E-Paper

এক দেশ, দুই শরণার্থী

ঔপনিবেশিক সময়ে, চা-বাগানের ব্রিটিশ মালিক বা তাদের উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের কর্মী-সন্ধান বন্ধ করার জন্য ব্রিটিশরা এখানে ‘ইনার লাইন পারমিট’ চালু করে। তাতে কাজ না হলে, চিন-কুকিদের অধিকৃত অঞ্চলকে তারা ‘আন-অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ এরিয়া’ বলে আলাদা করে দেয়।

অনিন্দিতা ঘোষাল

শেষ আপডেট: ১১ ডিসেম্বর ২০২৫ ০৬:১৬

ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের এক প্রান্তিক সীমানা রাজ্য মিজ়োরাম। গা-ঘেঁষা বাংলাদেশ আর মায়ানমারের সঙ্গে ৭২২ কিলোমিটার আন্তর্জাতিক সীমান্তরেখায় ঘেরা মিজ়োরাম আবার অসম, মণিপুর এবং ত্রিপুরার সঙ্গে অভ্যন্তরীণ সীমানার মাধ্যমে যুক্ত। ২০২১-এর পর থেকে মায়ানমারের চিন প্রদেশে অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষয়ী দ্বন্দ্বের কারণে বিরাট সংখ্যক সংখ্যালঘু ‘শরণার্থী’ চিন জাতিগোষ্ঠীর মিজ়োরামে বসবাস দক্ষিণ এশিয়ার পুনর্বাসনের ইতিহাসে একটা ভিন্ন পরিপ্রেক্ষিত তৈরি করেছে। উত্তর-পূর্ব ভারতে উদ্বাস্তু, তথাকথিত অবৈধ অনুপ্রবেশকারী, শরণার্থী, অর্থনৈতিক অভিবাসী, বিদেশি বা রাষ্ট্রহীন সম্প্রদায়ের সংখ্যা কিছু কম নয়। তাদের নিয়ে কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য সরকার এবং স্থানীয় মানুষদের মধ্যে তরজা তুঙ্গে। সেই দ্বান্দ্বিক পরিস্থিতিতে, মিজ়োরামে স্বচ্ছন্দে ও সানন্দে বিপুলসংখ্যক শরণার্থীর ভরণপোষণের ছবিকে অবিশ্বাস্য মনে হয়।

প্রাক্-ঔপনিবেশিক বর্মা বা এখনকার মায়ানমারের চিন প্রদেশ থেকে মিজ়োরাম-মুখী মানুষ এসেছে নিয়মিত। ১২০০ খ্রিস্টাব্দের আগে এই চিন, মিজ়ো, জোমি, লুসাই, মার এবং কুকিরা, ‘জো’ জনজাতি গোষ্ঠীর অংশ হিসাবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার পাহাড়ি অঞ্চলে বাস করত। এদের মধ্যে ভাষা, ধর্ম, সাংস্কৃতিক রীতিনীতির মিল ছিল। কিন্তু ব্রিটিশ শাসকরা তাদের স্থানীয় নাম অনুসারে, একই জনজাতি গোষ্ঠীর বিভিন্ন নামকরণ করে। টিবেটো-বর্মান ভাষায় কথা বলা এই কুকি-চিনরা ছিল জুম চাষের উপর নির্ভরশীল ভ্রাম্যমাণ জনজাতি গোষ্ঠী।

ঔপনিবেশিক সময়ে, চা-বাগানের ব্রিটিশ মালিক বা তাদের উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের কর্মী-সন্ধান বন্ধ করার জন্য ব্রিটিশরা এখানে ‘ইনার লাইন পারমিট’ চালু করে। তাতে কাজ না হলে, চিন-কুকিদের অধিকৃত অঞ্চলকে তারা ‘আন-অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ এরিয়া’ বলে আলাদা করে দেয়। ১৮২৪-১৮২৯ সালের মধ্যে মিজ়োরাম, লুসাই আর চিন স্টেট তৈরি হলেও, এই বৃহৎ অঞ্চলে এই জনজাতি গোষ্ঠীর অবাধ গতিবিধি ছিল। কুকিরা বারুদের ব্যবহার জানত, তাই ব্রিটিশ শাসকরা ‘কুকি লেভি’ বলে সেনাবাহিনী তৈরি করেন। ১৯৩৭-এ ভারত থেকে বর্মা আলাদা হয়ে যায়। ১৯৪৬-৪৭ সালে, ভারত-ভাগের আগে, এই কুকি-চিনরা ‘জো স্টেট’ নামে আলাদা রাষ্ট্র তৈরির ডাক দেয়, যার অন্তর্গত ছিল ‘চিটাগং হিল ডিস্ট্রিক্ট’ও। কিন্তু তাদের আলাদা রাষ্ট্র তৈরির সেই স্বপ্ন সত্যি হয়নি।

১৯৪৮-এ বর্মা স্বাধীন হওয়ার পরে, বর্মার অন্তর্গত চিন স্টেট বিশেষ প্রশাসনিক মর্যাদার দাবি জানায়। চিন অঞ্চল ছিল পাহাড়ি, অনুন্নত, এবং খ্রিস্টধর্মাবলম্বী। ভারত-মায়ানমার সীমান্ত একই জনজাতি গোষ্ঠী, এমনকি তাদের পরিবারকেও ভাগ করেছিল। তাদের মধ্যে সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক বন্ধন বজায় রাখা, উৎসব, বিয়েতে যোগ দেওয়ার জন্য ১৯৬৮ সালে সীমান্ত এলাকার বাসিন্দাদের ভিসা ছাড়া অন্য দেশের ৪০ কিলোমিটার অবধি যাতায়াতের অনুমতি দেওয়া হয়। অবৈধ মাদক/অস্ত্র ব্যবসা চলাচলের অভিযোগের ফলে ২০০৪ সালে তা কমিয়ে ১৬ কিলোমিটার করা হয়।

১৯৭৪ সালে চিন প্রদেশকে আনুষ্ঠানিক ভাবে চিন স্টেট হিসাবে মান্যতা দেওয়া হলেও, জনগণকে প্রকৃত স্বায়ত্তশাসন না দেওয়ার অভিযোগে ১৯৮৮ সাল থেকে আত্মনিয়ন্ত্রণ ও গণতন্ত্রের জন্য লড়াই শুরু হয়। চিন জাতীয় ফ্রন্ট (সিএনএফ) এবং এর সশস্ত্র শাখা, চিন জাতীয় সেনাবাহিনী (সিএনএ) প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলে। অন্য দিকে, ১৯৮০-র দশকে মিজ়ো ন্যাশনাল ফ্রন্ট (এমএনএফ) আলাদা রাজ্যের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। ১৯৮৬ সালে শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে মিজ়োরামকে পূর্ণ রাজ্যের মর্যাদা দেওয়া হয়। কিন্তু এই বিজয় বৃহত্তর কুকি-চিন জনজাতি গোষ্ঠীর রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষাকে মেটাতে পারেনি। সেই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৮৮ সালে মিজ়োরামের চাম্পাই জেলায় জো-পুনর্মিলন সংস্থা (জোরো) তৈরি করা হয়। এই সংস্থার প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল সমস্ত জো/মিজ়ো/চিন/কুকি/জোমি জনজাতি গোষ্ঠী, যাদের পূর্বপুরুষ, ভাষা এবং সংস্কৃতি একই, তাদের একক রাজনৈতিক প্রশাসনের অধীনে পুনর্মিলিত করা।

মায়ানমারে চিন স্টেটের বাসিন্দা কুকি-চিনরা গত কয়েক দশক ধরে জাতিগত নিপীড়ন এবং ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার— যার ফলে হাজার হাজার মানুষ মিজ়োরামে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছেন। ২০২১ সালে মায়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থানের পর এই দেশত্যাগ নাটকীয় ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। চিন প্রদেশ থেকে মাত্র ৫০ কিলোমিটার দূরের মিজ়োরাম, সেখানকার মোট জনসংখ্যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশকে আশ্রয় দিতে বাধ্য হয়েছে।

বিভিন্ন সূত্রের অনুমানের ভিত্তিতে বলা যায়, সারা ভারতে তাঁদের মোট সংখ্যা ৮৩,০০০-এর মতো। ২০২৫ সালের জুলাই মাসে অন্তত ৪,০০০ শরণার্থী মিজ়োরামে এসেছেন। আবার, শেষ কিছু বছর ধরে, পার্শ্ববর্তী মণিপুরে জাতিগত হিংসার সময়ে, অভ্যন্তরীণ ভাবে বাস্তুচ্যুত কুকি-চিনরা মিজ়োরামে আশ্রয় নিয়েছে। ‘কুকি-মিজ়ো-চিন-জোমি’ গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত কুকি-চিনরা মিজ়োরামে, স্থানীয় আতিথেয়তা, উষ্ণ অভ্যর্থনা, জাতিগত বন্ধন, আত্মীয়তার সম্পর্ক ছাড়াও অসরকারি ও ব্যক্তিগত স্তরে বিশেষ কিছু সুবিধা পেয়েছে।

মায়ানমারের চিন প্রদেশ অর্থনৈতিক ভাবে সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া অঞ্চল। সেখানকার কুকি-চিনদের আয়ের মূল উৎস আফিম চাষ, অবৈধ ড্রাগ এবং অস্ত্র চোরাচালান, যা ১৯৯১ সালে ঘোষিত ‘লুক ইস্ট পলিসি’, ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী মোদীর ‘অ্যাক্ট ইস্ট পলিসি’, ২০১৮ সালে ‘ল্যান্ড বর্ডার ক্রসিং অ্যাক্ট’, বর্ডার হাট তৈরি ইত্যাদির ফলে রমরমিয়ে চলছিল। কিন্তু, মণিপুরে মেইতেইদের সঙ্গে কুকি-চিনদের জাতিগত সংঘাত বাধলে ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে ভারত-মায়ানমার সীমান্তে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ এই অবাধ চলাচল বন্ধ করে, সীমান্তে কাঁটাতার দেওয়ার কথা ঘোষণা করেন। ২০২৪ সালের ডিসেম্বরের শেষ থেকে, মিজ়োরামের সীমান্তবর্তী অঞ্চলে এই নিয়মগুলি চালু করা হয়।

মিজ়োরামের কুকি-চিন শরণার্থীরা স্থানীয় আতিথেয়তা পাচ্ছে, বিশেষ করে স্থানীয় চার্চ এবং এনজিও, এমনকি রাজ্য সরকারও এদের শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা বা নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিচ্ছে। মিজ়োরামের পক্ষ থেকে সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ করার ফলে আত্মীয়তার সম্পর্ক ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করায় সীমান্তের দু’পাশে অনুমোদিত চলাচলের পরিসর ১৬ কিলোমিটার থেকে কমিয়ে ১০ কিলোমিটার করা হয়েছে। বহু শরণার্থী মাদক পাচার-সহ অন্য অপরাধমূলক কার্যকলাপের সঙ্গে যুক্ত, এ সব জানার পরও মিজ়োরামের মুখ্যমন্ত্রী শরণার্থীদের স্থানীয় আইন এবং সাংস্কৃতিক রীতিনীতি মেনে চলার ‘অনুরোধ’ করেছেন। কিন্তু ‘অবৈধ অভিবাসী’দের বিতাড়ন করা হয়নি, বরং মিজ়োরাম এদের ব্যয়ের বোঝা বহন করছে। কেন্দ্রীয় সরকার মিজ়োরামে ‘এসআইআর’ চালু করার কথা বলেনি, বরং আর্থিক সহায়তা দিয়েছে চিন শরণার্থীদের।

অন্য দিকে, একই দেশ মায়ানমারের রাখাইন রাজ্যের আনুমানিক ৪০,০০০ মুসলিম সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা ২০১৭ সাল থেকে গণহত্যা এবং নির্যাতনের কারণে জম্মু, দিল্লি, হায়দরাবাদ ও হরিয়ানায় আশ্রয় নিয়েছে। বিশ্বের সবচেয়ে নির্যাতিত জনগোষ্ঠীর মধ্যে অন্যতম এই রোহিঙ্গাদের ভারত সরকার কিন্তু ‘অবৈধ অভিবাসী’ হিসাবে দেখে— তাই ভারতে তাদের অস্তিত্ব চরম আইনি অনিশ্চয়তা এবং মানবিক দুরবস্থায় ভরা। মহিলা ও শিশু-সহ হাজার হাজার রোহিঙ্গা পরিবারকে বছরের পর বছর ধরে জেল এবং বিশেষ ভাবে তৈরি হোল্ডিং সেন্টারে নির্বিচারে আটক করে রাখা হয়েছে। এই কেন্দ্রগুলোয় স্যানিটেশন ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। পরিবারের সদস্যদের আলাদা করে রাখা, চিকিৎসা ও মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা না দেওয়া— চলছে সমানেই। তাদের আইনি মর্যাদা অস্বীকার করে কেন্দ্রীয় সরকার সুপ্রিম কোর্টে যুক্তি দিয়েছে, রোহিঙ্গাদের উপস্থিতি জাতীয় নিরাপত্তার জন্য বিপদস্বরূপ।

একই দেশ থেকে আসা দু’দল রাষ্ট্রহীন শরণার্থী বিরাট সংখ্যায় ভারতে বসবাস করছে অবৈধ অভিবাসী হিসাবে— এক দলের প্রতি রাষ্ট্রের দরাজ হাত প্রসারিত, অন্য দল দেশের শত্রু হিসাবে ঘোষিত। ‘রোহিঙ্গা’ এখন একটা রাজনৈতিক গালাগালে পরিণত। অথচ মিজ়োরামে আসা শরণার্থীরা কিন্তু সেখানকার রাজনৈতিক দলগুলির সাদর প্রশ্রয় পাচ্ছে। কেন? ধর্ম আলাদা বলে? না কি সুদূর মিজ়োরামের খবর আমরা রাখি না বলে?

প্রায় ১৫০ কোটির দেশে মাত্র কয়েক হাজার রোহিঙ্গাকে কেন ন্যূনতম সহায়তা দিতে পারছি না, যেখানে ছোট্ট মিজ়োরাম তার চেয়ে অনেক বেশিসংখ্যক কুকি-চিনকে আশ্রয় দিতে পারছে?

ইতিহাস বিভাগ, ডায়মন্ড হারবার মহিলা বিশ্ববিদ্যালয়

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Rohingya Myanmar SIR

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy