবিধানের ১৫(৪) অনুচ্ছেদ যে পশ্চাৎপদতার কথা বলছে, তা সামাজিক ও শিক্ষাগত— ভারতের তৎকালীন নীতিনির্ধারকরা বহু যুগের শোষণ, বঞ্চনা ও আনুষঙ্গিক অন্যায়ের প্রতিকার করার পথ হিসাবে এই মাপকাঠিটিকেই বেছে নিয়েছিলেন। পরবর্তী কালেও পশ্চাৎপদতার এই মাপকাঠিই ব্যবহৃত হয়েছিল, যখন ৯৩তম সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে কেবলমাত্র সংখ্যালঘু প্রতিষ্ঠান ব্যতীত (সংবিধানে যাদের স্বশাসনের অধিকার স্বীকৃত) অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একই গোত্রের সংরক্ষণের ব্যবস্থা করার জন্য ১৫(৫) অনুচ্ছেদটি সংবিধানের অন্তর্গত হয়। এই ধরনের সংরক্ষণের লক্ষ্য ছিল নির্দিষ্ট জাতিগোষ্ঠীর অন্তর্গত মানুষরা, শুধুমাত্র কোনও নির্দিষ্ট জাতিভুক্ত পরিবারে জন্মগ্রহণের কারণে যাঁদের মানুষ হিসাবে সম্পূর্ণ বিকাশের পথটি বন্ধ। মনে রাখা প্রয়োজন, এই ‘গোষ্ঠীগত পশ্চাৎপদতা’, যা যে কোনও অ্যাফার্মেটিভ অ্যাকশনের ভিত্তি, তাকে দারিদ্রের মতো অন্য কোনও অস্থায়ী অসুবিধার সঙ্গে জুড়ে দেখা যায় না। তা ছাড়াও, দারিদ্র ব্যক্তিনির্ভর, গোষ্ঠীনির্ভর নয়— যেখানে জাতিগত বৈষম্য হয় গোষ্ঠীর প্রতি, এবং তার ফল হিসাবে ব্যক্তির প্রতি।

সুপ্রিম কোর্টের সামনে বারে বারেই একটি দার্শনিক প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে— সংরক্ষণ ও অন্যান্য অ্যাফার্মেটিভ অ্যাকশন কি ভারতের সংবিধানে বর্ণিত সাম্য ও বৈষম্যহীনতার দর্শনের পরিপ্রেক্ষিতে একটি ব্যতিক্রম? প্রথম দিকে সুপ্রিম কোর্ট এই প্রশ্নের উত্তরে জানাত, হ্যাঁ। এবং, এটি যে ব্যতিক্রম, সেই ধারণা থেকেই সংরক্ষণের ক্ষেত্রে ৫০ শতাংশের ঊর্ধ্বসীমার ব্যবস্থা হয়, যা পরবর্তী কালে সংরক্ষণ বিষয়ক যাবতীয় মামলার একেবারে কেন্দ্রে থেকেছে, বর্তমান মামলাটিরও। ১৯৭৫ সালে স্টেট অব কেরল বনাম এন এম টমাস মামলায় সুপ্রিম কোর্টের অবস্থানে একটি তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন ঘটে। চার বিচারপতি তাঁদের সংখ্যাগরিষ্ঠ রায়ে জানান যে, সুযোগের সাম্যের প্রশ্নে সংরক্ষণ কোনও ব্যতিক্রম নয়, বরং তা সাম্যের নীতির এক ‘প্রবল পুনরুক্তি’। স্বাভাবিক ভাবেই, তার পর থেকে ৫০ শতাংশের ঊর্ধ্বসীমাকে আর অলঙ্ঘ্য বলে গণ্য করার কারণ থাকে না, এবং পশ্চাৎপদতার ভিত্তি হিসাবে গোষ্ঠীগত বঞ্চনাই বিবেচ্য হিসাবে স্বীকৃত হয়।

মণ্ডল কমিশন মামলায় সুপ্রিম কোর্টের নয় বিচারপতির বেঞ্চ অ্যাফার্মেটিভ অ্যাকশনের ক্ষেত্রে গোষ্ঠীগত বঞ্চনাতেই ভিত্তি হিসাবে বিবেচনা করার দার্শনিক অবস্থানটিকে বজায় রাখে, কিন্তু সাধারণ নীতি হিসাবে ৫০ শতাংশের ঊর্ধ্বসীমার ধারণাটিকে ফিরিয়ে আনে। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে, ভারত সরকারের দু’টি অফিস মেমোরেন্ডা আদৌ সাংবিধানিক ভাবে বৈধ কি না— একটি বিশ্বনাথপ্রতাপ সিংহের নেতৃত্বাধীন সরকারের আমলে ১৩ অগস্ট ১৯৯০ তারিখের, যাতে এসইবিসি-দের জন্য ২৭ শতাংশ সংরক্ষণের কথা বলা হয়েছিল; এবং অন্যটি নরসিংহ রাও সরকারের আমলে ২৫ সেপ্টেম্বর ১৯৯১ তারিখের, যা সামাজিক ও শিক্ষাগত পশ্চাৎপদতার ধারণার মধ্যে অর্থনৈতিক অবস্থার কথাটিও ঢুকিয়েছিল, যেখানে বলা হয়েছিল যে, এসইবিসি-দের মধ্যে যাঁরা আর্থিক ভাবে দুর্বলতর, তাঁদের অগ্রাধিকার দেওয়া হবে, এবং যাঁরা সংরক্ষণের আওতায় পড়েন না, তেমন গোষ্ঠীর আর্থিক ভাবে দুর্বল মানুষদের জন্য ১০ শতাংশ অতিরিক্ত সংরক্ষণের ব্যবস্থা হবে— সেই প্রশ্ন থেকেই সুপ্রিম কোর্টে এই মামলার সূচনা হয়।

