E-Paper

শিক্ষার সর্বনাশে কার উল্লাস

আশা করা গিয়েছিল, অতীতের ত্রুটিবিচ্যুতি থেকে শিক্ষা নিয়ে এ বার হয়তো খুব দ্রুততার সঙ্গে স্কুলগুলিতে ক্রমবর্ধমান শূন্য পদগুলি পূরণ করে রাজ্যের রাহুগ্রস্ত শিক্ষা ব্যবস্থার হাল ফেরানোর উদ্যোগ করা হবে।

তূর্য বাইন

শেষ আপডেট: ২৯ নভেম্বর ২০২৫ ০৫:১৩

ছোটবেলায় একটা প্রবাদ পড়েছিলাম, ‘যারা সকলকে খুশি করতে চায়, তারা কাউকে খুশি করতে পারে না’। এ যে কতখানি সত্যি, তা ২০১৬ সালের স্কুল সার্ভিস কমিশনের পুরো প্যানেলটি বাতিল হওয়ার পরের ঘটনাক্রমে বার বার প্রমাণিত হয়েছে। মেধার ভিত্তিতে নিযুক্ত যোগ্যতাসম্পন্নদের সঙ্গে দুর্নীতির মাধ্যমে চাকরি পাওয়া শিক্ষকদের চাকরি রক্ষার নিরন্তর চেষ্টা হয়েছে বটে, কিন্তু তাতে লাভ কিছু হয়নি, বরং ক্ষতি হয়েছে বিস্তর। রাজ্যের শিক্ষাব্যবস্থা বেহাল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কলুষিত হয়েছে রাজ্যের ভাবমূর্তি, কালিমালিপ্ত হয়েছে শিক্ষকতার ব্রত।

অনেকেরই ধারণা, সুপ্রিম কোর্টে মামলা চলাকালীন দুর্নীতির মাধ্যমে চাকরি পাওয়া শিক্ষকদের তালিকাটি প্রকাশ করলে, এমনকি সিবিআই রিপোর্ট অনুযায়ী ‘নট স্পেসিফিক্যালি টেন্টেড’ শিক্ষকদের মধ্যেও যদি কোনও অযোগ্য শিক্ষক থেকে থাকেন, তাঁদের চিহ্নিত করে বাকিদের যোগ্য বলে স্বীকার করতে পারলে হয়তো জল এত দূর গড়াত না।

কিন্তু গতস্য শোচনা নাস্তি। আশা করা গিয়েছিল, অতীতের ত্রুটিবিচ্যুতি থেকে শিক্ষা নিয়ে এ বার হয়তো খুব দ্রুততার সঙ্গে স্কুলগুলিতে ক্রমবর্ধমান শূন্য পদগুলি পূরণ করে রাজ্যের রাহুগ্রস্ত শিক্ষা ব্যবস্থার হাল ফেরানোর উদ্যোগ করা হবে।

উদ্যোগ করাও হল, কিন্তু অভিজ্ঞ শিক্ষকদের জন্যে বাড়তি দশ নম্বর অগ্রিম বরাদ্দ রেখে নতুনদের সঙ্গে পরীক্ষার আয়োজন করায় অনভিজ্ঞ চাকরিপ্রার্থীরা পড়লেন এক অসম প্রতিযোগিতার মধ্যে। ফলে এই পরীক্ষায় সর্বোচ্চ নম্বর পাওয়া সত্ত্বেও নথি যাচাইয়ে ডাক না পেয়ে তাঁরা রীতিমতো ক্ষুব্ধ। অপর দিকে, ফল প্রকাশের পর কতিপয় ‘টেন্টেড’ শিক্ষক নথি পরীক্ষার জন্যে ডাক পাওয়ায় এবং ‘নট স্পেসিফিক্যালি টেন্টেড’ চাকরিহারা শিক্ষকদের একাংশ ডাক না পাওয়ায় তাঁদের হতাশা এবং ক্ষোভ ক্রমশ ঊর্ধ্বগামী। উপায়ান্তর না দেখে ফের আন্দোলনে নেমেছেন চাকরিহারা শিক্ষকরা। তবে এ বার তাঁরা একা নন, তাঁদের সঙ্গে শামিল হচ্ছেন নতুন চাকরিপ্রার্থীরাও। বিষয়টি পুনরায় গড়িয়েছে আদালত পর্যন্ত। ফলে বিদ্যালয়গুলিতে শূন্যপদ অবিলম্বে পূরণ হওয়ার সম্ভাবনা যে অতি ক্ষীণ, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। শিক্ষা মহলের অনেকেরই অভিমত, এমনটা যে ঘটতে পারে, তা আগেভাগে আঁচ করা কিছু কঠিন ছিল না। সুতরাং অবশ্যম্ভাবী শিক্ষক নিয়োগের সদিচ্ছা নিয়েই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে।

অনেকেই মনে করছেন, চাকরিহারা ‘নট স্পেসিফিক্যালি টেন্টেড’ শিক্ষকদের জন্যে বাড়তি দশ নম্বর বরাদ্দ না করে প্রথমে কেবলমাত্র তাঁদের জন্যে ‘লিমিটেড’ পরীক্ষার ব্যবস্থা করলে হয়তো তাঁদের স্বার্থ অধিকতর সুরক্ষিত হত। যে-হেতু এই রাজ্যে দীর্ঘ দিন ধরে এসএসসি-র পরীক্ষা অনিয়মিত এবং বিদ্যালয়গুলিতে শিক্ষকদের শূন্যপদ ক্রমবর্ধমান, তাই ‘লিমিটেড’ পরীক্ষার মাধ্যমে চাকরিহারা শিক্ষকদের মধ্যে থেকে উত্তীর্ণদের নিয়োগ করার পরেও যে শূন্যপদ থেকে যেত, সেগুলি সকলের জন্যে উন্মুক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে পূরণ করা যেত। সে ক্ষেত্রে নতুন চাকরিপ্রার্থীদের অপেক্ষার মেয়াদ হয়তো কিঞ্চিৎ বাড়ত, কিন্তু সম্প্রতি উদ্ভূত বিড়ম্বনার মধ্যে তাঁদের পড়তে হত না।

কিন্তু এই সহজ সমাধানের কথা বিবেচনার প্রধান অন্তরায় হল, পুরো বিষয়টির রাজনীতিকরণ। শাসক এবং বিরোধী সকলেই এই অচলাবস্থা থেকে সর্বোচ্চ রাজনৈতিক সুবিধা অর্জন করার কৌশল নিয়ে ব্যস্ত। সেই লক্ষ্যে এক পক্ষ নিজেদের ত্রুটিবিচ্যুতি এবং দুর্নীতিকে আড়াল করতে মরিয়া, আর ‘ঢাকি সমেত বিসর্জন’-পক্ষীয়রা পুরো নিয়োগ প্রক্রিয়াটাকেই অবৈধ প্রতিপন্ন করে চাকরিহারাদের সঙ্গে নতুন চাকরিপ্রার্থীদের যাবতীয় আশাভরসা নিঃশেষ করে দিতে বদ্ধপরিকর। শাসক-বিরোধীর এই যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলার জাঁতাকলে পড়ে নাভিশ্বাস উঠেছে রাজ্যের শিক্ষাব্যবস্থার, শিক্ষার অভাবে চিরতরে পঙ্গু হতে বসেছে একটা গোটা প্রজন্ম। এই সর্বাত্মক ধ্বংসের মুখে দাঁড়িয়েও যুযুধানদের মধ্যে শুভবুদ্ধি উদয়ের কোনও লক্ষণ এখনও পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না, যে কোনও মূল্যে তাঁরা কেবল জয়ের প্রত্যাশী। রাজ্যের শিক্ষাব্যবস্থার হাল ফেরানো এবং নিরপরাধকে শাস্তির হাত থেকে রক্ষা করার দায় যেমন শাসকের, তেমনই বিরোধীরও— এই সহজ সত্যটি কোনও পক্ষই বুঝতে চাইছেন না।

আশ্চর্য, রাজ্যের নাগরিক সমাজকেও এই বিষয়টি নিয়ে তেমন সরব হতে দেখা যাচ্ছে না। অনেকেই হয়তো মনে করছেন, যা কিছু ঘটেছে এবং ঘটছে, তার পুরোটাই আদালতের নির্দেশে, সুতরাং এ ক্ষেত্রে তাঁদের কোনও দায় নেই। কিন্তু এ কথা ভুললে চলবে না যে, এই বিপর্যয়ের নেপথ্যে রয়েছে সীমাহীন দুর্নীতি, অনেকেই যেটাকে প্রাতিষ্ঠানিক বলে অভিযোগ করে থাকেন।সুতরাং সেটাকে অস্বীকার করে শুধুমাত্র মামলাকারীদের কাঠগড়ায় তোলাটা যেমন যুক্তিযুক্ত নয়, তেমনই যাঁরা মামলা করলেন, তাঁদের পক্ষ থেকে শুরু থেকেই দোষী-নির্দোষ নির্বিশেষে সকলের চাকরি বাতিলের দাবিতে সওয়াল করাটাও কিন্তু মোটেই সমর্থনযোগ্য নয়।

যতই আইন এবং আদালতের দোহাই দেওয়া হোক না কেন, মনে রাখতে হবে, মানুষের স্বার্থ এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যেই এগুলির সৃষ্টি। দুর্নীতি, তা যে মাপেরই হোক না কেন, তার বিরুদ্ধে মামলা হওয়াই উচিত, এ বিষয়ে সংশয়ের কোনও অবকাশ নেই। কিন্তু তার অভিমুখগঠনমূলক হওয়াটাই বাঞ্ছনীয়, নিশ্চয়ই ধ্বংসাত্মক নয়। যোগ্যতা এবং মেধার ভিত্তিতে পাওয়া চাকরি বাতিল হওয়াটা কখনও উল্লাসের বিষয় হতে পারে না। যে জয়ে নিরীহ মানুষের জীবন-জীবিকা বিপন্ন হয়, নিরপরাধ শাস্তির সম্মুখীন হন, সেই জয়ের দম্ভ কদর্যতারই নামান্তর।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Education SSC

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy