ফরাক্কা ব্যারাজ কলকাতায় উন্নয়ন এনেছে, কিন্তু আমাদের জন্য এনেছে বিপর্যয়। বারো বছরেরও বেশি সময় নদী-ভাঙন চলেছে। অন্তত পনেরো বার ঘর বানিয়েছি নতুন করে”— বলছিলেন মুর্শিদাবাদের নির্মল চরের কৃষক মুস্তাফা। বলছিলেন, “এটাই আমাদের প্রধান সঙ্কট নয়; আমাদের আসল বিপদ বিএসএফ (সীমান্ত রক্ষী বাহিনী)। নদী যেমন চলে, আমরাও তেমন চলি— নতুন চরে ঘর বাঁধি, জমি পরিষ্কার করি, চাষ করি। কিন্তু এখন সীমান্তে ভারতের দিকের নিজেদের জমিতে অনুমতি ছাড়া বিএসএফ যেতে দেয় না।” এই হল বাংলাদেশের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের নদী সীমান্ত এলাকার হাজার হাজার কৃষক ও জেলের দ্বৈত সঙ্কট। নদীর ভূমি-ক্ষয় তো আছেই, পাশাপাশি আছে নিজের দেশেই ‘বিদেশি’ সন্দেহে নিরন্তর নজরদারি।
নির্মল চর মুর্শিদাবাদ জেলার ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের ঠিক কাছে। ১৯৮৮ সালের ‘বড় ভাঙন’-এ আখেরিগঞ্জ গ্রাম পঞ্চায়েতটি মানচিত্র থেকে মুছে যায়। কারণ হয়তো ফরাক্কা ব্যারাজ, যা নদীর প্রাকৃতিক প্রবাহকে বাধাপ্রাপ্ত করেছে। ১৯৮৮-র পর প্রায় বারো বছর ধরে গঙ্গা-পদ্মা গ্রাস করে নিয়েছে বিপুল পরিমাণ জমি। ছিটকে গিয়েছে অসংখ্য পরিবার। কেউ আঁকড়ে ধরেছিল নতুন গড়ে ওঠা ভাঙনভূমি, কেউ আবার নদীর তাড়া খেয়ে চলে গিয়েছিল শহর-গ্রামে।
যখন নদী তার প্রবাহে নতুন ভূমি ফেলে রেখে যায়, জলবিধ্বস্ত চরবাসীরা পলিকে মাটিতে, আর মাটিকে জীবিকায় রূপান্তরিত করে। পাট, কালো ছোলা, ধান রোপণ করে উর্বর মাটিতে, বন্যায় ভেসে গিয়ে আবার নতুন চরে ঘর বাঁধে। মুস্তাফা বালক বয়স থেকে বাবার সঙ্গে চরের জমিতে চাষ করে আসছেন, জানতেন নতুন জমি খুঁজে বেড়ানো চলত ভাঙনের আশঙ্কা দেখা দিলেই। “আমরা আজ এখানে, কাল ওখানে। যেমন নদী বয়, আমরাও বইতাম। অনেক সময় তো বুঝতেই পারতাম না আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে সেটা ভারত না বাংলাদেশ।”
এখন আর তা সম্ভব নয়। গত এক দশকে সীমান্ত বদলে গিয়েছে—ওয়াচ টাওয়ার, কাঁটাতার, আউটপোস্ট। ছোটখাটো গতিবিধিতেও নজরদারি চালানো হয়। কেবলমাত্র নিজের জমিতে যেতে বা নদীতে মাছ ধরতে এই চরের গ্রামবাসীদের প্রতি দিন নিজেদের নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে হচ্ছে বিএসএফ-এর কাছে, কৃষকরা আধার কার্ড, জমির খতিয়ান জমা দেন কেবল নিজের জমিতে চাষের লিখিত অনুমতির জন্য। অনেক সময় অনুমতির বিনিময়ে গুনতে হয় জবরদস্তির শ্রম— ঘাস কাটা, জল আনা, কোয়ার্টার পরিষ্কার করা।
ফল হয় ভয়াবহ। ফসল পাকলেও জমিতে ঢুকতে না পারায় খেতেই পড়ে থাকে ধান। অপমান সহ্য করতে না পেরে অনেক তরুণ কৃষিকাজ ছেড়ে দেন। পুরো পরিবার ভিটেমাটি ফেলে জীবিকার তাগিদে পাড়ি জমায় দূর রাজ্যে। হোসেন, ২৩ বছরের তরুণ, যেখানেই কাজের সুযোগ পান, তা নির্মাণ হোক, কৃষি হোক কিংবা বালি খনন— অভিবাসী শ্রমিক হিসেবে চলে যান। তিনি তামিলনাড়ু থেকে সদ্য ফিরেছেন কৃষিশ্রমিক হিসেবে কাজ করে। “মজুরি বাংলায় যা পাই, তার চেয়ে ভাল, কিন্তু ভয়ানক গরম। ওই ধরনের খাটনি কিছু মাস খাটা যেতে পারে, তার পর থামতে হয়। তবু চরে বাবার জমিতে চাষ করতে যাওয়ার চেয়ে আমি ওটাই পছন্দ করি। এখানে কখন যে বাংলাদেশি বলা হবে, এবং তখন কেমন ব্যবহার করবে কেউ জানি না।” এখানকার অভিবাসন শুধু জলবায়ু পরিবর্তন বা কৃষি সঙ্কটের কারণে হয় না— সীমান্ত সুরক্ষার শ্বাসরোধী চাপে হয়।
এই সুরক্ষা নীতি নিছক দুর্ঘটনা নয়। এটা নির্বাচনী কৌশল। পশ্চিমবঙ্গে ২০২৬ সালের বিধানসভা নির্বাচন ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ সীমান্ত নিয়ন্ত্রণকে প্রধান স্লোগান করেছেন এবং রাজ্য সরকারকে অনুপ্রবেশে মদত দেওয়ায় অভিযুক্ত করেছেন। কাঁটাতার এবং নজরদারির প্রতিশ্রুতি রাজনৈতিক প্রচারে ভালই কাজে দিচ্ছে, যা ‘বাংলাদেশি মুসলমান’-এর ভয়ের উপর দাঁড়িয়ে ক্ষমতাকে কেন্দ্রীভূত করছে। এর মধ্যেই ২০২৫ সালের ইমিগ্রেশন ও ফরেনার্স বিল পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করেছে, যা ‘যুক্তিসঙ্গত সন্দেহ’-এর ভিত্তিতে পরোয়ানা ছাড়াই গ্রেফতার করার ক্ষমতা দিয়েছে। বাস্তবে সেই সন্দেহ নেমে আসে বাংলাভাষী মুসলমানদের উপর— যাঁরা দশকের পর দশক ধরে এই জমি চাষ করছেন, অথচ রাজনৈতিক ভাষণে তাঁরা হয়ে যান ‘বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী’।
জাতীয় নিরাপত্তার ভাষ্য গোটা সমাজকে সন্দেহের চোখে দেখে। কৃষিকাজ করা, মাছ ধরা হয়ে ওঠে অপরাধের সমান। কৃষক হয়ে যান সন্দেহভাজন। প্রতিবেশী হয়ে যায় বহিরাগত। ভয়ভীতির রাজনীতির বোঝা বইতে হয় বাংলার মুসলমান কৃষক আর দলিত উদ্বাস্তুদের, যাঁরা সবচেয়ে দরিদ্র ও অসুরক্ষিত।
যখন অমিত শাহ প্রতিজ্ঞা করেন— “একটা পাখিকেও সীমান্ত পার হতে দেব না”, তখন নদী অবাধে বয়ে যায়। বয়ে আনে পলি, মাছ আর জীবিকা। প্রকৃতির শক্তি সীমান্ত মানে না। তাকে বশে আনার চেষ্টায় প্রায়ই উল্টো ফল হয়। চরবাসীরা ভাঙনের মুখে ঘর বাঁধেন, নদীর ইশারায় চাষের জমি সরান। প্রকৃতি যা ভাঙে, মানুষ তা আবার গড়ে নেয়। কিন্তু রাষ্ট্র যা ভাঙে— স্বাধীনতা, মর্যাদা, স্বজন— তা ফেরত পাওয়া যায় না।
নির্বাচনী ভাষণ তীক্ষ্ণ হয়, সঙ্গে এই প্রশ্ন তৈরি হয়, কেমন দেশ নিজের নাগরিকদের বিদেশি বলে সন্দেহ করে? কেমন নিরাপত্তা বাহিনী কৃষককে নিজের জমিতে পা রাখার অনুমতি চাইতে বাধ্য করে? কেমন রাজনীতি চায় এই দেশ, জীবন মুছে দিয়ে, ভেঙে দিয়ে?
অ্যানথ্রপলজি অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ়, ক্রিয়া ইউনিভার্সিটি।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)