সুপ্রিম কোর্ট এসইবিসি-দের জন্য ২৭ শতাংশ সংরক্ষণের সিদ্ধান্তটি বজায় রাখে, এবং সংবিধানের ১৫(৪) ও ১৬(৪) অনুচ্ছেদে পশ্চাৎপদতার যে চরিত্র বর্ণনা করা আছে, তার মধ্যে তুলনা করে দেখে। আর্থিক অবস্থার উপর ভিত্তি করে সংরক্ষণ দেওয়া বা না-দেওয়ার প্রসঙ্গটিকে সুপ্রিম কোর্ট সম্পূর্ণ উড়িয়ে দেয়নি (অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির মধ্যে ‘ক্রিমি লেয়ার’-এর ধারণাটি তার সাক্ষ্য বহন করে), কিন্তু স্পষ্ট জানায় যে, পশ্চাৎপদতা নির্ধারণের ক্ষেত্রে জাতিগত পরিচিতিই প্রধান, এবং কিছু ক্ষেত্রে একমাত্র, মাপকাঠি হবে। লক্ষণীয় যে, আর্থিক ভাবে অনগ্রসর শ্রেণির জন্য ১০ শতাংশ সংরক্ষণের সিদ্ধান্তটি আদালত নাকচ করে দেয়— এই ব্যবস্থাটি শুধুমাত্র আর্থিক মাপকাঠির উপর ভিত্তি করে তৈরি বলে, এবং তা ৫০ শতাংশের ঊর্ধ্বসীমাকে লঙ্ঘন করে বলেও। সাম্প্রতিক কালে মরাঠাদের জন্য সংরক্ষণ বিষয়ক মামলাতেও এই ৫০ শতাংশের ঊর্ধ্বসীমার উপর জোর দেওয়া হয়েছে।

কাজেই, স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠবে যে, মণ্ডল কমিশন মামলায় যখন সুপ্রিম কোর্টের নয় বিচারপতির বেঞ্চ সম্পূর্ণ সহমত হয়ে আর্থিক অবস্থার ভিত্তিতে সংরক্ষণের প্রশ্নটিকে নাকচ করে দিয়েছিল, তখন সাম্প্রতিক মামলায় আদালত ভিন্ন সুরে কথা বলল কেন? এই প্রশ্নের উত্তর রয়েছে এই তথ্যটিতে যে, বর্তমান মামলাটি সংবিধান সংশোধনীকে কেন্দ্র করে, আইনসভার কোনও সাধারণ সিদ্ধান্ত বা শাসনবিভাগের কোনও নির্দেশকে কেন্দ্র করে নয়। এই মামলার কষ্টিপাথরটি হল বেসিক স্ট্রাকচার ডকট্রিন, যা ১৯৭৩ সালের বহু আলোচিত কেশবানন্দ ভারতী বনাম স্টেট অব কেরল মামলায় ১৩ বিচারপতির বেঞ্চের রায় থেকে তৈরি হয়েছিল। এই ডকট্রিন বা মতবাদ বলে যে, সংসদ সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে কোনও সিদ্ধান্ত নিলে তাকে তখনই নাকচ করা যায়, যদি তা সংবিধানের মৌলিক চরিত্রটিকেই পাল্টে দিতে পারে। যদিও সরকার পশ্চাৎপদতার বিভিন্ন শ্রেণিকে কার্যত গায়ের জোরে এক করে দিয়েছে, তবুও এই মামলায় সংখ্যাগরিষ্ঠ তিন বিচারপতি মত দিয়েছেন যে, তাতে সংবিধানের মৌলিক চরিত্র অক্ষুণ্ণ রয়েছে। সংরক্ষণ যে কোনও চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নয়, এবং তাকে অনন্তকাল চলতে দেওয়াও উচিত নয়, মামলার প্রশ্নের সঙ্গে এই পর্যবেক্ষণটিকে এক সঙ্গে পাঠ করেছে সংখ্যাগরিষ্ঠ রায়। এবং, কেন চিরকাল সংরক্ষণের ভিত্তি হিসাবে শুধুমাত্র অর্থনৈতিক অনগ্রসরতার পরিবর্তে সামাজিক ও শিক্ষাগত পশ্চাৎপদতাকে বিচার করা হয়েছে, সেই কারণগুলি এই সংখ্যাগরিষ্ঠ রায়ে ধুয়েমুছে গিয়েছে।

অশনি সংকেত ছবিতে গঙ্গাচরণ দরিদ্র হলেও ব্রাহ্মণ ছিলেন— অসীম দারিদ্র সত্ত্বেও তাঁর পক্ষে নিজের জাতিপরিচয় ও সামাজিক অবস্থানগত সম্মানকে ব্যবহার করে বেঁচে থাকার রসদটুকু সংগ্রহ করা সম্ভব ছিল। যাঁদের জাতিগত পরিচয়ের বোঝা বয়ে বাঁচতে হয়, তাঁদের দিকে তাকালে মনে হয়, আদালতের রায় সাম্যের এত দিনের ধারণাটিকেই সম্পূর্ণ উল্টে দিল।

আইনবিদ্যা বিভাগ, ওয়েস্ট বেঙ্গল ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব জুরিডিক্যাল সায়েন্সেস

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Reservation Supreme Court of India
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE